parbattanews

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বানিজ্য ২১ বছরে পদার্পণ

u

মুহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান:
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বানিজ্য ২০ বছর পেরিয়ে ২১ বছরে পর্দাপন করেছে। মিয়ানমার সাথে বিশাল বানিজ্য ঘাটতি নিয়ে চলছে এ সীমান্ত বানিজ্য। মিয়ানমার থেকে পণ্য আমদানী বৃদ্ধি পেলেও দেশীয় পণ্য রপ্তানী কম হওয়া এ ঘাটতির মূল কারণ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। প্রতি বছর দু’দেশের মধ্যে বানিজ্য ঘাটতির পরিমান বেড়েই চলছে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারনে দু’দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক হলেও রপ্তানীতে সুফল আসছেনা।

তবে বাণিজ্য থেকে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করলেও এখনো পরিপূর্ণ বন্দর গড়ে ওঠনি। স্বল্প পরিসরে শুরু হওয়া এই সীমান্ত বাণিজ্য আজ সম্ভাবনাময় একটি বিশাল ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। পাঁচ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বানিজ্য ২০বছর পেরিয়ে ২১বছরে পদার্পণ করলেও বাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা কোন আয়োজন করতে দেখা যায়নি।

সংশ্লিষ্ট শুল্ক বিভাগ জানায়, সীমান্ত বাণিজ্য শুরু হওয়ার ১৯৯৫-৯৬ অর্থ বছর থেকে ২০১৪-১৫ অর্থ বছর ও ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের আগস্ট পর্যন্ত ২০ বছরে মিয়ানমার থেকে ৩০১১কোটি ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৯৭৬ টাকার পণ্য আমদানি করা হয়। তবে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১৪৭ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ৯৯ টাকার পণ্য রপ্তানি করা হয়। ফলে সরকার মাত্র ৯৩৪ কোটি ৪৩ লাখ ৭ হাজার ৩৩১ টাকার রাজস্ব আদায় করে। এর ফলে সীমান্ত বানিজ্যে ২৯৯৬ কোটি ৩৯ লাখ ২৫ হাজার ৩৭৭ টাকার ঘাটতি দাঁড়ায়। দু দেশে চোরাচালান বৃদ্ধির কারনে রপ্তানি কম হওয়ায় সীমান্ত বানিজ্য ব্যবসা ২০ বছরে বিশাল এ ঘাটতির মধ্যে রয়েছে।


এদিকে মিয়ানমার সাথে সুসম্পর্ক ও সীমান্তে চোরাচালান বন্ধে ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সীমান্ত বাণিজ্য চালু করা হয়। সীমান্ত বাণিজ্য হাঁটি হাঁটি পা পা করে ২১ বছরে পদার্পন করেছে। প্রথমত বানিজ্য ব্যবসায় দু’দেশের অবস্থান কাছাকাছি থাকলেও পরবর্তী বছর থেকে মিয়ানমার থেকে আমদানী বৃদ্ধি পেলেও রপ্তানী হয়েছে খুবই নগণ্য। যার ফলে বানিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বাড়তে থাকে। বৈধ বানিজ্যের পাশাপাশি চোরাচালান বেড়ে যাওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া সীমান্ত বাণিজ্যের গতিশীলতার লক্ষে দু’দেশের সীমান্ত সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বর্ডার ট্রেড জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়ে ৮টি সভা হয়েছে। এতে সীমান্ত বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও সমস্যা দূরীকরণ, সুপারিশ এবং প্রস্তাব তৈরিসহ বর্ডার হাট চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সীমান্তরক্ষী বিজিবি সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার চোরাই পণ্য আটক করে। তার পরও চোরাচালান থেমে নেই। সরকারী রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চোরাকারবারীরা পণ্য পাচার করে যাচ্ছে। তাছাড়া সীমান্তে একাধিক হুন্ডি ব্যবসায়ী রয়েছে। রপ্তানী পণ্য না নিয়ে এ সব হুন্ডি ব্যবসায়ীর মাধ্যমে পণ্য রপ্তানীর টাকা চোরাই পথে মিয়ানমার পাচার করা হচ্ছে। যার ফলে হুন্ডির মাধ্যমে সহজে টাকা পৌছে যাচ্ছে। এ সব অশুভ প্রভাবের কারণে সীমান্ত বানিজ্যে ঘাটতি বেড়ে চলছে। তবে বাণ্যজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে সরকারী উদ্যোগ জরুরী বলে মনে করছেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা।

