ফের রক্তাক্ত পাহাড়, : ৮ মাসে ১৭ খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি

fec-image

ফের রক্ত ঝরলো পাহাড়ে। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বান্দরবান সফরকালে এই রক্তপাতে ঘটনা ঘটে। গতকাল  ১৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাতে জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার নতুনপাড়া কিয়াং এর পাশে সাবেক এক ইউপি সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

নিহত ব্যক্তির নাম সাউ প্রু মারমা (৫০)। তার বাড়ি নতুন পাড়া এলাকায়। তিনি দীর্ঘদিন রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার ছিলেন।

অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি প্রথমে জেএসএস(মূল) রাজনীতি করতেন। পরবর্তীতে জেএসএস ত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। সম্প্রতি তিনি আওয়ামী লীগ থেকে জেএসএস (সংস্কার) গ্রুপে যোগ দিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।

এ ঘটনার দুইদিন আগেই সন্ত্রাসীদের গুলিতে রক্ত ঝরলো এক সেনাবাহিনীর সদস্যের। আত্মরক্ষায় পাল্টা গুলিতে নিহত হলো পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেট পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) প্রসীত গ্রুপের দুই সন্ত্রাসী। উদ্ধার হলো একটি অত্যাধুনিক এক-২২ রাইফেল।

পাহাড়ে একাধিক আঞ্চলিক সংগঠনের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই ও নিরাপত্তা বাহিনীর টহল দলের উপর গুলি বর্ষণ ও  হামলা নতুন কিছু নয়। এক সময় পাহাড়ে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বে শান্তিবাহিনীর নামক একটি সংগঠনের অস্তিত্ব থাকলেও বর্তমানের চারটি সংগঠনের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই, চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়সহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সবুজ পাহাড়কে অস্থির করে তুলেছে।

এ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি  বছরে ৮ মাসের ব্যবধানে অন্তত ১৭ জন প্রাণ হারিয়েছে চারটি আঞ্চলিক সংগঠনের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে। চাঁদাবাজি, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় সে তো নিত্য দিনের ঘটনা।

মঙ্গলবার(১৩ অক্টোবর) নিরাপত্তা বাহিনী একটি দল জেলে সেজে চাঁদা দেওয়ার জন্য নানিয়াচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের  রউফ টিলায় গেলে সন্ত্রাসী দলের নেতা চাঁদা নিতে আসেন। তখন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাকে ঘিরে ফেললে সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়তে শুরু। এতে সৈনিক সাহাবুদ্দিন গুরতর আহত হয়। সেনাবাহিনীও পাল্টা গুলি ছুঁড়ে।

দুইপক্ষের মধ্যে ঘন্টাব্যাপী গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে সন্ত্রাসীরা পিছু হটে। পরে ঘটনাস্থলে তল্লাসী চালিয়ে দু’জনের গুলিবিদ্ধ লাশ ও লাশের পাশে একটি অত্যাধুনিক একে-২২ রাইফেল পাওয়া যায়।

নিহতরা হলেন, নানিয়ারচর উপজেলার আঝাছড়ি এলাকার বাসিন্দা মনোরঞ্জন চাকমার ছেলে আশাপূর্ণ চাকমা ওরফে রকেট (২৮) এবং সদর উপজেলার বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের ধামেইছড়া এলাকার বাসিন্দা সুসেন মনি চাকমার ছেলে সম্ভু চাকমা (৩৫)। এ ঘটনায় মো. শাহাবুদ্দিন (২৮) নামে এক সেনা সদস্য আহত হয়েছে।

রউফ টিলা ও পাশের কমতলা এলাকাটি প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(  ইউপিডিএফ) নিয়ন্ত্রিত বলে স্থানীয় একটি সূত্রগুলো জানিয়েছে।

এ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র  চলতি  বছরের ২৫ মার্চ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত  খুন হয়েছেন ১৭ জন।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে  গণপরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা ওরফে এমএন লারম নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ৭ মার্চ তাঁর নেতৃত্বে রাঙ্গামাটিতে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।

পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারী খাগড়াছড়ির ইটছড়িতে তারই নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগঠন ‘শান্তিবাহিনী’। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে শান্তিবাহিনী বিলুপ্ত হলেও বর্তমানে পাহাড় নিয়ন্ত্রণ করছে চার চারটি সশস্ত্র বাহিনী।

এগুলো হচ্ছে, আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, প্রসীত বিকাশ খীসার ইউনাইটেট পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ),জনসংহতি সমিতি (এমএন)এবং শ্যামল কান্তি চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক। এসব সংগঠনের হাতে রয়েছে, এম-১৬, একে-৫৬, একে-৪৭, এলএলজি, এসএমজি ও রকেট ল্যাঞ্চারসহ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র।

চুক্তি স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ১০ ফ্রেরুয়ারী খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর হাতে গেরিলা নেতা সন্তু লারমার অস্ত্র সমর্পনের মধ্য দিয়ে জনসংহতি সমিতির সদস্যরা নাম মাত্র স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসলেও পাহাড়ে প্রকৃত শান্তি ফিরে আসেনি। বরং বেড়েছে হানাহানি, আধিপত্য বিস্তারে যুদ্ধ, খুন,অপরহরণ আর চাঁদাবাজি। মাঝে মধ্যে সন্ত্রাসীরা এখন নিরাপত্তা বাহিনীকেও চ্যালেঞ্জ করছে।

চুক্তির পর  সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম  জনসংহতি সমিতিকে (জেএসএস) চ্যালেঞ্জ করে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। পরবর্তীতে  সন্তু লারমার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে প্রয়াত সুধাসিন্ধু খীসার নেতৃত্বাধীন জেএসএস (এমএন লারমা)  এবং সর্বশেষ প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে আত্মপ্রকাশ ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক। বর্তমানে যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন শ্যামল কান্তি চাকমা।

তবে চুক্তিবিরোধী সংগঠন হিসেবে পরিচিত ইউপিডিএফে কেন্দ্রীয়  কমিটির যুব ফোরামের সভাপতি অংগ্য মারমা পার্বত্য শান্তি চুক্তিকে  ‘এটি অসম্পূর্ণ চুক্তি, আখ্যায়িত করে বলেন, সেই কারণে আমরা চুক্তির বিপক্ষে ছিলাম। এই অসম্পূর্ণ চুক্তিটি সরকার দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রেখেছে এবং তারা বাস্তবায়নও করছে না। তার মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষকে অধিকার দেওয়া হলে আন্তঃদলীয় সংঘাত হতো না।

ইউপিডিএফ’র  (গণতান্ত্রিক) কেন্দ্রীয়  সভাপতি শ্যামল কান্তি  চাকমার মতে, প্রসীত খীসার ইউপিডিএফের জন্য আজ পাহাড়ে এত সংঘাত। প্রসীত খীসার চুক্তির বিরোধিতার কারণে পাহাড়ে আজ চারটি আঞ্চলিক সংগঠন। তিনি বলেন, পাহাড়ে রক্তপাত বন্ধ হোক এটা আমরা সব সময় চাই। সে  জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু সন্তু লারমার জেএসএস ও প্রসীত খীসার ইউপিডিএফ;র  কারণে সংঘাত বন্ধ হচ্ছে না। তারা মুখে বলে একটা আর করে আরো একটা। তিনি সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসাকে বিশ্বাঘাতক আখ্যায়িত করে বলেন, তাদের জনগণ বিশ্বাস করে না।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, ‘পাহাড়ে কোনও হত্যাকান্ডের সাথে জেএসএস(এমএন) জড়িত না। আমরা পার্বত্য শান্তি  চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছি। আমরা চাই সবাই পাহাড় শান্ত থাকুক, সবাই নিরাপদে থাকুক।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: খুন, পাহাড়ে সন্ত্রাস, সন্ত্রাস
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন