প্রতাপশালী সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল এখন কোথায় ?


কোথায় আছেন প্রভাপশালী সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা- খোদ দলীয় নিজ নেতাকর্মীরাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন প্রশ্ন তুলে যাচ্ছেন। কিন্তু উত্তর মিলছে না। অথচ ২০২৪ সালের ৪ আগষ্ট বিকালেও দলীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ডেকে হুংকার দিয়েছিলেন। কিন্তু পরের দিন দুপুর থেকে তিনি নিখোঁজ। এ নিয়ে সামাজিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন খোদ দলীয় নেতাকর্মীরা।
খাগড়াছড়ির মূর্তিমান আতংক ছিলেন সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। তার কথায় যেন শেষ কথা। গত বছরের ৪ আগষ্ট সন্ধ্যায় খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বসে সাংবাদিকদের সামনে হুংকার দিয়েছিলেন তিনি। তার আগে দিনব্যাপী তাঁর নেতৃত্বে খাগড়াছড়ি শহরে তাণ্ডব চলে। ভাংচুরের পর আগুন দেওয়া হয় খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঁইয়ার বাসভবনে।
বাহিনী হামলা থেকে পার্বত্যনিউজের সাংবাদিক এইম প্রফুল্ল, তার বাসা ও অফিস ভাংচুর করা হয়। শহরের শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটেও হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়। কিন্তু পরের দিন ৫ আগস্ট দুপরের পর খাগড়াছড়ির চিত্র পুরো পাল্টে যায়। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর খাগড়াছড়ি জেলা আওয়াম লীগের অফিস, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার বাসা, রিসোর্ট ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরীর বাসাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাসা-বাড়ীতে হামলে পড়ে দীর্ঘদিন নিপীড়িত বিক্ষুব্ধ জনতা।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত সাড়ে ১৫ বছরে বিএনপির নেতাকর্মী ছাড়াও শত শত সাধারন মানুষ আওয়ামী লীগের হাতে নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েছেন। বিএনপির ১৯ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হলেও মামলা নেয়নি পুলিশ। বাসায় হামলা-ভাংচুর ও লুটপাটের শিকার হয়েছেন শত শত বিএনপি নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষ। মামলা নেয়নি পুলিশ, বরং উল্টো মিথ্যা মামলায় পালিয়ে ছিলেন। মা-বাবার মৃত্যুতে জানাযা অংশ নিতে পারেনি। বাবার কবরে মাটি দিতে পারেনি অনেকে।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। ফেলে গেছেন, বাড়ী, গাড়ী ও রিসোর্ট ও শত কোটি টাকার সম্পদ। কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার বিরুদ্ধে ছিল দখল, প্রতিপক্ষকে নির্যাতন, অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে ছিল নারী কেলেংকারী, মদ ও জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগ।
কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এখন হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামী। সম্প্রতি সরকারী জায়গা দখল করে রিসোর্ট বানানোর অভিযোগে দুদুক মামলা করছে। দুদুকে আরো কয়েকটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বেপরোয়া ছিলেন সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। তিনি এক সময় ছিলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পের কর্মচারী। পরবর্তীতে যোগ দেন আওয়ামী লীগে।২০১০ সালে ফ্যাক্স বার্তায় খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের অন্তবর্তীকালীন চেয়ারম্যান ও পরবর্তীতে তিন দফা বিনা ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান ও সর্বশেষ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর ক্ষমতার দাম্ভিকতা রেড়ে যায়।
এ সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতি, সরকারী জমি দখল, ট্রেন্ডারবাজী, অর্থের বিনিময়ে সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ-বাণিজ্য, দলের পদ ও কমিটি বাণিজ্য করে কয়েক হাজার টাকার সম্পাদ বানিয়েছেন।
খাগড়াছড়ি শহরের খাগড়াপুরে কয়েক কোটি টাকার বাড়ী, আলুটিলা পর্যটন এলাকায় সরকারী জায়গা দখল করে কয়েক কোটি টাকার খাসরাং রিসোর্ট ও সাজেকে খাসরাং নামে আরো একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট বানিয়েছেন। যেখানে চলে নারী দেহের খেলা। ঢাকার অনেক মন্ত্রী, এমপি ও ব্যবসায়ীরা এখানে এসে ফূর্তি করতেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার নিজেরও পর্নোভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ঢাকায় রয়েছে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার একাধিক ফ্লাট বাড়ী। কিন্ত এসব স্থাপনা এখন খালি। বাড়ীতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। একই অবস্থা তার খাগড়াছড়ির আলুটিলার বিলাসবহুল রিসোর্টসহ জেলা সদরের তার স্থাপনাগুলোর। তবে সাজেকের বিলাস বহুল খাসারং রিসোর্টটি সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের আওতা থেকে রক্ষা পেয়ে অক্ষত রয়েছে।
দীঘিনালার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শান্তিপ্রিয় চাকমার মতে, আলুটিলার খাসরাং রিসোর্টের জলসা ঘরে নিয়মিত নারী নিয়ে ফূর্তি করতেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। সে সাথে চলতো মদ ও জুয়ার আসর। কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এতই নারী লিপ্সা ছিলেন, চোখে যাকে পছন্দ হতো তাকে ভোগ করার জন্য মরিয়া ছিলেন। ঐ নারী বিবাহিত হলেও রেহাই। এইভাবে অনেক নারীকে বাড়ী বানিয়ে দিয়েছেন। কাউকে দিয়েছেন চাকুরি কিংবা প্রতিষ্ঠানের বসিয়েছেন।
খনি রঞ্জন ত্রিপুরা জানান, এক সময় কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (এনএলএফটি’র) পৃষ্টপোষক ছিলেন। তিনি এনএলএফটি’র গোপন ক্যাম্পে নিয়োমিত যাতায়াত করতে এবং ঐ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য রসদ সরবরাহ করতে করতেন। এ কারণে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিল আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সংসদ।
খাগড়াছড়ি দূর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি এডভোকেট জসিম উদ্দিন মজুমদার জানান, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ব্যাপক দূর্নীতির সম্পদের পাহাড় নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কয়েকদফা উদ্যোগ নিলেও প্রভাব খাটিয়ে উল্টো তদন্ত কর্মকর্তাকে বদলী করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মো: আরেফিন জুয়েল বলেন, খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঁইয়ার বাস ভবনে অগ্নিসংযোগ লুটের অভিযোগে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়েছে। পুলিশও কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও তার সহযোগীদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান চলছে। তবে গত ৮ মাসেও পুলিশ খাগড়াছড়ির আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সারির কোন নেতাকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
একটি সূত্র জানায়, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ৫ আগষ্ট বিকাল পর্যন্ত খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের আইভি-তে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি মধুপর এলাকায় চলে যান। এর পর থেকে তার আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। তবে সেপ্টেম্বরে তার ব্যবহৃত গাড়ীটি গাড়ীটি গুইমারায় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। শান্তিপ্রিয় খাগড়াছড়িবাসী সকল সন্ত্রাসী ও দূর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়।

















