বঙ্গবন্ধুর সফরের সংবাদ সংগ্রহকারী একজন সংবাদকর্মীর কথা

fec-image

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাঙামাটি সফর সফর করেছিলেন সেদিনও বঙ্গবন্ধুর সামনে থেকেই দেখে সংবাদ সংগ্রহের কাজে ব্যাপৃত ছিলাম। আমি তখন দৈনিক আজাদী ও দৈনিক জনপদের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করি। ১৯৭৩ সালের ১৬ ফেব্রæয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হেলিকপ্টার যোগে রাঙামাটি পদার্পণ করেন। সেইদিনের স্মৃতি আজো আমার স্মৃতিপটে অ¤øান হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর প্রথম রাঙামাটি সফরের যতটুকু মনে পড়ে, দুপুরের আগেই বঙ্গবন্ধুকে বহন করা হেলিকপ্টার কোর্ট বিল্ডিং (বর্তমানে শহীদ আবদুস শুক্কুর মাঠে) অবতরণ করে। বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য নারী-পুরুষের ঢল নামে রাঙামাটি শহরে। সকাল থেকেই দলে দলে লোকজন আসতে থাকে। চাঁদের গাড়ি, বাসে করে, এমনকি পায়ে হেঁটেও দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসে। কেউ আসেন নৌকা-সাম্পানে, কেউ লঞ্চে, কেউ ইঞ্জিন চালিত বোটে করে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, অনেকেই গাছের আগাতেও উঠেছিল বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য।

রিজার্ভ বাজারের অনুষ্ঠানস্থল ঘিরে এর আশেপাশের সর্বত্রই মানুষ আর মানুষ। মাঠ ভর্তি মানুষ আর মানুষ। মাঠ ছাড়িয়ে রাস্তায়ও লোকে লোকারণ্য। জেলা প্রশাসন থেকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য আমার কাছে আলাদা পাস ছিল। বঙ্গবন্ধুর জন্য করা মঞ্চ থেকে প্রায় ৩০ গজ দূরে সাংবাদিকদের বসার জায়গা করা হয়েছিল। ঢাকা থেকে বার্তা সংস্থা বিএসএস ও এনা’র সাংবাদিক ছাড়াও বেশ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক এসেছিলেন। আমিও তাঁদের সাথে সেখানেই বসে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণ শুনেছিলাম। মঞ্চে আওয়ামী লীগ নেতা নোয়াব মিয়া, সৈয়দুর রহমান, মো. জাকারিয়া, চারু বিকাশ চাকমা প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ছিলেন। স্টেজের আশেপাশে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতৃবৃন্দও ছিল।

অনুষ্ঠান শেষে আমি রিজার্ভ বাজারস্থ মসজিদ মার্কেটে আমার অফিস থেকে টেলিফোনে দৈনিক আজাদী ও দৈনিক জনপদে নিউজ পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু সেসময় আমার নিউজ ছাপা হয়নি। যতটুকু মনে পড়ে ঢাকা থেকে আসা বার্তা সংস্থার সংবাদগুলোই ছাপানো হয়েছিল।

১৯৭৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় বারের মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাঙামাটি জেলায় আগমন করেন। এসময় আমি ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বদেশ ও বার্তা সংস্থা এনা’তে কাজ করছিলাম। বঙ্গবন্ধুর রাঙামাটি সফরের বিষয়টি এনা হতে পূর্বেই আমাকে জানিয়েছিল। এও জানানো হয়েছিল যে, এনা’র বার্তা সম্পাদক চৌধুরী আবুল ফজল হাজারীও আসবেন। বঙ্গবন্ধুকে বহন করা হেলিকপ্টার কোর্ট বিল্ডিং মাঠে (বর্তমানে শহীদ আবদুস শুক্কুর মাঠে) অবতরণ করে, বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য লোকজনের প্রণ্ড ভীড় ছিল।

সাংসদ সুদীপ্তা দেওয়ান ছাড়াও উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিবর্গ মাঠে উপস্থিত ছিলেন। সকলেই বঙ্গবন্ধুকে ফুলেল অভ্যর্থনা জানাতে থাকেন। আমি মাঠের ওপরে রাস্তায় ছিলাম।

