‘বঙ্গোপসাগরে ‘এক ঘন্টায়’ জলদস্যুতা রোধ সম্ভব’- সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য
আবদুল্লাহ নয়ন, কক্সবাজার
বঙ্গোপসাগরে অব্যাহত ‘জলদুস্যতা’ আতংকে বহু জেলে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া বন্ধ রেখেছে। সমুদ্রের যেসব ‘পয়েন্টে’ মাছ বেশি ধরা পড়ে ওইসব স্থানে দস্যুদের তাণ্ডব দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। ফিশিং বোট মালিক, মৎস্য ব্যবসায়ী ও জেলেরা মনে করেন, বঙ্গোপসাগরে অব্যাহত জলদস্যুতা মাত্র ‘এক ঘন্টায়’ রোধ করা সম্ভব। এজন্য কোস্ট গার্ড, নৌ বাহিনী ও বিভিন্ন বাহিনী নিয়ে ‘যৌথ টাস্কফোর্স’ গঠন এবং বঙ্গোপসাগরের প্রতিটি প্রবেশ মুখে কোস্টগার্ড-নৌ বাহিনীর টহল জোরদার করতে হবে।
সম্প্রতি কুতুবদিয়ার দ্বীপের অদূরে বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুর হাতে নির্মমভাবে ৪০ জেলে খুন হওয়ায় ঘটনায় জেলার প্রতিটি জেলে পল্লীতে ‘আতংক’ বিরাজ করছে। সাগরে মাছ ধরতে যেতে ‘ভয়’ পাচ্ছে জেলেরা।
জেলার টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কক্সবাজার সদর, পেকুয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার অন্তত ১০ হাজার ফিশিং ট্রলারে মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ট্রলার ঘাটে ‘নোঙর’ গেড়ে বসে আছে। কারণ সাগরে গেলেই ডাকাতরা তাদের মালামাল, ট্রলারের ইঞ্জিন ও আহরিত মাছ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়; সম্পদ লুটের পাশাপাশি নির্মমভাবে খুনের শিকার হচ্ছে নিরীহ জেলেরা। সাগরে দস্যুদের রাজত্ব আর কুলেও অসহনীয় জীবন সব মিলিয়ে জেলেরা বাধ্য হয়ে জীবন-মৃত্যুর খেলা খেলছে। তবে এজন্য প্রশাসনের দুর্বলতাকেই দায়ী করেছে ট্রলার মালিক ও জেলেরা।
মোহাম্মদ ইউনুছ (২৮) নামে মহেশখালীর গোরকঘাটা এলাকার এক জেলে অভিযোগ করেন, সাগরে কোস্ট গার্ড কিংবা বাহিনী বলতে কিছুই চোখে পড়েনা।
একই অভিযোগ করে জেলে আমান উল্লাহ (২৯) জানায়, সম্প্রতি সাগরের এমন পয়েন্টে ‘ডাকাতি’ হচ্ছে যেখানে কোস্টগার্ড সহজেই টহল দিতে পারে।
বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ মুখে কোস্ট গার্ড ও নৌ বাহিনীর টহল জোরদারের কথা জানিয়েছে জেলা সদরের ট্রলার মালিক আলী হোসেন বহদ্দার (৫৯) জানান, বাঁশখালীর শঙ্খ নদী, ছনুয়া, কুতুবদিয়ার বাতিঘরের পশ্চিমে, আনোয়ারার গহিরা পয়েন্ট, মহেশখালীর সোনাদিয়া, হাঁসের দ্বীপের বাইরের পয়েন্ট, উখিয়ার রেজু খাল সংলগ্ন পয়েন্ট, পাটুয়ারটেক পয়েন্ট সহ যেসব পয়েন্ট দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে জেলেরা যায়। সেসব পয়েন্টে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর টহল জোরদার করতে হবে।
এদিকে ট্রলার মালিক, মৎস্য ব্যবসায়ী ও জেলেরা মনে করেন, মাত্র ‘এক ঘন্টায়’ বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুতা রোধ করা সম্ভব। অর্থাৎ প্রথমে প্রশাসনের উর্ধ্বতন মহল জোরালো উদ্যোগ নিবেন যে ‘আজ থেকে কোন ডাকাত-ই থাকবে না’ বলে। এরপর কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী সহ বিভিন্ন বাহিনীকে নিয়ে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করবেন। পরে তারা একই দিন একই সময় যৌথভাবে ‘এক ঘন্টা’ সাগরে অভিযান চালাবে। এই ‘এক ঘন্টার’ অভিযানে যেমন বহু দস্যু গ্রেফতার হবে তেমনি প্রশাসনের ‘নিয়মিত’ টহল তাদেরকে ডাকাতি করা থেকে বিরত থাকবে।
সেলিম উদ্দিন (৩৬) নামে এক জেলে জানায়, জলদস্যুরা তো সাগরে থাকে না। সাগরে দুস্যতা শেষে কুলে এসেই তারা বাস করে। প্রশাসন তাদেরকে চিনে-জানে। তারপরও জলদস্যুরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
এদিকে কুতুবদিয়া দ্বীপের পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার শেখেরখিল ও ছনুয়া এলাকার ৪০ জন হতভাগ্য জেলে। যাদের মধ্যে শনিবার পর্যন্ত ৩০ জন জেলের মরদেহ রশি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
এই নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনার পর বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বাঁশখালীর কয়েকটি জলদস্যু বাহিনীর সাথে মহেশখালীর দুই জন ইউপি চেয়ারম্যানে ‘সংশ্লিষ্টতা’র অভিযোগ উঠেছে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতোমধ্যে বিষয়টি আমলে নিয়ে ‘গভীরে’ খোঁজ নিচ্ছেন বলে সুত্র জানিয়েছে।
মৎস্য ব্যবসায়ী ও জেলেদের দাবী সরকার শীঘ্রই এসব নিরীহ জেলে পরিবার গুলোকে ‘পুনর্বাসন’র উদ্যোগ নেওয়ার দাবী জানিয়েছেন।
কক্সবাজার মৎস্য ব্যবসায়ী ঐক্য সমবায় সমিতি লি: এর সভাপতি জয়নুল আবেদিন জানিয়েছেন, সাগরে মাছ ধরতে ট্রলার না যাওয়ায় ইতোমধ্যেই মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। এভাবে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে গেলে আমরা ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবো। এজন্য যেসব জেলে দস্যুতার শিকার হয়ে মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছে। তাদেরকে শীঘ্রই পুনর্বাসন করে পুনরায় মৎস্য শিকারে পাঠাতে হবে।
এদিকে সাগরে টহল ও যৌথ টাস্কফোর্স গঠন নিয়ে কথা হলে কক্সবাজার কোস্ট গার্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, গভীর সাগরে টহল কিংবা অভিযানের জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদীর অভাব রয়েছে। যার কারণে গভীর সাগরে নিয়মিত টহল দেয়ার ইচ্ছা থাকা সত্বেও সম্ভব হচ্ছেনা।
তিনি আরো জানান, তবে সরকার চাইলে যে কোনভাবে কোস্টগার্ড গার্ড ও নৌ-বাহিনীকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদী সরবরাহ করতে পারেন।
অপরদিকে যৌথ টাস্কফোর্স নিয়েও প্রশাসনের উপর মহলে ব্যাপক ইতিবাচক আলোচনা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।