parbattanews

বহুল আলোচিত আরাকান আর্মি ‘নেতা’ ডা. রেনিন সোয়ের রহস্যময় জীবন

390781_242972929103146_1338977904_n

স্টাফ রিপোর্টার:

ডা. রেনিন সোয়ে তালুকদার। বাংলাদেশের মিডিয়ায় তিনি আরাকান আর্মির নেতা হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছেন। কিন্তু আসলে কে এই রেনিন সোয়ে? কি তার আসল পরিচয়- এ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। তার পরিচয় বের করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও হতে হচ্ছে গলদঘর্ম। রাঙামাটি জেলার রাজস্থলীর প্রত্যন্ত এলাকায় সুরম্য অট্টালিকা, বাড়ির চারপাশে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাসহ বিশেষ ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, হাতে স্যাটেলাইট ফোন, দামী দামী গাড়ি, কখনো ডাক্তার, কখনো ব্যবসায়ী, কখনো খনিজ সম্পদ কোম্পানী কর্মকর্তা, কখনো এনজিও কর্মকর্তা নানা পেশাজীবী পরিচয় রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মন্ত্রী এমপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী ও সমাজের নেতাদের সাথে তার একান্ত সমপর্ক রয়েছে। অনেকের কাছেই তিনি দানবীর।  বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে তার সম্পর্ক রয়েছে। তাদেরকে তিনি রাঙামাটিতে নিয়ে আসতেন। সম মিলিয়ে রাঙামাটির এক রহস্যময় পুরুষ তিনি। এই রহস্য ঘিরেই স্থানীয়দের মাঝে সৃষ্টি হয়েছিল আগ্রহ। সকলের সাথে এতোই অমায়িক ব্যবহার করতেন যে কারো মনে কখনো খারাপ কিছু আসেইনি।

তবে গত ২৭ আগস্ট বান্দরবানের থানচি উপজেলার বড় মোদকে বিজিবি’র উপর মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ আরাকান আর্মি আক্রমণ করলে সেনাবাহিনী এই ঘরটি ঘিরে ফেলে আটক করে রেনিন সোয়ে এক সহযোগীকে আটক করে। তার কাছ থেকে বাড়ির মালিক ডা. রেনিন সোয়ের নাম ও পরিচয় জানা গেলে রাতামাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি। বহুল আলোচিত আরাকান আর্মির নেতা ডা. রেনিন সোয়ের রয়েছে এক বিশাল বর্ণাঢ্য ও রহস্যময়। পার্বত্যনিউজ অনুসন্ধান করে তার রহস্য ও বর্ণাঢ্যময় জীবনের কিছু তথ্য জানতে পেরেছে।

তার পুরো নাম ডা. রেনিন সোয়ে তালুকদার। জন্মসূত্রে রাখাইন ও বুদ্ধিস্ট। গণমাধ্যমে তাকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসাবে উপস্থাপন করা হলেও তিনি নিজে বরাবরই সে সকল দাবী প্রত্যাখ্যান করে দাবী করেছেন তিনি মিয়ানমারের নয় বাংলাদেশের নাগরিক। প্রমাণ হিসাবে তিনি সামাজিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের জন্মসনদ উপস্থাপন করেন। জন্মসনদ ছাড়াও তার বাংলাদেশী পাসপোর্ট রয়েছে- যা ১৪ অক্টোবর আটক হওয়ার সময় জব্দ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার বাংলাদেশী পাসপোর্ট ও জন্মসনদের সত্যতা নিয়ে সন্দিহান।

