পর্ব-১
১৪শত বছরেরও অধিককালের পুরাতন বাংলা নববর্ষ এবারো এসেছে আমাদের জাতীয় জীবনে। কর্পোরেট ধামাক তাতে এনেছে নতুন জৌলুস। তবে বাংলা নববর্ষ পূর্বে পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসাবে। প্রথমে একে ফসলী সন বলা হতো। কৃষিকাজের সুবিধার্থে মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ ঈসাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন চালু করেন। ১৫৫৬ ঈসাব্দের ৫ নভেম্বর আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময়কাল থেকে হিজরী চান্দ্র সনকে ভিত্তি করে বাংলা সৌরসন প্রবর্তিত হয়। এ সময় এটি বঙ্গাব্দ বলে পরিচিত হতে থাকে।
জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত পহেলা বৈশাখ নববর্ষ উৎসব পালিত হতো। তখন বাংলার কৃষকেরা চৈত্রমাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার ও ভূ-স্বামীদের খাজনা পরিশোধ করতো। পরদিন বা নববর্ষে জমিদারগণ কৃষক বা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে জমিদার বাড়ি প্রাঙ্গণে মেলা বসত। মেলায় স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সকলপ্রকার হস্তশিল্পজাত, মৃৎশিল্পজাত ও নিত্য প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী এবং বাংলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির পসরা বসতো। অন্যদিকে মেলা উপলক্ষে জমিদার বাড়ির আঙিনায় যাত্রা, পালাগান, জারীগান, কবিগান, বিচার গান, গাজীর গানসহ বিভিন্ন লোক সঙ্গীতের আসর বসতো। এছাড়াও পুতুল নাচ, নাগর দোলা, নৌকা বাইচ, ঘোড় দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, ঘুড়ি ওড়ানোসহ নানা প্রতিযোগিতা চলতো নববর্ষের উৎসবকে ঘিরে। এককথায় নববর্ষকে ঘিরে সমগ্র বাংলা জেগে উঠতো উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে।
বাংলা নববর্ষের উৎসবে আরেকটি মাত্রা যুক্ত করে ব্যবসায়ীদের হাল খাতা। গ্রামগঞ্জের হাট বাজারের ব্যবসায়ীরা এদিন তাদের একটি বছরের পুরাতন ব্যবসায়িক লেনদেনের হিসাব চুকিয়ে নতুন খাতা খোলেন। এ উৎসব তাদের কাছে হালখাতা নামে পরিচিত। হালখাতা উৎসবে ব্যবসায়ীরা ক্রেতারদের আমন্ত্রণ করেন তাদের দোকানে। ক্রেতাগণ এদিন গত এক বছরের বাকী পরিশোধ করেন আর ব্যবসায়ীগণ ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা সম্পর্ক নবায়নের নতুন খাতা- হালখাতা খোলেন। এভাবেই পহেলা বৈশাখ সার্বজনীন বাংলাভাষীদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
কিন্তু এই ঢাকা শহরেই বৈশাখের হালখাতা হয় দুই দিনে। ইসলামপুর আর শাঁখারী বাজার হাঁটা পথে ১০ মিনিটের দুরত্ব। একই বাঙালী পরিচয়ে গর্বিত হওয়া সত্ত্বেও পহেলা বৈশাখ পালনের ব্যবধান চব্বিশ ঘন্টার। সহস্র বছর একই আবেগ ও ইতিহাসে পাশাপাশি বাস করেও এই চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধান কখনো ম্লান হয়নি। ১৯৪৬ সালে যেমন আমরা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের সাথে থাকতে চাইনি কিম্বা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরা আমাদের সাথে থাকতে চায়নি; বরং ভোট দিয়ে আমরা বেছে নিয়েছি শত শত মাইল দুরের পিন্ডি ও দিল্লীকে।
আজও তেমনি শাখারী বাজার ইসলামপুরের সাথে পহেলা বৈশাখ বা হালখাতা পালন না করে একদিন পর শত শত মাইল দুরের বাগবাজারের সাথে উদযাপন করে। এর মূল কারণ দুইটি পঞ্জিকা। মোহাম্মাদী পঞ্জিকা ও লোকনাথ পঞ্জিকা। আক্ষরিক অর্থে এ শুধু দুই পঞ্জিকার দ্বন্দ্ব নয়। এর পেছনে রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্ম বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। তসবিহ আর জপমালার মতোই তা আলাদা রয়ে গেছে হাজার বছর ধরে। বাঙালীত্বের রাখী বেঁধে তাকে এক করার চেষ্টা আজকের মতোই চলছে বহুকাল ধরে। কিন্তু তসবিহ কখনো জপমালা হয়নি, জপমালাও তসবিহ নয়। মোহাম্মদ ও লোকনাথের এই সাতন্ত্র সহস্র বছর ধরেই একই নদীর দুই স্রোতধারার মতো বয়ে চলেছে বাঙালী শোনিতে।
কালের বিবর্তন, ঋতুর পরিবর্তন আর প্রযুক্তির উন্নয়নে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের লোকজ আঙ্গিকে কিছু পরিবর্তন হয়তো এসেছে কিছু তাতে উৎসবের উদ্দামতা কমেনি এতোটুকু বরং বেড়েছে বহুগুণে। তাইতো নববর্ষের উৎসবে ফায়দা লুটতে এগিয়ে এসেছে আধুনিক বাজার অর্থনীতির ধারক কর্পোরেট কোম্পানীগুলো। পহেলা বৈশাখে তারা বাজারে আনে নতুন ফ্যাশনের পোশাক, প্যাকেজ ইত্যাদি। এভাবেই বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপনে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে শত শত বছর ধরে।
কিন্তু রাজধানীতে রমনাপার্কে অশ্বত্থবৃক্ষের(বটমূল নয়) বেদীমূলে মাঙ্গলিক গান গেয়ে নববর্ষ বরণের যে কালচার অথবা রেওয়াজ চলছে তার ইতিহাস খুব বেশী দিন নয়। ১৯৬৭(মতান্তরে ১৯৬৫) সালে ছায়ানট শিল্পীগোষ্ঠী এর প্রবর্তন করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর থেকে পাকিস্তানে রবীন্দ্র চর্চা নিয়ে বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে বিভেদ তৈরী হয়। এই বিভেদের মধ্যেই ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদসহ কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে পূর্বপাকিস্তানে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হয়।
রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের পর আয়োজক কিছু রবীন্দ্রভক্তের উদ্যোগে সেবছরই ছায়ানট প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন রেডিওতে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। খাজা শাহাবুদ্দিনের এই ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র চর্চা নিয়ে চলমান বিভেদ নতুন করে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। মূলতঃ তৎকালীন সরকারের রবীন্দ্র চর্চা নিষিদ্ধ নীতির বিরোধিতা করেই ছায়ানট রমনার অশ্বত্থমূলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৯৬৭ সালে। সুতরাং এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রমনার অশত্থমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবের একটি রাজনৈতিক দিকও রয়েছে।
