পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতার নেপথ্যে ‘চাঁদাবাজি’

fec-image

‘অর্থই অনর্থের মূল’ কথাটি যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় ঠিক মিলে যায়! নানা উৎস থেকে চাঁদাবাজি করে অর্থের পাহাড় গড়তে মরিয়া পাহাড়ের আঞ্চলিক চারটি সংগঠন। টাকার অঙ্কে এ চাঁদাবাজির পরিমাণ বছরে প্রায় ৩৭৫ কোটি টাকা। তাই আধিপত্য বিস্তারে অবৈধ অস্ত্র মজুদ করে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এতে পাহাড়ে ক্রমেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠছে সশস্ত্র অপতৎপরতা। এ চার সংগঠনের বিবাদমান ভাতৃঘাতী সংঘাতে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে।

মূলত চাঁদাবাজি নিরঙ্কুুশ রাখতে এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার, মতের ভিন্নতা আর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন-খারাবি ও অপহরণসহ নানা অপতৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছে এসব সংগঠন। আবার পাল্টা ‘প্রতিশোধ’ নিতেও খুন করা হচ্ছে প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের। চার সংগঠনের সশস্ত্র সংঘাতে তাদের নিজেদের নেতাকর্মী-সমর্থক, জনপ্রতিনিধি, সাধারণ মানুষ, রাজনীতিক, এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও খুনের শিকার হচ্ছেন।

নিজেদের নিয়ন্ত্রণে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র থাকায় যে কোনো সময়েই প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের হত্যা করা ‘মামুলি বিষয়’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বগোত্রের অস্ত্রধারীদের হাতে পাহাড়ি লোকজন ‘টার্গেট কিলিং’-এর শিকার হচ্ছেন। এতে আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। নিরাপত্তার অভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দুই জেলার পর্যটন ব্যবসার খাতেও। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি আর আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন তথ্য।

অবশ্য এসব হত্যাকাণ্ডে নিয়ম করে আঞ্চলিক দলগুলো পরস্পরকে দোষারোপ আর দায় অস্বীকার করে চলছে। আর এখন পর্যন্ত কোনো হত্যাকাণ্ডেরই বিচার না পাওয়ায় মামলা দায়ের করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন স্বজনরাও। তবে এই অশুভ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ চান পাহাড়ের মানুষ। পুলিশ বলছে, শুধু সাজা দিয়ে খুনোখুনি বন্ধ হবে না। সম্প্রীতির মাধ্যমে শান্তি ফিরতে পারে। এ জন্য সামাজিক প্রতিশ্রুতি দরকার।

অভিযোগ আছে, পাহাড়ে উন্নয়ন প্রকল্প, ঠিকাদার, কাঠ-বাঁশ ব্যবসা, পরিবহন, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, চাষাবাদ-ফসল, পোষাপ্রাণী বিক্রি, চোরাকারবারি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, মাদক, অস্ত্র ব্যবসাসহ নানা উৎস থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় চাঁদাবাজি করে আসছে আঞ্চলিক দলগুলো। যদিও এসব অভিযোগ স্বীকার করে না কোনো সংগঠনই। এসবের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা আর আধিপত্য বিস্তারে নির্বিচারে একের পর এক খুন ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় অস্থির হয়ে উঠেছে পাহাড়ের পরিস্থিতি।

‘পাহাড়ের মানুষের অধিকার আদায়’ আর চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের ‘দৃশ্যমান দাবি’র আড়ালে পাহাড়ে এখন সক্রিয় চারটি আঞ্চলিক সংগঠন সশস্ত্র তৎপরতার লিপ্ত। প্রধান দুই সংগঠন সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও প্রসীত খীসার ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) এবং সংস্কারপন্থি অপর দুই সংগঠন জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দুটি আলাদা ‘জোট’ করে সংঘাতে জড়িয়ে আছে। এই দুই জোটের দ্বন্দ্ব আর ‘পথের কাঁটা’ সরানোর প্রতিযোগিতায় ‘টার্গেট কিলিং’-এ লাশের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আঞ্চলিক দলগুলোর সংঘাতে ২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত গত ৭ বছরে পাহাড়ি তিন জেলায় খুন হয়েছেন ৩৮৩ জন। এর মধ্যে ২৬৩ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আর ১২০ জন বাঙালি। এ ছাড়া অপহরণের শিকার হওয়া ৫৪০ জনের মধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৩৭১ জন ও বাঙালি ১৬৯ জন। চাঁদাবাজিও হচ্ছে বছরে প্রায় ৩৭৫ কোটি টাকা।

গত এক বছরেই খুন হয়েছেন ২৬ জন। এ সময়ে সাজেক ও রাজস্থলীতে সেনাটহলে পৃথক দুই হামলার ঘটনায় রাজস্থলীতে এক সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বাঘাইছড়িতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) সরকারি কার্যালয়ে ঢুকে ইউপি সদস্য জেএসএস সংস্কার নেতা সমর বিজয় চাকমাকে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা।

সর্বশেষ রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়িতে উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার কার্যালয়ে ঢুকে ইউপি মেম্বারকে গুলি করে হত্যা করেছে জেএসএস (সন্তু) দলের সন্ত্রাসীরা। নিহত ইউপি মেম্বারের নাম সমর বিজয় চাকমা (৩৮)। গত বুধবার দুপুর পৌনে একটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সূত্র জানায় নিহত সমর বিজয় চাকমা জেএসএস (এমএন লারমা) দলের সমর্থক ছিলেন। প্রতিপক্ষ দলের হওয়ার কারণে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দিতে হয় তাকে।

আলোচিত খুন: ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনী কর্মকর্তাদের গাড়িবহরে হামলায় দুই পোলিং অফিসারসহ ৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। পুলিশসহ ৩১ জন আহত হয়েছেন। এর আগে ২০১৮ সালের ৩ মে নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ কার্যালয় প্রাঙ্গণে উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস (এমএন লারমা) দলের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হয়। পরদিন তার শেষকৃত্যে যোগ দিতে আসা গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা বর্মাসহ ব্রাশফায়ারে ৬ হত্যাকাণ্ড এবং ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ি শহরে ব্রাশফায়ারে ৭ জনকে হত্যার ঘটনা পাহাড়ের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনায় স্থান পায়।

ব্যাপক আলোচনা আছে যে, খুন-খারাবির মধ্যেও বছর তিনেক ‘সমঝোতা শান্তি’র প্রক্রিয়া চালায় পাহাড়ের তিন আঞ্চলিক সংগঠন সন্তু লারমার জেএসএস, প্রসীত খীসার ইউপিডিএফ ও জেএসএস সংস্কার (এমএন লারমা)। কিন্তু ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’ নামের আরেক আঞ্চলিক পাহাড়ি সংগঠনের আত্মপ্রকাশের পর এই ‘শান্তি’তে ছেদ পড়ে। অভিযোগ ওঠে সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের মাত্র ১৮ দিনের মাথায় ৫ ডিসেম্বর রাঙামাটির নানিয়ারচরে এক ইউপিডিএফ নেতাকে খুন করলে পাহাড়ে ফের খুনখারাবি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

পাহাড়ের এমন পরিস্থিতির জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়াকে ‘কারণ’ বলে বিভিন্ন সময় দাবি করে আসছে চুক্তি সম্পাদনকারী দল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। ‘চুক্তি’ যথাযথ বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক ও অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে।

শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, ‘কোনো মৃত্যুই কাম্য হতে পারে না। পাহাড়ের মানুষ শান্তি চায়। চাঁদাবাজির কথা সবাই জানে। এই চাঁদাবাজি বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা, দলগুলোর মধ্যে বিভাজন-হতাশা থেকেই এখানকার পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। সংঘাত বাড়ছে। রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে আরও চিন্তাভাবনা করতে হবে। মূল কারণটা কোথায়; অ্যাড্রেস করতে হবে।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, ‘সন্তু লারমা নিজেই চুক্তি ভঙ্গ করেছেন। ১৯৯৮ সালে তার দল অস্ত্র জমা দেওয়ার পরও পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র থাকে কী করে? এখন চারটি সশস্ত্র আঞ্চলিক দলের অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার, খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজিতে অস্থির পার্বত্য চট্টগ্রাম। পাহাড়ে যৌথবাহিনীর অভিযান দিতে হবে।’

খাগড়াছড়ি সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী বলেন, ‘পাহাড়ের অর্থই অনর্থের মূল। নানা উৎস থেকে চাঁদাবাজি করে অর্থের পাহাড় গড়তে মরিয়া আঞ্চলিক দলগুলো। তাই আধিপত্য বিস্তারে অবৈধ অস্ত্র মজুদ করে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে তারা। পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পাহাড়ে চিরুনি অভিযান ও প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) মো. ছুফি উল্লাহ শনিবার দুপুরে নিজের কার্যালয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পাহাড়ে চাঁদাবাজির বিষয়টি সবাই জানলেও কেউ লিখিত অভিযোগ করে না। অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে খুনোখুনি হচ্ছে। সম্প্রীতির মাধ্যমে শান্তি ফিরতে পারে। এজন্য সামাজিক প্রতিশ্রুতি দরকার। শুধু সাজা দিয়ে হবে না।’ ‘বিশেষ ভূ-প্রকৃতি, দুর্গমতা ও পুলিশের পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকার কারণে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় নেওয়া যায় না। তবে অপরাধীদের গ্রেপ্তারে যৌথবাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে’ বলে যোগ করেন এই কর্মকর্তা।

সূত্র: আমাদের সময়

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: চাঁদাবাজি, পাহাড়, সশস্ত্র
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন