প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য খাগড়াছড়ির পর্যটন সম্ভাবনা : সমস্যা ও করণীয়


বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা তার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যময় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতির জন্য সুপরিচিত। পাহাড়, ঝরনা, ঝিরিপথ, উপত্যকা ও সমতলের এক অনবদ্য মিশেলে গঠিত এই জনপদ যেন প্রকৃতির তুলির আঁচড়ে আঁকা এক জীবন্ত ক্যানভাস। শুধু নিজ রূপেই উজ্জ্বল নয়, খাগড়াছড়ি রাঙামাটির জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র সাজেক ভ্যালির প্রবেশদ্বার হিসেবেও পরিচিত।
আলুটিলা গুহা, রিসাং ও সিন্দুকছড়ি ঝরনা, দৃষ্টিনন্দন চেংগী নদীসহ শতাধিক প্রাকৃতিক আকর্ষণ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে। সাজেকগামী আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর ঘন মেঘের রাজ্য প্রায়শই এক কল্পলোকের অনুভূতি এনে দেয়, যা যেকোনো ভ্রমণপিপাসুকে আবিষ্ট করে রাখে।
ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি-
দাপ্তরিকভাবে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা (Khagrachari Hill District) নামে পরিচিত এই অঞ্চলটি ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, দক্ষিণে চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি জেলা, পূর্বে রাঙ্গামাটি জেলা ও ভারতের মিজোরাম রাজ্য এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলা। প্রায় ২৭০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই জেলা তার প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য দেশের মানচিত্রে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী খাগড়াছড়ি জেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭,৩৮,৯৭৪ জন। এই জেলার সামাজিক বুনন অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি এখানে ত্রিপুরা, চাকমা, ওমারমা এই তিনটি প্রধান সম্প্রদায়ের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তাদের নিজস্ব ভাষা, পোশাক, লোকাচার এবং উৎসব এই অঞ্চলের সংস্কৃতিতে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে, যা পর্যটকদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতার দ্বার খুলে দেয়। প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিম, বৌদ্ধ, হিন্দু এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা উল্লেখযোগ্য, তবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। এই সাংস্কৃতিক সহাবস্থান খাগড়াছড়িকে পর্যটকদের কাছে শুধু একটি প্রাকৃতিক গন্তব্য নয়, বরং এক জীবন্ত সাংস্কৃতিক যাদুঘর হিসেবে উপস্থাপন করে।
বর্তমান পর্যটন আকর্ষণ
• আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র: খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে আলুটিলা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই কেন্দ্রটি তার গা ছমছমে গুহা এবং নৈসর্গিক দৃশ্যের জন্য বিখ্যাত।
• খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ হর্টিকালচার পার্ক: খাগড়াছড়ি জেলার জিরো পয়েন্ট থেকে ৩ কি.মি দূরে অবস্থিত এই সবুজ বেষ্টনীতে ঘেরা মনোরম পার্কটি শহরের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত ।
• রিছাং ঝরনা: মাটিরাঙ্গা উপজেলায় অবস্থিত এই ঝরনাটি সদর থেকে প্রায় ১০ কিমি দূরে। এর শীতল জলধারায় শরীর জুড়িয়ে নিতে পারেন পর্যটকরা। ।
• মায়াবিনী লেক: খাগড়াছড়ি জেলায় পানছড়ি উপজেলার ভাইবোনছড়ার কংচাইরি পাড়ায় ৪০ একর জায়গার মাঝে ১৫ একর নিয়ে অবস্থিত এই লেকটি কায়াকিং এবং বোটিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
• রামগড় চা বাগান: সীমান্ত শহর রামগড়ের প্রবেশদ্বারেই রয়েছে সুবিশাল এই চা বাগান। এটি ফটিকছড়ি উপজেলার অধীনে হলেও রামগড় চা বাগান নামেই পরিচিত।
• মাটিরাঙ্গার আলুটিলা শতবর্ষী বটবৃক্ষ: মাটিরাঙ্গা উপজেলার ১নং ওয়ার্ডে, আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের কাছে এই বিশাল বটবৃক্ষটি ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
• খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র: খাগড়াছড়ি সদরে অবস্থিত এই কেন্দ্রটি কৃষি পর্যটনের জন্য একটি সম্ভাবনাময় স্থান, যেখানে বিভিন্ন পাহাড়ি ফসল সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
• মানিকছড়ি মং রাজবাড়ী: খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে মানিকছড়ি উপজেলায় অবস্থিত এই ঐতিহাসিক স্থানটি প্রাচীন মং রাজপরিবারের আবাসস্থল ছিল।
• মানিকছড়ি শতবর্ষী মহামুনি বৌদ্ধবিহার: মানিকছড়ির এই বিহারটি প্রায় একশ বছরের পুরনো এবং এখানে একটি প্রায় ৫ ফুট লম্বা ও ৩ ফুট চওড়া বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে।
• মানিকছড়ি ডিসি অ্যাডভেঞ্চার এন্ড ইকো-ট্যুরিজম পার্ক: ডলু মৌজা, মানিকছড়ি উপজেলায় ১৬০ একর জায়গার উপর অবস্থিত এই পার্কটি সবুজ অরণ্য আর জলাশয় ঘেরা। তিনটি দৃষ্টিনন্দন লেক এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে।এবছর (২০২৫ এ) জাতীয় পর্যায়ে এই পার্কটি বৃক্ষ রোপনে শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার অর্জন করেছে।
• অরণ্য কুটির: খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলায় শান্তিপুর নামক এক স্থানে ১৮০ একর জমির ওপর বিশাল এলাকাজুড়ে অরণ্যে আবৃত এই কুটিরটি অবস্থিত।
• দেবতা পুকুর / মাতাই পুখিরি: খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি রোডে নুনছড়ি নামক এক স্থানে খাগড়াছড়ি সদর হতে ১২ কি.মি ও মাইসছড়ি হতে ৪ কি.মি দূরে অবস্থিত
• বিডিআর স্মৃতিসৌধ: বিডিআর এর জন্ম সম্পর্কিত ঐতিহাসিক স্থানটি রামগড় উপজেলা পরিষদের পাশে ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত।
• তৈদু ছড়া ঝর্ণা / আলমগীর টিলা ঝরনা: এটি খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে তৈদু ছড়া ঝর্ণা নামেও পরিচিত। এর দুর্গম পথ অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের জন্য দারুণ চ্যালেঞ্জ।
• ধুমনীঘাট ঝর্ণা: খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলা শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পাহাড়বেষ্টিত দুর্গম এলাকা ধুমনীঘাট এককথায় অপরূপ। কথিত আছে– রাম, সীতা ও লক্ষ্মণের বনবাসকালীন একটি অংশ এখানে কেটেছিল। স্থানীয়দের মতে, পাথরের ওপরে এখনও সীতার পায়ের ছাপ, রাম ও লক্ষ্মণের বসার পাথর, শিবলিঙ্গসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক স্থাপনা দেখা যায়।
• সিন্দুকছড়ি-মহালছড়ি সড়ক: খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি-সিন্দুকছড়ি-জালিয়াপাড়া সড়ক ভ্রমণপিপাসুদের জন্য একটি নতুন আকর্ষণীয় স্থান। মহালছড়ি-সিন্দুকছড়ির আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পাহাড়ি রাস্তাগুলোর একটা।
• পানছড়ি রাবার ড্যাম: পানছড়ি উপজেলার শান্তিপুর এলাকায় চেঙ্গী নদীর উপর নির্মিত এই বাঁধটি একটি দর্শনীয় স্থান। এর আশেপাশে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ রয়েছে।
• মাটিরাঙ্গা উপজেলার ভগবান টিলা: মাটরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দং সীমান্তে অবস্থিত ভগবান টিলা। সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় এক হাজার ৬শ’ ফুট উচুতে অবস্থিত এ টিলা নিয়ে জনশ্রুতি আছে, এত উচু টিলায় দাঁড়িয়ে ডাক দিলে স্বয়ং স্রষ্টাও শুনতে পাবেন।
সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র:
• হাতির মাথা বা স্বর্গের সিঁড়ি: এই স্থানগুলো তাদের প্রাকৃতিক গঠনের জন্য পরিচিতি লাভ করতে পারে।
• পঙ্গীমুরা ধমনী ঘাট ঝর্ণা: আরও কিছু অনাবিষ্কৃত ঝরনা, যা ট্র্যাকিং ও অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের জন্য উপযুক্ত।
• মাটিরাঙ্গা উপজেলা লামাপাড়া (মিনি সাজেক): সাজেকের মতো পরিবেশ উপভোগের জন্য এটি একটি বিকল্প হতে পারে।
• রামগড় সীমান্ত সড়ক: সীমান্ত সংলগ্ন এই সড়কটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত হতে পারে।
• আইবিএম ইনোভেশন হাব, মাটিরাঙ্গা: এটি একটি আধুনিক আকর্ষণ হতে পারে, যা প্রযুক্তি এবং পর্যটনের সমন্বয় ঘটাবে।
• হাজাছড়া ঝর্ণা: স্থানীয়ভাবে পরিচিত হলেও এখনো পর্যটকদের কাছে ততটা জনপ্রিয় নয়, এমন ঝরনাগুলো আবিষ্কারের অপেক্ষায়।
• চেংগী নদীর পাড়ের সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা: নদীর পাড়কে কেন্দ্র করে পরিবেশবান্ধব পর্যটন গড়ে তোলা সম্ভব।
• খাগড়াছড়ি সদরের নিউজিল্যান্ড রোড: এর নৈসর্গিক দৃশ্যের কারণে এই নামটি প্রচলিত, যা পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে।
• খাগড়াছড়ি সদরের প্রস্তাবিত ডিসি পার্ক: এটি শহরের নিকটবর্তী হওয়ায় স্থানীয় ও বাইরের পর্যটকদের জন্য একটি বিনোদন কেন্দ্র হতে পারে।
• মাটিরাঙ্গা উপজেলা জল পাহাড়: জল ও পাহাড়ের সমন্বয়ে গঠিত এই স্থানটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা দেবে।
• তৈদু ছড়া কুঞ্জ ঝর্ণা: আরও একটি ঝরনা যা অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য উপযুক্ত।
• ধর্মপুর আর্য বন বিহার: এটি ধর্মীয় পর্যটনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
এছাড়াও গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে-
• ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গ্রাম ও জীবনযাত্রা পর্যটন: সাজেকগামী রাস্তার আশেপাশে বা দুর্গম এলাকায়, যেখানে ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী জীবনযাত্রা, পোশাক, খাবার, হস্তশিল্প এবং উৎসব সরাসরি উপভোগ করা যেতে পারে (যেমন: পানছড়ি, দীঘিনালা, মাটিরাঙ্গা ও মহালছড়ি উপজেলার কিছু প্রত্যন্ত গ্রাম)।
• দুর্গম পাহাড়ি ঝরনা ও ট্র্যাকিং রুট: চেঙ্গি, মাইনী, মাতামুহুরী নদীর উৎসস্থলের আশেপাশে বা গভীর অরণ্যে অবস্থিত অপ্রচলিত ঝরনা ও পাহাড়ি পথে (যেমন: দীঘিনালা ও পানছড়ি উপজেলার আরও গভীর বনাঞ্চলে) অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম, স্থানীয় গাইড দ্বারা পরিচালিত ট্র্যাকিং এবং ইকো-ক্যাম্পিংয়ের সুযোগ রয়েছে। এটি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটকদের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
• ঐতিহ্যবাহী বাজার ও মেলা: স্থানীয় হাট-বাজার যেখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পণ্য, কৃষিজাত দ্রব্য, হস্তশিল্প ও পোশাক বিক্রি হয় (যেমন: মহালছড়ি বাজার, মানিকছড়ি বাজার বা সাপ্তাহিক গ্রামীণ হাট) স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে পরিচিতি, স্থানীয় পণ্য ক্রয় এবং ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ করে দেবে।
• কৃষি পর্যটন: আনারস, আম, কাঁঠাল, লিচু, কলা ও বিভিন্ন সবজির বাগান (বিশেষত মাটিরাঙ্গা, রামগড় ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার কৃষি প্রধান এলাকা) পরিদর্শন, ফল সংগ্রহ এবং স্থানীয় কৃষিকাজ সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য উপযুক্ত।
পর্যটন বিকাশে সমস্যা
• যোগাযোগ ও অবকাঠামো: দুর্গম এলাকায় যাতায়াতের জন্য অনুন্নত সড়ক ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত ও মানসম্মত যানবাহনের অভাব পর্যটকদের জন্য একটি বড় সমস্যা।
• নিরাপত্তা: পার্বত্য অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি মাঝে মাঝে পর্যটকদের মনে ভীতি তৈরি করে। যদিও পরিস্থিতি বর্তমানে অনেক ভালো, তবুও পর্যটকদের মনে এই বিষয়ে উদ্বেগ থাকে।
• আবাসন ও খাবার: পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে মানসম্মত ও পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পর্যটকদের জন্য বাজেট-ফ্রেন্ডলি হোটেলের অভাব রয়েছে।
• সক্ষমতার অভাব: স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে পর্যটন সেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাব রয়েছে।
• প্রচারণা ও বিপণন: দেশের অন্যান্য জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রের তুলনায় খাগড়াছড়ির পর্যাপ্ত ও কার্যকর প্রচারণা ও বিপণনের অভাব রয়েছে।
• পরিবেশগত সচেতনতা: পর্যটকদের মধ্যে পরিবেশ দূষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এর ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
• পরিকল্পনাহীন পর্যটন উন্নয়ন: অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন বিকাশের ফলে স্থানীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