টেকনাফ শুল্ক স্টেশন দিয়ে আমদানিকৃত পণ্য হিমায়িত মাছ রুই, কাতাল, ইলিশ, শুটকী মাছ, বিভিন্ন প্রকার কাঠ, বরই আচার, শুকনা বরই, টক তেতুল, প্লাস্টিক, বাঁশ, বেত, মাসকলাই, মুগ ডাল, ফেলন ডাল, ছোলা, রিটা, হলুদ, পেঁয়াজ, আদা, চিকন জিরা, কাঠের তৈরী কিচেন ওয়্যার, তুলা, সুপারী, তরমুজ, বাম, বেড লিনেন, সাবান, লবঙ্গ, শীট, শিমের বিচি, মিষ্টি জিরা (মৌরী), ছাতা, সেনেকা মাটি, গরুর চামড়া, শিমুল তুলা, গাছের ছাল, তেতুল বিচি, ক্রিম, গরু, মহিষ, ছাগল।

রপ্তানিকৃত পণ্য সিমেন্ট, গেঞ্জি, গেঞ্জির কাপড়, দেশীয় কাপড়, প্লাস্টিক পাইপ, মানুষের চুল, এ্যালুমিনিয়াম প্রোডাক্টস, হাঙ্গর মাছ ও চামড়া, অক্স পেনিস, পাইস্যা মাছ, প্লাষ্টিক স্পিল্ডার, ফেয়ার এন্ড লাভলী, টিউবওয়েল,পাতলা কম্বল, গাজী প্লাষ্টিক ট্যাংক, মেডিসিন, ভেন্ডা ট্রিজ (রাসনা), দেশী টাওয়াল, শুটকী মাছ, চারকল মেশিন, প্লাস্টিক প্রোডাক্টস, তিলের দানা, কালারড পেপার, দেশী পলিথিন, সুতলী, সুগন্ধি হেয়ারওয়েল, সেভিংস ক্রীম, মেহেদী, ঘামাচি পাউডার, দেশী শুকনা মরিচ, মেলামাইন প্রোডাক্টস, টুথ পাউডার, সাবান, দেশী বোরকা, বাটা সু, ট্যাং, গাজী পাম্প, দেশী লুঙ্গি, জুট ব্যাগ, বিস্কুট, চানাচুর, সফ্ট ড্রিংকস, ওয়াল ঘড়ি, দেশী ইমিটেশন জুয়েলারী, ফিস প্যাকিং এসোস, কিচেন ওয়্যার অব উড, কিচেন ওয়্যার অব আইরন, দেশী সেমাই, আলু, দেশী আইরন গ্রীল, টাইলস, প্লাস্টিক ডোর, সিরামিক বাথস (কমেট), দেশী তিল, মুড়ি, বেবী শার্ট এন্ড প্যান্ট, মেন শার্ট, প্লাষ্টিক টর্চলাইট, ছাতা, টুপি, সিরামিক বেসিন, বাই সাইকেল রিম্স, এস,এস স্টীল পাইপ।

এ প্রসংগে টেকনাফ স্থল বন্দরের ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট এর ব্যবস্থাপক আবু নুর খলিদ জানান- মিয়ানমারের পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এখন মিয়ানমারের সাথে বাণিজ্য করতে তেমন আগ্রহী নয়। কারন আমদানী-রপ্তানী পরিমাণ কমে যাওয়ায় মিয়ানমারে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার সংকুচিত হয়ে আসছে।

