পাহাড়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় সেনাবাহিনীর বিরামহীন তৎপরতা

fec-image

চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার অঞ্চলে গত ৩ আগস্ট থেকে শুরু হয় বিরামহীন অতিবৃষ্টি, যা টানা এক সপ্তাহ চলে। ফলে এ অঞ্চলে দেখা দেয় ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অতিবৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় ডুবে যায় নিম্নাঞ্চল, ভেঙে যায় ব্রিজ-কালভার্ট এবং রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে অনেক জনপদ। স্থানে স্থানে ঘটে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি আকারের অসংখ্য পাহাড় ধসের ঘটনা। এতে বাড়িঘর ভেঙ্গে কোথাও কোথাও হতাহতের ঘটনাও ঘটে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ে। বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন অন্ধাকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে কোনো কোনো এলাকা। খাবার, বিশুদ্ধ পানির সংকটে দিশেহারা হয়ে পড়ে দুর্গত এলাকার মানুষ।

এই অবস্থায় দুর্গতদের উদ্ধারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশে সেনাবাহনীর সদস্যরা। সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের নির্দেশে দুর্গত এলাকাগুলোতে সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন তারা। বিশেষ করে, পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের নিরাপদে সরিয়ে আনা, পানিবন্দিদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা, রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন মানুষদের কাছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং বিনামূল্যে চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, ব্রিজ-কালভার্ট ঠিক করে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করতে দিনরাত পরিশ্রম করেন সেনাসদস্যরা।

অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যার পানিতে ডুবে এবং পাহাড় ধসের ঘটনায় কক্সবাজারে ২০ জন, বান্দরবানে ১০ জন এবং রাঙামাটিতে ৬ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভেসে গেছে অনেকের বাড়িঘর, পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে এই অঞ্চলের হাজার হাজার একর জমির শাক-সবজি, আমনসহ অন্যান্য ফসল। রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে এবং ভেঙ্গে গিয়ে এখনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অনেক এলাকা। বিশেষ করে বান্দরবানের রুমা এবং থানচি উপজেলাবাসী ২৯ আগস্ট পর্যন্ত পাওয়া খবরে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছেন। এই দুই উপজেলাবাসী বিদ্যুৎহীন ছিলেন তিন সপ্তাহ ধরে। আগস্ট মাসের শুরুতে অতিবৃষ্টি এবং পাহাড় ধসের কারণে বান্দরবান-রুমা এবং বান্দরবান-থানচি সড়ক ভেঙ্গে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাস্তা দুটির কোথাও কোথাও সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত, কোথাও কোথাও ধসে গিয়ে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা এসব রাস্তা যেখানে সম্ভব মেরামত করছেন, যেখানে মেরামত করা সম্ভব নয় সেখানে বিকল্প রাস্তা তৈরি করে যোগাযোগ স্থাপনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। কেরাণীহাট থেকে বান্দরবান সড়ক পানিতে ডুবে গিয়ে কাদায় পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাস্তার কাদা সরিয়ে এ জেলার সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক করেন।

মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সহকারী পরিচালক রাশেদুল আলম খান জানান, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে বন্যা ও ভূমিধস পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। মোতায়েনকৃত সেনাসদস্যরা নিরলসভাবে উদ্ধার তৎপরতা, জরুরি ত্রাণকার্য পরিচালনা, চিকিৎসা সহায়তা প্রদান ও বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বাত্মক সহায়তা কার্যক্রম চালাচ্ছে।

অপরদিকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত পাওয়া এক খবরে জানা গেছে, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বান্দরবান, রুমা ও আলীকদম সেনা জোনের ১টি করে প্লাটুন সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ি ও বলিপাড়াতে বিজিবি জোনের ১টি করে প্লাটুন সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বান্দরবান সদর উপজেলায় ২ লাখ ৫১ হাজার ৭০০ লিটার সুপেয় পানি, ২ হাজার ১শ’ ৫৯টি পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার, ৮৪২ জনের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করেছে। বান্দরবান সদর, রুমা, বলিপাড়া, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়িতে সেনাবাহিনী ৩ হাজার ৮শ’ ৫১ জনকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও ঔষধ প্রদান করেছে। লামায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১৫টি তাবু, এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বই নষ্ট হওয়ায় ৩৫ সেট বই প্রদান করেছে। আলীকদম উপজেলার ইয়াংচা বাজারের ক্ষতিগ্রস্ত বেইলি ব্রিজটি চলাচলের উপযোগী করতে সেনাবাহিনী কাজ করেছে। সেনাবাহিনীর ১৭ ইসিবি, ২০ ইসিবি এবং ২৬ ইসিবি কর্তৃক বন্যা ও পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাসমূহের মেরামত কাজ চলমান রয়েছে।

অন্যদিকে চট্টগ্রামের লোহাগড়া, সাতকানিয়া উপজেলাসহ কক্সবাজার জেলায় বন্যা দুর্গতদের সহায়তায় সেনাসদস্যদের মোতায়েন করা হয়। তারা পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার ও দুর্গতদের মাঝে খাবার বিতরণ, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পসমূহেও দুর্যোগ মোকাবেলার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল নিরলসভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে।

রাঙামাটির কাপ্তাই, রাজস্থলীসহ যেসব স্থানের মানুষ বন্যাক্রান্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করে সেনাবাহিনী। বাঘাইছড়ি-দীঘিনালা সড়কের দুই টিলা এলাকায় পাহাড় ধসে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে বৃষ্টির মধ্যেই মাটি সরিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী। অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যার কারণে সাজেকে আটকে পড়া কয়েকশ’ পর্যটককে উদ্ধার করে নিরাপদে পৌঁছে দেয় সেনাসদস্যরা।

এবার অতি বৃষ্টিতে খাগড়াছড়ি জেলায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দীঘিনালা উপজেলা। সেখানে পানিবন্দি মানুষদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রীসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ বিতরণ, ফ্রি চিকিৎসা এবং ওষুধ সরবরাহ করেছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এছাড়াও বন্যা পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম এবং মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সেনাবাহিনী চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কার্যক্রমসহ নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।

সোমবার (২১ আগস্ট) রামু সেনানিবাসের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ সেনাসদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। পাশাপাশি যেকোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে দেশের মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যেতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন