বক্সিংয়ে বাংলাদেশি হিসেবে প্রথম পেশাদার বেল্ট পেলেন পাহাড়ের সুর কৃষ্ণ চাকমা

বক্সিংয়ে বাংলাদেশি হিসেবে প্রথম পেশাদার বেল্ট পেলেন রাঙামাটির প্রত্যন্ত জোড়াছুড়ি এলাকার সুর কৃষ্ণ চাকমা। এশিয়ান বক্সিং ফেডারেশনের সুপার লাইটওয়েট ইন্টারকন্টিনেন্টাল চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালের মহেন্দ্র বাহাদুর চাঁদকে হারিয়ে বাজিমাত করেন তিনি। গত রাতে ঢাকার ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের বলরুমে আলোঝলমলে রিংয়ে নামে সুর কৃষ্ণ চাকমা। প্রো-বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ ২.০ ফাইট নাইটে আটটি বাউটের মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় বাউট। খেলা শেষে সুর কৃষ্ণকে জয়ী ঘোষণার পর পরিয়ে দেওয়া হয় পেশাদার বেল্ট।
এদিকে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশি বক্সার হিসেবে পেশাদার বক্সিংয়ে যেটি তিনিই প্রথম পেয়েছেন। উচ্ছ্বসিত সুর কৃষ্ণ বেল্ট পরে রাত প্রায় ১২টার দিকে রিংয়ে দাঁড়িয়ে একের পর এক ছবি তোলার জন্য পোজ দিচ্ছিলেন।
এসময় সুর কৃষ্ণ চাকমা জানান, এশিয়ান বক্সিং ফেডারেশনের বেল্ট তার অনেক স্বপ্নের। বাংলাদেশে যা এর আগে কেউ পায়নি। এটি পেয়ে খুব খুশি তিনি।
সুর কৃষ্ণ চাকমা আরো জানান, বিজয়ী হওয়া ফলে প্রতি তিন মাস পরপর এখন তাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারবে। এশিয়ান বক্সিং ফেডারেশনের যে টাইটেল তালিকা আছে, ওখানেও তার নাম থাকবে।’
বাংলাদেশের প্রো-বক্সিংয়ের আয়োজক এক্সবিসির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবারের চ্যাম্পিয়নশিপ। এতে অংশ নিয়েছেন রাশিয়া, ফ্রান্স, তুরস্ক, নেপাল, ভারত ও স্বাগতিক বাংলাদেশের ১৬ জন বক্সার। আটটি বাউটে খেলেন তাঁরা। সুপার মিডলওয়েট বাউটে চার রাউন্ডের ম্যাচে বাংলাদেশের জুয়েল আহমেদ জনি হারিয়ে দেন ভারতের যুগন্ধর তাম্বাটকে।
মেয়েদের ছয় রাউন্ড ফ্লাইওয়েট বিভাগে বাংলাদেশের স্বদেশি আফরা খন্দকারের বিপক্ষে জিতেছেন বাংলাদেশেরই তানজিলা। ওয়েল্টার ওয়েটে বাংলাদেশের আল আমিনের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরেছেন রাশিয়ার কনস্ট্যান্টিন রুডেনকো। তবে তুরস্কের বাতুহান বোরালের কাছে হেরেছেন বাংলাদেশের জাহিদুল ইসলাম। এটি ছিল লাইট হেভিওয়েট।
পেশাদার বক্সিং করছেন বলে এখন আর বাংলাদেশ বক্সিং ফেডারেশনের অধীনে যেসব অপেশাদার বক্সিং আয়োজন হয় সেসব তিনি আর অংশ নিচ্ছেন না। এর আগে সুর কৃষ্ণ কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশের দলের প্রতিনিধিত্ব করেন।
অপেশাদার বক্সিংয়ে অংশ না নেওয়া বিষয়ে সুর কৃষ্ণ জানান, পেশাদার আর অপেশাদার বক্সিং আলাদা। অনুশীলনও আলাদা। দুটি একসঙ্গে চালিয়ে নেওয়া তার সম্ভব নয়। তাই সে এখনপুরো সময় ব্যয় করছে পেশাদার বক্সিংয়ে।
সুর কৃষ্ণ জানান, ‘পেশাদার বক্সিংয়ে ভালো করলে দেশেরই নাম হয়। তাই এখন আমি এটাতেই সময় দিচ্ছি। অ্যামেচারে (অপেশাদার) যে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, সে দেশের হয়ে কোনো গেমস বা টুর্নামেন্টে খেলে। কিন্তু পেশাদার বক্সিং হয় র্যাঙ্কিং অনুযায়ী। এর সূচিটাই আলাদা। আপনি আপনার মান অনুযায়ী অন্য বক্সারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন।’
তবে অপেশাদার বক্সিংই বাংলাদেশি বক্সারদের কঠিন মনে করা নিয়ে সুর কৃষ্ণের ব্যাখ্যা করেন বলেন, ‘এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমসে প্রতিপক্ষ বক্সাররা অনেক বেশি অভিজ্ঞ হয়। তিন মাস অনুশীলন করে আমরা তাদের সঙ্গে কখনো রেজাল্ট করতে পারব না। এ জন্য অপেশাদার বক্সিংয়ে ভালো করা বাংলাদেশিদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। আমি দেশের হয়ে খেলতে গিয়ে যদি খালি ঘুরে আসি, তাহলে দেখতে খারাপ লাগে। এ জন্য আমি জানিয়ে দিয়েছি অ্যামেচার বক্সিং আর করব না। পেশাদার বক্সিং করব। এখানেও দেশের নাম করা যায়।
এদিকে ছেলে সুর কৃষ্ণের সাফল্যে দারুণ খুশি মা সারনা চাকমা। রাঙামাটিতে থেকে ছুটি এেসেছে ছেলের খেলা দেখতে। সন্তানদের মধ্যে সুর কৃষ্ণ সবার বড়। মা ছাড়াও ছোটজন দেব চাকমা, সুরের স্ত্রী, শাশুড়িও এসেছেন তার টাইটেল ফাইট দেখতে। মধ্যরাতে বাউট শেষে হোটেলে সুর কৃষ্ণের সঙ্গে পাওয়া গেল তাঁদের।
সুর কৃষ্ণের মা সারনা চাকমা জানান, ঘুষাঘুষির প্রতি আগ্রহ থাকায় ছোটবেলায় ছেলেকে কারাতেতে ভর্তি করে দেয় ওর বাবা। কারণ সে ভালো পারে। সুর কৃষ্ণের মা আরো জানান, ছেলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এতে আমরা খুশি। আজ ওর বাবা নেই, মারা গেছেন। তিনি থাকলে খুশি হতেন বলেও যোগ করেন তিনি।
রাঙামাটির প্রত্যন্ত এলাকা জোড়াছুড়ি থেকে উঠে এসে সুর কৃষ্ণ এখন বাংলাদেশের বক্সিংয়ের আলোচিত নাম। ছোটবেলায় বিকেএসপিতে ভর্তি হতে ফুটবলে ট্রায়াল দিয়েছিলেন সুর কৃষ্ণ। কিন্তু ফুটবলে না টেকার পর ট্রায়াল দেন বক্সিংয়ে। টিকেও যান। ব্যস, এভাবেই হয়ে গেলেন বক্সার। সুর কৃষ্ণ চাকমা ২০০৭-১৩ বিকেএসপিতে কাটিয়েছে। আজ সে একজন পেশাদার বক্সার।
এর আগে সে পাঁচটি পেশাদার টুর্নামেন্ট খেলেছে। সব কটিতেই বিজয়ী হয়েছেন তিনি। সুর কৃষ্ণ চাকমা আশা ব্যক্ত করে বলেন, সামনে আরও জিততে চাই। অনেক দূর যেতে চাই।’
আগে অনেকে বক্সিংয়ের কথা জানতই না মন্তব্য করে সুর কৃষ্ণ বলেন, ‘২০১৪ থেকে আমি অপেশাদার বক্সিং করলে আমাকে কেউ চিনতো না। তবে পেশাদার বক্সিং শুরুর পর আমাকে সবাই চিনেছে। এখানে আর্থিক সুবিধা আছে, যেহেতু পেশাদার। বাংলাদেশে এখন অনেকেই পেশাদার বক্সিং করে বলেও জানান সুরকৃষ্ণ চাকমা।