তবে রমনা পার্কে ছায়ানট এই বাংলা নববর্ষ বরণে যে বিশেষত্ব নিয়ে আসে তার সাথে কয়েক শত বছর ধরে এ অঞ্চলের মানুষ যেভাবে বাংলা নববর্ষ পালন করে আসছে তার খুব বেশী মিল নেই। পূর্ব বাংলায় বাংলা নববর্ষ উৎযাপনের শত বছরের ঐতিহ্য ধারার বর্ণনা উপরে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবে তার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে সূর্যোদয়ের পূর্বে তাদের নিজস্ব শিল্পী গোষ্ঠি নিয়ে রমনা পার্কে লেকের পাড়ে অবস্থিত অশ্বত্থবৃক্ষের বেদীমুলে সূর্যদেবের উদয়ের অপেক্ষায় থাকে। যখন পূর্ব আকাশে সূর্য উদিত হয় তখনই ছায়ানটের শিল্পীরা তার কাছে নিখিল ও অখিলের কল্যাণ কামনায় গেয়ে ওঠে নানা মাঙ্গলিক এবং প্রার্থনা মূলক সঙ্গীত:
‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে, নির্মল কর, উজ্জল কর, সুন্দর করো হে…..’।
গত বছর ছায়ানট বাংলা বর্ষবরণ শুরু করেছে সারদে রামকেলীর সুর বাজিয়ে। ছায়ানটের এই গান নির্বাচনেও একটি বিশেষত্ব লক্ষ্যণীয়। অনুষ্ঠানে যেসব গান গাওয়া হয় এবং কবিতা আবৃত্তি করা হয় তার শতকরা ৯০ভাগ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবং বাকী ১০ ভাগ অন্যান্য কবি বা গীতিকারের। সন্দেহ নেই রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি। সুতরাং তার কবিতা বা গান গাওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। প্রশ্ন উঠছে এই কারণে যে, ছায়ানটের এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের সেই গানগুলোই বেছে নেয়া হয় যে গানগুলো মূলতঃ হিন্দু দেবদেবীর কাছে মঙ্গল কামনা করে বা ঐসব দেবদেবীর স্তুতি কামনা করে লেখা হয়েছে। ছায়ানটের অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলামের যে দু’একটি গান গাওয়া হয় তাও ঐ শ্যামা সঙ্গীত। এমনকি অন্যান্য কবিদের যেসব গান নির্বাচন করা হয় সেগুলোরও প্রধান উপজীব্য উপনিষদ ও হিন্দু পুরাণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনার প্রধান দুটি উপজীব্য বিষয় হচ্ছে প্রেম ও প্রার্থনা। সন্দেহ নেই, তার প্রার্থনা ছিল উপনিষদ, পুরান ও বেদ-এ বর্ণিত দেবদেবীর কাছে। এর বাইরে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হবার পর রবীন্দ্রনাথ অনেক দেশাত্মবোধক গান লেখেন সনাতনধর্মী সবাই যাতে তার মতো বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয় এবং সে আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে। রঙ্গলালসেন-ঈশ্বরগুপ্ত-বঙ্কিমচন্দ্রের উত্তরসূরী রবীন্দ্রনাথ সে কারণে দেশকে মায়ের সাথে তুলনা করেছেন। সনাতন ধর্মে দেবীগণ মাতৃরূপে কল্পনা করে পূজিত হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ তার এই সব দেশাত্মবোধক গানে নানা উপমা, চিত্রকল্প, অলঙ্কারের মাধ্যমে দেশের সাথে ও দেবীমাতাকে এত সার্থকতার সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন যে তাকে আলাদা করে বুঝতে গভীর