ফানুস উড়ানোর মধ্য দিয়ে বান্দরবানে শুরু হয়েছে প্রবারণা পূর্ণিমা
ফানুস ওড়ানো, সমবেত প্রার্থনা ও ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে বুধবার (২০ অক্টোবর) বান্দরবানে শুরু হয়েছে ২ দিনব্যাপী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা বা মাহাওয়াগ্যোয়াই পোয়ে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় ও সামাজিক এই উৎসবে শহর ও পাহাড়ি পল্লীগুলোতে চলছে নানা আচার-অনুষ্ঠান। প্রাণিজগতের মঙ্গল কামনায় চলছে বিশেষ প্রার্থনা।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মতে, আষাঢ়ী পূর্ণিমার পরের দিন থেকে টানা তিনমাসের বর্ষাবাস শেষে বৌদ্ধ নর-নারীরা বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে পঞ্চশীল, অষ্টশীল ও দশশীল গ্রহণ করেন। প্রবারণা পূর্ণিমার সময় সকল অহিংসা ও পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার মন্ত্রে দীক্ষিত হন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মানুসারীরা। প্রতিবছর আশ্বিনী পূর্ণিমায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা শ্রদ্ধাভরে প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করে থাকে। তাদের মতে, প্রবারণা পুর্ণিমার দিনই রাজকুমার সিদ্বার্থের মাতৃগর্ভে প্রতিসন্দি গ্রহণ, গৃহত্যাগ ও ধর্মচক্র প্রবর্তন সংঘটিত হয়েছিল। আর তাই প্রতিটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে এ দিনটি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে আজও।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে, প্রবারণা পূর্ণিমায় মোমবাতি প্রজ্জ্বলন প্রথা আছে, সিদ্ধার্থ গৌতমবুদ্ধ মাথার এক গুচ্ছ চুল কেটে বলেছিলেন, তিনি যদি সিদ্ধিলাভের উপযুক্ত হন, তবে এই চুল যেন নিচে না পড়ে উপরের দিকে উঠে যায়। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী চুলগুচ্ছ নিচে মাটিতে না পড়ে আকাশে উড়ে গিয়েছিল। তাই বুদ্ধের কেশধাতুর পূজার অংশ হিসেবে আকাশে এই ফানুস ওড়ানো হয়। তাদের বিশ্বাস, এই ফানুস উড়ানোর মধ্য দিয়ে তাদের পাপও আকাশে উড়ে যাবে।
মারমা সম্প্রদায় জানায়, তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় গুরুদের খাবার দেওয়া, ফানুস ওড়ানো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পিঠা তৈরি, হাজারো প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, রথযাত্রা ও সাঙ্গু নদীতে রথ বিসর্জন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখাগেছে, প্রবারণা উৎসবকে ঘিরে মারমা সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা নতুন পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক পাড়া থেকে অন্যপাড়ায়। আবার কেউ কেউ ক্যায়ং এ গিয়ে উড়াচ্ছে ফানুস। আবার কেউবা প্রার্থনায় মগ্ন রয়েছেন নিজেদের পাপ মোচনে।
মারমা তরনী উমেপ্রু জানায়, তিন মাস বর্ষবাস (উপবাস) পালনের পর আজ সকলে সমবেতভাবে প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করছে। সে আরো জানায়, বর্ষবাসের সময় তারা কোনও প্রাণিজ খাবার গ্রহণ করেনি।
বান্দরবানের জ্ঞানরত্ন বৌদ্ধ বিহারের ভান্তে (ধর্মীয় গুরু) সত্যজিৎ থের জানায়, শত শত বছর ধরে মারমা সম্প্রদায় এ সামাজিক উৎসব পালন করে আসছে। গৌতম বুদ্ধ এ দিনে আকাশে চুল উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই মারমা সম্প্রদায় বিশ্বাস করে, এ দিনে ফানুস উড়ালে তাদের পাপমোচন হবে।
উপাসক-উপাসিকারা জানান, বিহারে বিহারে দেয়া হয় ধর্মীয় দেশনা। জগতের সকল প্রাণীর মঙ্গল কামনায় করা হয় বিশেষ প্রার্থনা। জগতের সুখ শান্তি লাভ ও পারিবারিক সুস্থতার জন্য প্রার্থনায় জড়ো হয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। দায়ক-দায়িকারা মোমবাতি, ধুপকাটি প্রজ্জ্বলন আর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ছোয়াইং (বিভিন্ন ধরনের খাবার) দান করে দিনটি পালন করে মহানন্দে।
বান্দরবান উৎসব উদযাপন পরিষদের সভাপতি হ্লা এ মং মারমা জানান, বান্দরবান পৌর এলাকায় একটি বড় ও একটি ছোট মোট ২টি ক্যায়ংসহ জেলাজুড়ে প্রতিটি ক্যায়ং এ এই প্রবারণা উৎসব চলছে। দুই দিনব্যাপী এ প্রবারণা পূর্ণিমায় নানা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে বৃহস্পতিবার (২১অক্টোবর) মধ্যরাতে সাংগু নদীতে রথ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এই প্রবারণা উৎসব।
—