বার্তা সম্পাদক চৌধুরী আবুল ফজল এসে আমার অফিস কোথায় এবং সেখান থেকে নিউজ পাঠাতে লাইন পাওয়া যাবে কিনা জানতে চান। বললাম, যাবে।

এদিকে মাঠ থেকে উঠে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সফরসঙ্গীরা সার্কিট হাউজের উদ্দেশ্যে গাড়িতে রওনা হন। বঙ্গবন্ধুর সম্মানে রাস্তায় অনেকগুলো তোরণ করা হয়েছিল এবং রাস্তার দুই পাশে স্কুলের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। সার্কিট হাউজে বঙ্গবন্ধু উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে মতবিনিময় করেন।

আমি সেই প্রোগ্রামে উপস্থিত হইনি, তবে অনুষ্ঠান শেষে বার্তা সম্পাদক আবুল ফজল সন্ধ্যার দিকে আমার অফিসে আসেন। তিনি প্রথমে সবকিছু লিখেন এবং আমার চেয়ারে বসে টেলিফোনে নিউজ বলেন; আর আমাকে তাঁর পিছনে দাঁড় করিয়ে বলেন, কোনো কিছু বাদ পড়লে আমাকে বলবে।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, তিনি ৪৫ মিনিটের মতো সময় নিয়ে পুরো দিনের সংবাদ টেলিফোনে বলেন। শেষে অফিসে জানান, ‘আর কিছু জানতে চাইলে আমাকে টেলিফোন করিও; আমি মকছুদের অফিসে আছি।’ যতটুকু মনে পড়ে, বোধহয় একবার একটি শব্দের জন্য অফিস থেকে ফোন করেছিল। তিনি পাঠানোর পর আমাকে বললেন, ‘তুমিও কোথায় কোথায় পাঠাবে পাঠাও।’ তখন আমি দৈনিক পূর্বদেশ ও দৈনিক আজাদীতে নিউজটি পাঠিয়েছিলাম। আমার মনে হয়, সেদিনের আবুল ফজলের নিউজটিই প্রায় সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধনের জন্য তৃতীয়বারের মতো রাঙামাটি সফর করেছিলেন। এদিন ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন শেষে তিনি কাপ্তাই সফরে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই সফর নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। জেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকেও সেই অনুষ্ঠানদ্বয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সংবাদকর্মী হিসেবে আমিও আমন্ত্রণ পেয়েছি এবং এসডিও আবদুর রউফের গাড়িতে করেই আমাকে বেতবুনিয়া নেয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠানে বার্তা সংস্থা বিএসএস, এনা এবং অন্যান্য পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিকগণ উপস্থিত হয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়া আসার সংবাদে কাউখালী, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান থেকে প্রচুর লোক জমায়েত হয়। বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়া পৌঁছে প্রথমে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন এবং পরে ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠান শেষে আমরা গাড়িতে করে কাপ্তাই যাই। বঙ্গবন্ধু গভর্নেন্স হাউজে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের সাথে কথা বলেন এবং রাত্রিযাপন করেন।

আমরাও সেদিন কাপ্তাই ছিলাম। আমাদের রাখা হয়েছিল স্পিলওয়ে পার হয়ে ওখানকার রেস্ট হাউসে। সেখানে আমি, বান্দরবানের মং সার্কেল চিফ মং শুয়ে প্রæ চৌধুরী, চাকমা সার্কেল চিফের প্রতিনিধি কুমার সমিত রায়, চিরঞ্জিব রায় প্রমুখ ছিলাম। সন্ধ্যার পর বঙ্গবন্ধুর সম্মানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তবে সেই প্রোগ্রামে সকলের প্রবেশাধিকার ছিল না। সেইদিনের দুটি অনুষ্ঠানের নিউজই সিনিয়র সাংবাদিকরা করেছিলেন।

আমি পরের দিন রাঙামাটি ফিরে আসি। বঙ্গবন্ধু দুইদিন কাপ্তাই অবস্থান করেছিলেন। জীবনে তিনবারই কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তবে এটুকু বলতে পারি, বঙ্গবন্ধুর মতো এমন বিশ্ববরেণ্য নেতা হাজার বছরে একবারই আসে।

এ কে এম মকছুদ আহমেদ: পার্বত্য চট্টগ্রামের বরেণ্য সাংবাদিক ও সম্পাদক দৈনিক গিরিদর্পণ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন