parbattanews

পাহাড় নিয়ে পরিবেশিত সংবাদে বিশভাগ সত্য উঠে আসে আশি ভাগ মিথ্যা

কাঠ পাচার

ইমান খান:

আমতলী ইউনিয়ন থেকে যখন একটু এগিয়ে পাহাড়ি জনপদে ঢুকে বন পর্যবেক্ষণে যেতে চাই- তখন প্রথম বাধাটা পেলাম, হাতে ছিল ক্যামেরা, লোক ছিলাম ৩ জন সর্বোচ্চ- পাহাড়ি পাড়ার মাতবর ধরণের এক লোককে বেশ পরিস্কারভাবেই জানালাম, বন পর্যবেক্ষণে যেতে চাই আমরা- একটি বেসরকারী সংস্থার হয়ে পাবলাখালী অভয়রাণ্য পর্যবেক্ষণে এসেছি- পাহাড়িরা জানিয়ে দিল- “যাওয়া যাবে না, এখন নিজেরা বেশি জোর থাকলে পারলে যান”।

আমাদের সাথে গাইড হিসেবে ছিল আমতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ রাসেল চৌধুরী ভাইয়ের দফাদার সাহেব। তিনি জানালেন- যেহেতু পাহাড়িরা যেতে দিতে চাচ্ছে না, তাহলে না যাওয়াটাই উত্তম।

প্রশ্নঃ আমার দেশের কোথাও কেন আমার চলাচল আটকাবে এদেশরই আরেক ধাঁচের মানুষ?

তো ফিরে আসলাম আবার আমতলী বাজারে, রাংগা পাহাড় এরিয়া হয়ে একটু ঘুরে আসতে চাই চাই ভেতরের দিকের পাহাড়ী জনপদে। মোটরসাইকেল ড্রাইভার ঠিক করলাম, তিনিও পাহাড়ি- উদ্দেশ্য কিছু ছবি তোলা আর কি আর বনের কন্ডিশন দেখা।

ডন নামের এক লোক আমাদের ঠিক করা ড্রাইভারকে বলল, “এদের নিয়ে যাচ্ছ এলাকার ভেতর, নিজের এলাকায় থাকার ইচ্ছা আছে নাকি?” এসব তারা বলছিল নিজেদের ভাষায়, দফাদার আমাকে বংগানুবাদ করে দিচ্ছিলেন…

আমার মোটর সাইকেলওয়ালা অল্প-বয়স্ক পাহাড়ী ছেলেটা ঘাবড়ে প্রথমে বলে দেয় যে সে আর যেতে পারছে না। কিন্তু আমাদের অভয় দানের পর সে যাত্রা শুরু করল…

রাঙ্গা পাহাড় হয়ে আমতলী পার হয়ে যখন পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় এসে পৌঁছালাম, এর ভেতর স্থানীয় পাহাড়ি জনপদের মানুষ (বেশ আধুনিক গ্রাম বলা চলে) আমাদের পথ আটকালো দু’ দু’ বার।

কোথায় যাচ্ছি কি করতে যাচ্ছি সব জিজ্ঞাসা করল।
বেশ, ভাল লাগল নিজের দেশের ভেতরেই এমন জেরার স্বীকার হয়ে, মেনে নিলাম।

বন কিন্তু আর দেখা হয় নি আমাদের। আমাদের কাছে অভিযোগ ছিল সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অভয়ারাণ্য পাবলাখালিতে অবাধে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, আর সাবাড় করে দেয়া হচ্ছে সব বন্যপ্রাণী।

তো অনুসন্ধানে নেমে পড়লাম মাইনী বাজার থেকেই। এমন এক তথ্যের মুখোমুখী হলাম যে রীতিমত ভয়ংকর!বেশ কিছুদিন আগেও মাইনীর হাটে নাকি শজারু মেরে বিক্রি করা হয়েছে! যারা এসব খেয়ে অভ্যস্ত- তারাই করে এমন কাজ- অনুসন্ধানে জানতে পারলাম।

আরো গভীরে যেতে চাইলাম, আচ্ছা পরিসংখ্যান অনুযায়ী পাবলাখালী অভয়রাণ্যে তো অনেক কিছুই থাকবার কথা বন্যপ্রাণী এগুলো কই? মাঠে নেমে তেমন কিছুই পেলাম না- সব খেয়ে সাবাড় করা শেষ! এগুলো কি বায়োডাইভার্সিটির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়? এজন্যই কি আমাদেরকে গহীন বনে ঢুকতে দেয়া হয় নি?

আমাদের কে কি এজন্যই বনে ঢুকতে দেয়া হয় নি যাতে নিজের চোখেই দেখতে পাই যে কিভাবে গোটা একটা পাহাড়ের গাছ-পালাকে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বিশেষ কায়দায় জুম চাষের জন্য? হ্যা, এখানে প্রশ্ন আসতে পারে- পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর অবলম্বনের উপায় এটি। তাহলে প্রশাসন কেন পরিবেশ সংরক্ষণে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না?

চলে গেলাম পাবলাখালি সংরক্ষিত অভয়ারাণ্যের প্রধাণ বন কর্মকর্তার কাছে, নবাবে-আলম পাবলাখালি মাঝে মাঝে আসেন। বাকিটা সময় নাকি রাংগামাটি শহরেই কাটিয়ে দেন বউ-বাচ্চা-বন্ধু-বান্ধব নিয়ে! কি আর করার, বন দেখাতো হল না, ভগ্ন হৃদয়ে সন্ধ্যায় আমতলী বাজারে বিশাল এক আড্ডায় বসলাম।

আড্ডায় সব মুরুব্বীগণ যাদের জন্মই সেখানে!  কথায় কথায় জানলাম- বাঘাইছড়ী উপজেলা ডজনখানেক ইউনিয়নের ভেতর শুধু আমতলীই বাংগালী অধ্যুষিত, লাংদুতেও অধিকাংশ পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকা।

তাদের প্রশ্ন করলাম, আমরা তো পাহাড়ী এলাকায় ঢুকতে গিয়ে বেশ বাধার সম্মুখীন হলাম- পাহাড়ীরাও কি একি সমস্যায় পড়ে?

এক চাচা বললেন, “বাজান পিছনে তাকায় দেখেন, বাজারে যারাই আছেন সবাই পাহাড়ী”। খেয়াল করলাম, সত্য, অধিকাংশই পাহাড়ি জনগণ! তাহলে বাঙালীদের কেন এত ঘাট পেরোতে হবে তাদের এলাকাগুলো ভ্রমণে গেলে? মজার বিষয় এমন না যে পর্যটক গিয়ে এসব এলাকা ব্যাপক উৎপাত করে! বাস্তবতা হল মারিষ্যা থেকে পাবলাখালি যাতায়ত এতটাই দুর্গম যে বছরে ১০০ মানুষও আসেন বেড়াতে এখানে!

ভাল কথা, পরের দিন আবার ঘুরতে গেলাম আমতলীর আশেপাশের এলাকা। একটা বিষয় লক্ষ করলাম, পাহাড়ী আর বাঙালি এলাকার ভেতর একটা ব্যবধান আছে। দফাদারকে প্রশ্ন করলাম- ব্যবধান যখন আছে তখন গোলযোগের সূত্রপাত হয় কিভাবে? তার ভাষমতে জানলাম মোটামুটি দুই জনপদই সুযোগ পেলে সীমানারেখা অতিক্রম করে নতুন জমিতে বাড়ি-ঘর বানিয়ে বসিয়ে রাখতে চায়।

একজন ভ্যানওয়ালার সাথে কথা বললাম ফিরতে ফিরতে। বেশ কষ্ট নিয়ে কিছু কথা জানাল।
তার মতে, পাহাড়িদের কোন সমস্যা হলেই সেটা যথেষ্ট প্রচার পায়, জাতীয় দৈনিক ফলাও করে ছাপে-

কই বাঙালীরা যে নিজের দেশে ইউপিডিএফ মত সংগঠনকে চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করছে এটা কি কখনো আসে খবরে? বাঙালীরা যে পাহাড়ে পদে পদে বঞ্ছিত হচ্ছে এই খবরটা কি আসে খবরে? কিছুক্ষণ ভাবলাম, আমি আগে পাহাড়ী জনপদের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিলাম। তার কথা সত্য না মিথ্যা এটা জানি না তবে যেটা বুঝলাম- নানা কারণে পাহাড়ে বাংগালীদের ভেতর ক্ষোভ জমে আছে। আর যখনই কোন দাংগা শুরু হয় তখন সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়!

কথা কি সত্য নয়? বাঙালী পাহাড়ে গিয়ে বসবাস করে বলে কি আমরা তাদের মৌলিক অধিকারগুলোর দিকে খেয়াল রাখব না?

রাতে ফিরে ফরেস্ট বাংলোর দারোয়ানের সাথে আলাপ করলাম-
সেই শান্তি চুক্তি আগে কেমন ছিল?

গা শিউরে উঠল কিছু তথ্য পেয়ে- শান্তিচুক্তির আগে অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে তখন বাড়িতে বাড়িতে বাংকার থাকত! দু-পক্ষের গোলাগুলি থেকে বাঁচতে মানুষ মাটির ঘরেই নিজেদের বানানো বাংকারে রাত কাটাত!  চাচাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আর্মির উপস্থিতি কিভাবে দেখেন?”

উত্তরটা অনুমেয় ছিল, তারপর এতটা তীব্র হবে আশা করি নি। তার ভাষ্যে, পাহাড়ে যদি সেনাবাহিনী না থাকত তাহলে বাঙাদের জবাই করে ফেলা হত! ভেবেই আমার গা শিউরে উঠল!