জন্ম সনদ অনুয়ায়ী ১৯৬৯ সালের ৭ জানুয়ারী রাজস্থলীর কলেজ পাড়ায় তার জন্ম। তার পিতার নাম উ সান সোয়ে তালুকদার মিয়ানমারে মারা যান। মাতার নাম মা তুন সেইন তালুকদার। ১০-১২ বছর পূর্বে রাঙামাটির রাজস্থলীতে মারা যান। রেনিন সোয়ের শৈশবের কিছুকাল কাটে পটুয়াখালীর রাখাইন পল্লীতে। তবে তার পরিবার কিভাবে বা কেন পটুয়াখালীতে গিয়েছিলেন সে কারণ জানা যায়নি। ১৯৭০-৭১ সালের দিকে সোয়ের পরিবার পটুয়াখালী থেকে মিয়ানমারের স্যালুলে গমণ করেন। তার পূর্ব পুরুষেরা মিয়ানমারের নাগরিক। সেইসূত্রে সেখানে তাদের সম্পদ ও সম্পত্তিও ছিল। সোয়ে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে স্কুল পর্যায়ে পড়াশোনা করে ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৯০ সালে অং  সাং সুকির দল এনডিপিকে বার্মিজ সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে সামরিক সরকার বিরোধী আন্দোলনের সাথে তিনি যোগদান করেন। এভাবেই  তিনি মিয়ানমারের গনতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন।

ছাত্রাবস্থায় মায়ানমারের একাধিকবার তিনি রাজনৈতিক কারণে কারাবরণ করেন।  কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৯০ সালের দিকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে রাঙামাটিতে বসবাস শুরু করেন ডা. রেনিন সোয়ে। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের পেট্রোবাংলার  ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার হিসেবে সিলেটে কর্মরত ছিলেন বলে তিনি দাবী করেছেন। জানা যায়, ১৯৯৭ সালে গ্যাসের খনির সন্ধানের কথা বলে তিনি রাজস্থলীতে আসেন।  ১৯৯৮ সালে তিনি রাঙামাটিতে অংসাই প্রু মারমার মেয়েকে বিয়ে করেন। তার স্ত্রীর নাম হাসি নু মারমা। তার দুইটি কন্যা সন্তান রয়েছে। বিবাহের পর থেকে তিনি রাজস্থলীতে আসতেন এবং লোকজনকে বলতেন, তিনি বিদেশের একজন চিকিৎসক। এভাবেই তিনি নানা পরিচয়ে আড়ালে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন রাঙামাটিতে অবস্থান করেন।

২০০৪ সালের দিকে রাজস্থলী তাইতং পাড়া কলেজ সংলগ্ন এলাকার পশ্চিম তাইতং পাড়া কার্বারি রেনেজু রাখাইন এর শালিকার জামাতা অনুমং মারমার নিকট থেকে ৫০ শতক জায়গা ক্রয় করে আনুমানিক তিন কোটি টাকা খরচ করে তিনতলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়িটি নির্মাণ করেন। কিন্তু বর্তমান তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, জায়গাটি এখনো অনুমং মারমার নামেই রয়েছে। বাড়িটিতে ঢুকতে এবং গেস্টরুমে রয়েছে দুইটি অত্যাধুনিক আইপি সিস্টেম সিসি ক্যামেরা। গত কয়েকমাস আগে রাজস্থলী উপজেলার প্রায় ২০০ ভান্তে নিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রবজ্জ্যা পালন করেন। যেটি একটি ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান। সেখানে বিভিন্ন শ্রেণির প্রায় ২-৩ হাজার মানুষকে আপ্যায়ন করেন। অথচ উপজেলার অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি অনূষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন না। তিনি ২০০১ সালে বাংলাদেশ থেকে নেদারল্যান্ড গমন করেন। সেখানে নিউরো সার্জারি বিষয় পড়াশুনা করেন। এসময় তিনি নেদারল্যান্ডের নাগরিকত্ব লাভ করেন। ২০০৬ সালে তিনি স্ত্রী সন্তানদের নেদারল্যান্ড  নিয়ে যান। তার স্ত্রী নেদারল্যান্ডের একটি ব্যাংকে চাকরী করেন এবং সন্তানদের নিয়ে সেখানেই বসবাস করেন।

