ফিলিস্তিনিদের আটকের পর বিবস্ত্র করে নির্যাতন
ফিলিস্তিনের জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের বাইরে ফিলিস্তিনিদের ধরে অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে ইহুদি সেনারা। ফিলিস্তিনিদের চোখ বেঁধে ও তাদের নগ্ন করে প্রহার করেছে যায়নবাদীরা। আর এর ভিডিয়ো তুলে তারা প্রকাশও করেছে।
গাজার উত্তরাঞ্চল এবং খান ইউনিসকে ঘিরে যখন তীব্র লড়াই চলছে ঠিক তখনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক হওয়া ফিলিস্তিনি পুরুষদের নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে।
বিবিসির যাচাই করা ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, আটক হওয়া পুরুষদের অধিকাংশকেই শুধু অন্তর্বাস পরিয়ে রাখা হয়েছে এবং তারা মাটিতে বসে আছে। তাদের চোখ এবং হাত পেছনে বেঁধে রাখা। ইসরায়েলি সেনারা তাদের পাহারা দিচ্ছে।
গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চল বেইত লাহিয়া এলাকা থেকে তাদেরকে আটক করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিবিসিকে বলা হয়েছে যে, তাদের মধ্য থেকে কয়েক জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
যাদেরকে আটক করা হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন স্বনামধন্য ফিলিস্তিনি সাংবাদিকও রয়েছেন। এ ঘটনার পর তার নিয়োগ দাতা প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর আগ্রাসী আচরণ, তল্লাশি ও অপমানজনক আচরণের অভিযোগ তুলেছে।
এই ভিডিও সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে ইসরায়েলি সরকারের মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, যেসব ব্যক্তিদের আটক করা হয়েছে তাদের সবার সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার মতো বয়স হয়েছে। তাদেরকে এমন এক এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে যেখান থেকে কয়েক সপ্তাহ আগেই বেসামরিক নাগরিকদের চলে যাওয়ার কথা ছিল।
ভিডিওতে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন পুরুষকে পায়ে চলা রাস্তায় সারিবদ্ধ করে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাদেরকে তাদের জুতা খুলতে বলা হয়েছে এবং জুতাগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ইসরায়েলি সেনা এবং সাঁজোয়া যান তাদেরকে পাহারা দিচ্ছে।
অন্য ছবিতে দেখা যায়, তাদেরকে সামরিক যানে করে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ইসরায়েলি মিডিয়ায় আটক হওয়া এসব লোকজনকে হামাসের আত্মসমর্পণ করা যোদ্ধা হিসেবে প্রচার করা হয়েছে।
আরেকটি ছবি বিবিসি যাচাই করতে পারেনি। সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, ওই ব্যক্তিদেরকে চোখ বাঁধা অবস্থায় বুলডোজার দিয়ে তৈরি করা বালির গর্তের কাছে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ছবিগুলো সম্পর্কে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেনি। কিন্তু মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বৃহস্পতিবার বলেন, আইডিএফ বাহিনী ও শিন বেত কর্মকর্তারা শত শত সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
এদের মধ্যে অনেকে গত ২৪ ঘণ্টায় আমাদের বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
শুক্রবার ইসরায়েলি সরকারের মুখপাত্র আইলন লেভি বিবিসিকে বলেন, ওই ব্যক্তিদের গাজার উত্তরাঞ্চলের জাবালিয়া ও শেজাইয়া থেকে আটক করা হয়েছে। এই স্থানগুলো হামাসের শক্ত ঘাঁটি এবং উত্তেজনার কেন্দ্র। তিনি বলেন, আমরা সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে উপযুক্ত বয়সী পুরুষদের সম্পর্কে কথা বলছি যাদেরকে এমন জায়গা থেকে আটক করা হয়েছে যেখান থেকে কয়েক সপ্তাহ আগেই বেসামরিক নাগরিকদের চলে যাওয়ার কথা ছিল।
তিনি আরও বলেন, তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কে হামাসের সদস্য আর কে নয় তা বের করার চেষ্টা করা হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আটককৃত লোকদের এমন এলাকায় পাওয়া গেছে যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী হামাসের সঙ্গে প্রায় মুখোমুখি সংঘাতে জড়িয়েছিল। তারা বরাবরই বেসামরিক নাগরিকের ছদ্মবেশে ছিল এবং তারা বেসামরিক স্থাপনা থেকে পরিচালিত হয়েছে।
বিবিসি এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে যিনি জানিয়েছেন যে, বৃহস্পতিবার বেত লাহিয়া থেকে যে দলটিকে ইসরায়েলি বাহিনী আটক করেছে তাদের মধ্যে তার ১০ জন আত্মীয় রয়েছে।
নিরাপত্তার স্বার্থে ওই ব্যক্তি তার নাম প্রকাশ করতে চাননি। তিনি বিবিসি অ্যারাবিকের ইথার শালাবিকে বলেন, আইডিএফ-এর সেনারা ওই এলাকায় প্রবেশ করে মাইক্রোফোনের মাধ্যমে তাদেরকে বাড়ি ও জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থার পরিচালিত স্কুল থেকে বেরিয়ে আসতে বলে।
তিনি বলেন, আইডিএফ ওই এলাকার নারীদের পার্শ্ববর্তী একটি হাসপাতালে চলে যেতে বলে এবং পরে পুরুষরা বাড়ি থেকে বের হয়ে না আসলে তাদের ওপর গুলি চালানোর হুমকি দেয়।
ওই ব্যক্তি পরে জানিয়েছেন যে, তার আত্মীয়দের মধ্যে সাতজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং তারা বাড়ি ফিরে এসেছে। কিন্তু ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক থাকা বাকি তিনজনের ভাগ্যে কী জুটেছে তা তিনি জানেন না।
সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত হুসাম জমলত এই ভিডিও ফুটেজকে জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বেসামরিক নাগরিকদের আটক ও তাদের নগ্ন করাকে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর বর্বর চিত্র বলে বর্ণনা করেছেন।
হুসাম জমলত বলেন, এটি মানবতার ইতিহাসের কিছু অন্ধকারতম অধ্যায়ের সূচনা করেছে। আটককৃতদের ভিডিওর মধ্যে একজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক রয়েছেন। দিয়া আল-কাহলুত নামে ওই সাংবাদিক আল-আরাবি আল-জাদিদ নামে একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি।
আরবি ভাষার ওই সংবাদ মাধ্যমটি ‘নিউ আরব’ নামে ইংরেজি ভাষাতেও প্রকাশিত হয়। তারা বলছে, আল-কাহলুত, তার কয়েকজন ভাই, কয়েকজন আত্মীয় এবং অন্য বেসামরিক নাগরিকদের সঙ্গে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে বেইত লাহিয়াতে আটক হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার আল-আরাবি আল-জাদিদ আল-কাহলুতকে আটকের ঘটনাকে অপমানজনক হিসেবে বর্ণনা করে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ইসরায়েলি বাহিনী ওই পুরুষদেরকে তাদের কাপড় খুলতে বাধ্য করেছে এবং আটক করার সময় তাদের উপর আগ্রাসী তল্লাশি চালিয়েছে এবং তাদের সঙ্গে অপমানকর ব্যবহার করেছে, পরে তাদেরকে গোপন স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সংবাদ মাধ্যমটি ওই এলাকায় সাংবাদিকদের ওপর ইসরায়েলের চলমান হামলার নিন্দা জানাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা কর্মী ও ওয়াচডগ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে। বিবিসি আইডিএফ এর কাছে আল-কাহলুতের আটকের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। তবে এ বিষয়ে তেমন কিছু জানায়নি আইডিএফ।