তিনি একটা উদাহরণ টানলেন সেনা ক্যাম্পের প্রয়োজনীয়তার। মারিষ্যা বাজার এলাকা পুরোটাই বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপদের প্রভাব। যদি এখানে সেনা ক্যাম্প না থাকত তাহলে প্রতিদিনি লুটতরাজ চলত!

হতে পারে তিনি সেনা-সমর্থক, তাই একি ভাষ্য নিতে গেলাম আর কয়েকজনের কাছে- সবার বক্তব্য মোটামুটি একই রকম!

আহারে সেলুকাস দেশ, যে মানুষগুলো আপনারই দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা দিচ্ছে কিছু আতঙ্কবাদী আক্রমণ থেকে। তাকেই আপনি দিনে রাতে চৌদ্দ বার অনলাইনে বসে ধুয়ে দিচ্ছেন!

তো পুরো যাত্রায় পাহাড়িদের কারো কাছ থেকে মুদ্রা উল্টোপিঠের অভিযোগ শুনবার চেষ্টা করলাম-
তাদের বক্তব্য বোঝবার চেষ্টা করলাম। জানবার চেষ্টা করলাম বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গী।

মজার ব্যাপার হল কারো কাছ থেকেই তেমন ভাল রিসেপশন পাই নি, কাপ্তাই গিয়েছি, সেখানকার পাহাড়িরা মাটির মানুষ! কিন্তু পাবলাখলিতে এসে যে মারমুখি স্বভাব দেখলাম- আমি আতঙ্কিত না হয়ে পারলাম না!

“বাংলাদেশ” এই আইডিওলজিটার উপর হয় তারা কম আস্থা রাখে বা তাদের ধারণা কম। কারণ কি হতে পারে তা জানবার-বুঝবার চেষ্টা করলাম, যথাযথ কারণ খুঁজে পেলাম না।

তারা কি প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত হয়? তারা কি সুবিধাবঞ্চিত?

আরামসে কোটায় পড়াশুনা করে নিজেদের বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বড় এক গোষ্ঠী,  কালে-ভাদ্রে দু একটা দাঙ্গা বাঁধছে- যেখানে উভয় পক্ষের দোষ থাকছে।

তাই বলে এত ক্ষোভ কেন?
হ্যা, এত ক্ষোভ হয় যখন আপনি কোন কিছুকে আপন করে নিতে না পারেন, আর নিজের গোঁড়ামিতেই বসে থাকেন!

প্রায় সপ্তাহ দুয়েক এর মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ তুলে আনলাম। আমার কোন দাতা সংস্থা থেকে টাকা কামানোর ধান্দা নেই যে রং মিশিয়ে তথ্য উপস্থাপন করব। সরি সুশীল সমাজ, বুদ্ধি প্রতিবন্ধীর মত এভাবে কপি-পেস্টের তথ্যে না কান্নাকাটি করে মাঠে গিয়ে দেখে আসুন ঘটনার পিছে কি দায়ী? আর অবশ্যই মাথায় রাখবেন, বাঙালীরাও এদেশের, পাহাড়ীরাও এদেশের।

পুলিতজারের লোভে এক পক্ষের ঢোল পিটিয়ে গেলে একসময় হাসির পাত্র পরিণত হবেন। আর পাহাড়ের পরিবেশিত সংবাদগুলোর ব্যাপারে যেটা বলব, ২০% সত্য উঠে আসে আর বাকি ৮০% মিথ্যা।

এ যেন আরেক হুজুগে ক্যাম্পেইন! কাল এক সংবাদ দেখলাম লঙ্গদুর দাঙ্গার যেখানে ছবি হিসেবে একটা পত্রিকা যেটা ব্যবহার করেছে সেটা আসলে টাংগাইলের এক দুর্ঘটনার চিত্র! হাতে-নাতেই ধরা!

এত বড় আলোচনায় কি বুঝলেন?  সবসময় ছবি সত্য কথা বলে না। আর পাহাড়িদের প্রতি যদি অন্যায় হয়ে থাকে- তাহলে সেটা তারা বাংলাদেশের আদালত থেকেই ন্যায়বিচার পাবেন। মিয়ানমারে গিয়ে না!

বাংলাদেশকে ভালবাসুন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা করুন। সাংবিধানিকভাবে দেশের নাগরিকরা যে কোন প্রান্তে বৈধভাবে বসবাসের অধিকার রাখে, সেটেলার এদেশে আপনাদের মুখে আর শুনতে চাই না যদি আপনারা আপামর জনতার সমর্থন চান!

ধন্যবাদ জ্ঞাপন করব আমতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী ভাইকে যিনি অনেক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন সত্য অনুসন্ধানের! প্রকৃত সত্য জানতে হলে ঘটনাস্থলে যান- বেইলিরোডে চিকেন চাবাতে চাবাতে স্ট্যাটাস দিয়ে লাইক কামানো বন্ধ করুন।


সূত্র: সাইবার ৭১ ফেসবুক পেইজ থেকে। ছবি: লেখক।

 

Exit mobile version