আরাকান আর্মি নেতা হিসাবে তাকে বলা হলেও তিনি এ বাহিনীর কোনো নেতা নন। বরং ২০১৪ সালে রেনিন সোয়ে আরাকান আর্মির এডভাইজার নিযুক্ত হন। তার ইউরোপীয় কানেকশেনের জন্যই আরাকান আর্মি তাকে এ পদে নিয়োগ দেয়। বাংলাদেশে থাকলে বেশিরভাগ সময় তিনি ঢাকাতেই থাকতেন বলে তার দাবী। বাংলাদেশ বিজনেস সেন্টার বা বিবিসি নামে তার একটি ব্যবসা কোম্পানী রয়েছে। তবে এ বিষয়ে অধিক কিছু জানা যায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি. রাজা, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের প্রধানসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে তার দহরম মহরম ছিল। এ সম্পর্কের কিছু ছবি তিনি নিজেই তার ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কৌশলগত কোনো বিনিময় ও সহযোগিতা ছিল কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে রেনিন সোয়ে’র বাড়ি থেকে উদ্ধারকৃত ল্যাপটপ থেকে পাওয়া এক চিঠিতে দেখা গেছে, তিনি এম এন লারমা নামে পার্বত্য জন সংহতি সমিতির এক শীর্ষ নেতার কাছে নিজেকে আরাকান আর্মির নেতা পরিচয় দিয়ে লিখেছেন।

চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ২৪ জুলাই ২০১৫ তারিখে আরাকান আর্মির সদস্য আই থোয়াইকে শান্তি বাহিনীর সদস্য সাই থোয়াই আটক করে তার উপর নির্যাতন চালিয়েছে। তার উপর নির্যাতন না চালিয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে আরাকান আর্মির সাথে সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান করা হয়। অন্যথায় পিসিজেএসএসকে পরিণতি ভোগ করার হুমকিও দেয়া হয়েছে চিঠিতে। চিঠিটি এম এন লারমার কাছে পাঠানো হলেও এমএন লারমা অনেক আগেই মারা গেছে। তবে এমএন লারমা সাংকেতিক নাম দিয়ে পিসিজেএসএস’র কোনো শীর্ষ নেতার কাছে পাঠানো হয়েছে বলে ধারণা করছে সংশ্লিষ্টরা। এতে প্রমাণিত হয় পিসিজেএসএসের কোনো কোনো নেতা রেনিন সোয়ের আরাকান আর্মির সম্পৃক্ততা জানতো।

উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট বান্দরবানের থানচির তিন্দু ও আন্দারমানিক এলাকায় আরাকান আর্মির জন্য ক্রয়কৃত দুই দফায় ১৩টি ঘোড়া আটক করে বিজিবি। এ ঘটনার জের ধরে ২৭ আগস্ট সকালে বড় মদকের দোলিয়ান পাড়া বিজিবি ক্যাম্পে মিয়ানমারের আরাকান আর্মি (এ, এ) সদস্যরা হামলা চালায়। এতে জাকির হোসেন ও আহম্মদ গনি আহত হন। বিজিবির সদস্যরাও পাল্টা গুলি এবং মর্টারশেল ছোঁড়েন। বিমান বাহিনীর ৫টি হেলিকপ্টার ও জঙ্গী বিমান এ হামলায় ব্যবহৃত হয়। পরে সেনাবাহিনী ও বিজিবির তীব্র প্রতিরোধের মুখে সন্ত্রাসীরা পিছু হটে।

এ ঘটনার পর আলোচনায় আসেন ডা. রেনিন সোয়ে। জানা যায়, রেনিন সোয়ে আরাকান আর্মির জন্য এই ঘোড়াগুলো ক্রয় করে বান্দরবানে পাঠিয়েছিলেন। একই দিন অর্থাৎ ২৭ আগস্ট গোপন সূত্রে খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর একটি দল রাজস্থলীর কলেজ পাড়া এলাকার স্থানীয় রেনিন সোয়ের বাসায় অভিযান চালায়। এসময় তাকে আটক করা না গেলেও মিয়ানমারের নাগরিক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সহযোগী অং ইউ ইয়াং রাখাইনকে আটক করে সেনাবাহিনীর দলটি। বাড়ীতে তল্লাশী চালিয়ে তিনটি আরাকান আর্মির পোশাক, পোশাক তৈরির ৩০ গজ কাপড়, তিনটি ল্যাপটপ, মোডেম, দুইটি ডিজিটাল ক্যামেরা, একটি হেন্ডিক্যাম, দুইটি ঘোড়া, তিনটি মটরসাইকেল, মোবাইল ও পার্সপোট পাওয়া যায়।