• অনুমতি ও বিধিনিষেধ: পার্বত্য অঞ্চলের কিছু এলাকায় ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি প্রক্রিয়া পর্যটকদের জন্য জটিল হতে পারে।
সমাধানে করণীয়:
• যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন: পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সংযোগকারী সড়কসমূহের উন্নয়ন ও সংস্কার প্রয়োজন। স্থানীয় পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা যেমন: স্থানীয় জিপ, মাহিন্দ্রা, অটোরিকশা চালু করা যেতে পারে।
• নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ: পর্যটকদের জন্য নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করতে ট্যুরিস্ট পুলিশ ও স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত টহল ও নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। কমিউনিটি ভিত্তিক পর্যটনের বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত রাখা এবং সমন্বয় সাধন করা জরুরি।
• স্বাস্থ্যবিধি ও খাবার ব্যবস্থাপনা: খাদ্য ও পানীয় তৈরি ও পরিবেশনায় স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ নিশ্চিতকরণে জোর দিতে হবে। স্থানীয় ও ঐতিহ্যবাহী খাবারের তালিকা প্রস্তুত ও অনলাইনে প্রকাশ করা যেতে পারে। রন্ধন শিল্প, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে খাদ্য প্রস্তুত, পরিবেশন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
• সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উদ্যোক্তা তৈরি: পর্যটন বিষয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন (পর্যটন গাইড, হোম-স্টে পরিচালনা, হস্তশিল্প তৈরি, ভাষা শিক্ষা) করতে হবে। ক্ষুদ্র ঋণ ও উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের স্যুভেনির উৎপাদনে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
• প্রচারণা ও বিপণন কৌশল: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম (ওয়েবসাইট, অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি, ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল) ব্যবহার করে খাগড়াছড়ির পর্যটন আকর্ষণ ও প্রচার করতে হবে। ট্রাভেল ব্লগ, ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং এবং টিভিসি/পোস্টার ব্যবহার করে ব্যাপক প্রচারণা চালানো যেতে পারে। জাতীয় পর্যটন ক্যাম্পেইন এবং ট্যুর অপারেটরদের সাথে সমন্বয় সাধন এবং বিভিন্ন পর্যটন মেলায় খাগড়াছড়ির স্টল স্থাপন করা যেতে পারে।
• টেকসই পর্যটন ও পরিবেশ সংরক্ষণ: পর্যটকদের জন্য দায়িত্বশীল আচরণবিধি গাইডলাইন প্রস্তুত ও অবহিতকরণ করা উচিত। গন্তব্যের ধারণ ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে পর্যটকদের সংখ্যা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি ও শক্তির অপচয় রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
• কমিটি গঠন ও সমন্বয়: একটি জেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই কমিটি কমিউনিটি ভিত্তিক পর্যটন বিকাশের জন্য সম্ভাব্য স্থান চিহ্নিত করবে, জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব চিহ্নিত করে সমাধানের পথ দেখাবে। স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অংশীজন, স্থানীয় কমিউনিটি, সাংবাদিকদের সহায়তায় সমন্বিতভাবে কাজ করা জরুরি।
• তহবিল ও বিনিয়োগ: পর্যটন ব্যবসায়ে আগ্রহী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য সহজ শর্তে ঋণ ব্যবস্থা করা। জেলা পর্যায়ে “পর্যটন উন্নয়ন তহবিল” গঠন করা এবং পাবলিক প্রাইভেট কমিউনিটি পার্টনারশিপ (PPCP) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তহবিলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
পরিশেষে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং কৃষিভিত্তিক পর্যটনের বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই জেলার অফুরন্ত পর্যটন সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ এবং সফল বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
লেখক :অর্থনীতি বিশ্লেষক, কলামিস্ট, সদস্য, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আহবায়ক জেলা পর্যটন কর্পোরেশন। Email: [email protected]