তিনি আরো জানান, টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন চোরাই পয়েন্ট দিয়ে দু’দেশের বিভিন্ন পণ্য চোরাচালানের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় স্থল বন্দর  দিয়ে পণ্য আসা যাওয়া কমে গেছে। বিশেষ করে কায়ুকখালী খাল, নাইট্যং পাড়া, টেকনাফের লামার বাজার, সাবরাং, নয়াপাড়া,  ও শাহপরীরদ্বীপের জালিয়াপাড়া ও ঘোলা পাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে মালামাল পাচার হচ্ছে সর্বাধিক।

স্থল বন্দর ব্যবসায়ী মো: হাশেম জানান, স্থল বন্দরে বিরাজমান সমস্যা, মিয়ানমার জাতিগত সংঘাত ও মাদক ইয়াবার প্রভাবে সীমান্ত বাণিজ্যে প্রভাব পড়ে। তবে সড়ক ভাঙ্গন, বাণিজ্য পণ্য পরিবহন সমস্যা, অবকাঠামো সংকট, পণ্য খালাস ও লোড-আনলোড স্থানে ছাউনি স্থাপন, পণ্য খালাসে যন্ত্রপাতি ব্যবহারের দাবী জানান। তবে মিয়ানমার সাথে আগের মত ব্যবসা করা যাচ্ছেনা। মিয়ানমার ব্যবসায়ীরা সহজে প্রবেশ করে ব্যবসা করতে পারলেও আমরা মিয়ানমার বাজারে ডুকে ব্যবসা করতে পারছিনা। তাছাড়া রপ্তানী বৃদ্ধি করতে হলে মিয়ানমার বাজারে দেশীয় পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ সব সমস্যা সমাধান না হলে এ অবস্থা বিরাজমান থাকবে বলে জানিয়েছেন।

টেকনাফ স্থলবন্দর সিএনএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ স¤পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর জানান, সীমান্ত বানিজ্য ব্যবসা ২১ বছরে পর্দাপন করলেও নানা সমস্যা জর্জরিত। এ সব সমস্যার পরও সীমান্ত বানিজ্য ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে চোরাচালান বৃদ্ধির ফলে মিয়ানমারে পন্য রপ্তানী কম হচ্ছে।
তাছাড়া মিয়ানমারে সমস্যার কারণে সীমান্ত বাণিজ্যে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। দু দেশের সীমান্তে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ হলে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে জানিয়েছেন।

টেকনাফ স্থল বন্দর, শুল্ক কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির জানান, সীমান্ত বানিজ্য ব্যবসা প্রসারতা লাভ করছে। বর্তমানে রপ্তানীতে নতুন পন্যের সংখ্যা বাড়ছে তাই রপ্তানীও অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বানিজ্যের বিশাল ঘাটতি দূর করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সীমান্ত বানিজ্যে বর্তমান অবস্থা বলবৎ থাকলে ব্যবসায় গতি ফিরে আসবে। এ বানিজ্যের ঘাটতি থেকে বেড়িয়ে আসতে ব্যবসায়ীসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেন ।

ইদানিং ইয়াবা চোরাচালানের বিরূপ প্রভাব, বন্দরে শ্রমিকসহ বহুমূখী সমস্যার কারণে টেকনাফ স্থল বন্দর কাস্টমস রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মূখ দেখছেনা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সীমান্ত বাণিজ্যের কয়েকজন প্রবীণ ব্যবসায়ী জানান, গত ৫ বছরে মিয়ানমার থেকে বানের স্রোতের মত ইয়াবা প্রবেশ করছে। এ ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় ব্যবসায়ীরা সেদিকে ঝুঁকছে।  এছাড়া চোরাই পথে পণ্য আসা যাওয়া  এবং ইয়াবা ব্যবসা বিস্তারের কারনে মুদ্রার মান কমে যাওয়া ও বানিজ্য হ্রাস পাওয়া এর অন্যতম কারণ বলে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের ধারণা। বানিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে ও পন্য রপ্তানী বৃদ্ধিতে দেশীয় ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা খুব দ্রুত উদ্যোগ না নিলে টেকনাফ স্থল বন্দর এক সময়ে অচল হয়ে পড়বে বলে মনে করেন সচেতনমহল।

Exit mobile version