ঐ দিন ডা রেনিন সোয়েসহ তার সহযোগি ও কেয়ারটেকারের বিরুদ্ধে রাজস্থলী থানায় সন্ত্রাস দমন আইন ও অবৈধ অনুপ্রবেশ আইনে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। ঐ দুই মামলার পলাতক আসামী ছিলেন ডা. রেনিন সোয়ে।

জানা যায়, আটকের আগ মুহুর্তে রেনিন সোয়ে তার বাড়ি থেকে পালাতে সক্ষম হন। এর পর তিনি বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে বিবৃতি, ছবি, ডকুমেন্ট ও ভিডিওবার্তার মাধ্যমে তার কাজের সপক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। ভাইবার ও স্কাইপি’র মাধ্যমে একাধিক বার্তা সংস্থার কাছে স্বাক্ষাৎকার দেন। তিনি পার্বত্যনিউজকেও একটি সাক্ষাৎকার দেন যা অনিবার্য কারণে প্রকাশ করা হয়নি।  একটি স্যাটেলাইট ফোন নম্বরের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে তিনি গণমাধ্যমকে নিজের অবস্থান সম্পর্কে জানান, তিনি চীনে অবস্থান করছেন। তার এই দাবী সংশ্লিষ্ট কেউই বিশ্বাস করেনি। তবে তিনি ঠিক কোথায় অবস্থান করছিলেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে। কারো মতে, এই সময়ে তিনি ভারতের দিল্লীতে গিয়ে আবার ফিরে আসেন। আবার কারো মতে, বেনপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাবার চেষ্টা করেও তিনি সফল হননি।  চলমান রিমান্ডে তার সঠিক অবস্থান জানা যাবে। এভাবে দীর্ঘ দেড় মাস পলাতক থাকার পর মঙ্গলবার ভোর রাতে পুলিশ ও বিজিরি হাতে রাজস্থলীতে আটক হন তিনি।

১৩ অক্টোবর মঙ্গলবার রাত প্রায় সাড়ে তিন টায় দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বর্ডার গাড বাংলাদেশ বিজিবির মেজর শাব্বির আহমেদ, মেজর কামাল পাশা ও রাজস্থলী থানার পুলিশসহ যৌথ অভিযান চালিয়ে ইসলামপুরের একটি নির্মানাধীন মসজিদ আত্মগোপন করে থাকা অভিযুক্ত মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মীর নেতা রেনিন সুয়ে মারমাকে আটক করা হয়েছে। এসময় তল্লাশী চালিয়ে তার কাছ থেকে ৫০টি ৫০০ টাকার নোটের ভারতীয় রুপি, বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডের পার্সপোট, একটি ল্যাপটপ কম্পিউটার,  ২টি মোবাইল সেট, তিনটি ক্রেডিট কার্ড আর একটি ব্যাগে ব্যবহৃত পোশাক উদ্ধার করা হয়েছে। আটকের পর বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ আরাকন আর্মির নেতা ডা. রেনিন সোয়েকে আদালতে হাজির করে তার বিরুদ্ধে ১০দিনের রিমান্ডের আবেদন করে। তবে রাঙামাটি জজ আদালতের অতিরিক্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট সাবরিনা আলী’র শুনানী শেষে ৫দিনে রিমান্ড আদেশ প্রদান করেন। বর্তমানে তিনি রিমান্ডাধীন।

Exit mobile version