অভিনিবেশ প্রয়োজন। আর্ট বা শিল্পে কিভাবে ভারতীয় ট্রাডিশন ঢোকানো যায় রবীন্দ্রনাথ তা শিখতে শান্তি নিকেতনে নন্দলাল বসুর কাছে ছবি আঁকা শিখতে গিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথের কাছে ভারতীয় ট্রাডিশন মানে সনাতনী ঐতিহ্য- যার উৎস উপনিষদ। সেকারণে তার পূর্বসূরী ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র ‘দেশ মাতাকে’ ‘কালী মাতার’ স্থানে কল্পনা করে যেমন লিখেছেন,
‘বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে, মন্দিরে….বন্দে মাতরম’।
১৮৯৬ সালে কলিকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠে সংকলিত এই বন্দেমাতরম গানটিতে সুররারোপ করে গেয়ে শোনান। বঙ্কিমচন্দ্র তখনো জীবিত। তিনি নিজেও রবীন্দ্রনাথের সুরে ও কন্ঠে এই গান শুনে তাতে অনুমোদন দেন। তারপর থেকে এই গানটি ভারতের জাতীয় সংগীত করার দাবী উঠলে মুসলমানরা এতে তীব্র আপত্তি তোলেন। এ প্রসঙ্গে সুভাষ চন্দ্র বসু রবীন্দ্রনাথের মতামত চাইলে এক চিঠিতে তিনি সুভাষ চন্দ্র বসুকে লেখেন, ‘বন্দে মাতরম গানের কেন্দ্রস্থলে আছে দূর্গার স্তব এ কথা এতই সুস্পষ্ট যে, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক চলে না।
অবশ্য বঙ্কিম এই গানে বাংরাদেশের সঙ্গে দূর্গাকে একাত্ম করে দেখিয়েছেন, কিন্তু স্বদেশের এই দশভূজামূর্তি রূপের যে পূজা সে কোনো মুসলমান স্বীকার করে নিতে পারেনা।’ (‘ভারতের জাতীযতা এবং আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ’ চতুর্থ খণ্ড, কলিকাতা, পৃষ্ঠা- ২৫৩-২৫৪ দ্রষ্টব্য।) একই বিষয়ে জওহরলাল নেহেরুকে লেখা এক পত্রে তিনি আরো লেখেন, ‘…আমি অনায়াসে স্বীকার করি যে, বঙ্কিমচন্দ্রের সমগ্র ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীতটি যদি উহার অন্যান্য ইতিহাসের সহিত পড়া যায় তাহা হইলে উহার এমন অর্থ করা যায় যাহার ফলে মুসলমানদের মনে আঘাত লাগিতে পারে’। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ২৬১ দ্রষ্টব্য)।
এমনকি একই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্ধদেব বসুকে রেখা এক পত্রে আরো বলেন, ‘…তুমি কি বলতে চাও, ‘তং হি দূর্গা’, ‘কমলা কমল দল বিহারিনী’, বাণী বিদ্যাদায়িনী’ ইত্যাদি হিন্দু নামধারিণীদের স্তব যাদের ‘প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে’ সার্বজাগতিক গানে মুসলমানদের গলাধকরণ করাতেই হবে। হিন্দুর পক্ষে ওকালতি করা হচ্ছে এগুলি আইডিয়া মাত্র। কিন্তু যাদের ধর্মে প্রতিমা পূজা নিষিদ্ধ তাদের কাছে আইডিয়ার দোহাই দেবার কোনো অর্থই নেই।’ (রবীন্দ্রনাথের চিঠি বুদ্ধদেব বসুকে, ‘দেশ’ সাহিত্য সংখ্যা ১৩৮১ দ্রষ্টব্য)।
বিষ্ময়কর হলো এতোকিছু বলার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই লিখলেন,
‘ডান হাতে তোর খড়গ জ্বলে, বা হাত করে শঙ্কা হরণ।’
স্বর্গ থেকে মর্তে দেবী দূর্গার অধিষ্ঠানে তাকে স্বাগত জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী !
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে !
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।
ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,
দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ।
ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে’।।
এ গান প্রসঙ্গে প্রবোধ চন্দ্র সেন তার ‘রবীন্দ্র ভাবনায় বিশ্ব শক্তির মাতৃরূপ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘এই সময়েই ‘ভাণ্ডার’ পত্রিকায় আরেকটি গান প্রকাশিত হয় ‘মাতৃমুর্তি’ নামে, ‘বন্দেমাতরম’ গানে দেশ মাতৃকার যে রূপকল্পনা প্রকাশ পেয়েছে, রবীন্দ্রনাথের এই ‘মাতৃমুর্তি’ গানটিতে সেই রূপকল্পনাই উদ্ভাসিত হয়েছে এই অপূর্ব আভাময়তার মধ্যে। … গানটির প্রথম অংশটির মধ্যে শারদীয়া দেবীমূর্তিটি যেন নবদেহ পরিগ্রহ করেছে স্বদেশের মাতৃমর্তি রূপে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘তং হি দূর্গা দশপ্রহরণধারিনী’ কিম্বা ‘ তোমারি প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে’ ইত্যাদি কল্পনার ভাবসত্তাটুকু নতুন প্রভায় দীপ্যমান হয়ে উঠেছে এই মাতৃমূর্তি কল্পনার মধ্যে। বস্তুত এই গানটি যেন বন্দেমাতরম গানের শেষাংশের রবীন্দ্রভাষ্য।’ (রবীন্দ্র ভাবনায় বিশ্বশক্তির মাতৃরূপ, প্রবোধ চন্দ্র সেন, পৃষ্ঠা-২১৯ দ্রষ্টব্য)।
অথচ অর্ধশতাব্দির অধিককাল ধরে রবীন্দ্রনাথের এই ‘মা’(দেবী) কে দেশমাতা বলে পূজিত করানো হচ্ছে বাংলাদেশী মুসলমানদের।
কিন্তু আমলে এই ‘মা’ টি কে? আমরা নিজেরাও যদি গানের বাণী বিশ্লেষণ করি তাহলে সহজেই বুঝতে পারবো কার ডান হাতে খড়গ জ্বলে, বাম হাতে শঙ্কা হরণের বরাভয়। ত্রিলোচনা কোন মায়ের দুই চোখে স্নেহের হাসি আর তৃতীয় বা ললাট নেত্রে অগ্নিবরণ। সে দেবী দূর্গা, পার্বতী। আসলে এটি ষষ্ঠী পূজায় দেবী দূর্গার এই আবাহন গীত। বিভিন্ন স্থানে এ গান গাওয়া হয়েছে নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে।
‘শ্যামলবরণ কোমলমূর্তির’ কালীদেবী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে ‘সকল সহা সকল মহা মাতার মাতা’ হতেই পারে, তারা তাকে শত সহস্র প্রণতি জানাতেই পারে। কিন্তু সেই ‘বিশ্বময়ী-বিশ্বমাতা’ কালীদেবীর আচঁল পাতা মাটিতে কোনো মুসলমান মাথা ঠেকাতে পারেনা। এ গানটিরও নির্বাচিত কয়েকটি লাইন এখানে উল্লেখ প্রয়োজন:
‘ও আমার দেশের মাটি তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা
তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।
তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে
তুমি মিলেছ মোর মনে প্রাণে
তোমার ঐ শ্যামল বরণ কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা।
ওগো মা তোমার কোলে জন্ম আমার মরণ তোমার বুকে।
তোমার পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে।
তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে
তুমি শীতল জলে জুড়াইলে,
তুমি যে সকল সহা সকল বহা মাতার মাতা।…
তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা।’
গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ১৩১২ সালের আশ্বিন সংখ্যায়। রবীন্দ্রনাথের গানে দেবী মাতাকে যে দেশ মাতার সাথে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে এবং এই গান যে মুসলিম সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এমন বিতর্ক রবীকালেও হয়েছিল। প্রবোধ চন্দ্র সেন লিখেছেন, ‘মনে রাখতে হবে মাসটা ছিল আশ্বিন, মাতৃবন্দনার মাস। রবীন্দ্রনাথ তাই বিশ্বময়ী তথা বিশ্বমাতাকেই দেশমাতৃরূপে বর্ণনা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ গানের ভাবকল্পনাটির সহজ সরল ও স্বাভাবিক প্রকাশ ঘটেছে এই গানটিতে। বস্তুত সমগ্রভাবে বিচার করলে এই গানটিকে ‘বন্দেমাতরম’ গানের রবীন্দ্রভাষ্য বলে মনে করা হয়।’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২১৯) ও (বঙ্গভঙ্গ রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ- কঙ্কর সিংহ)।
নিজের রচিত এ শ্রেণীর গান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। পুলিন বিহারী সেনকে একপত্রে তিনি লিখেছিলেন, “ একদিন আমার পরোরোকগত বন্ধু হেমচন্দ্র মল্লিক বিপিন পাল মহাশয়কে সঙ্গে করে একটি অনুরোধ আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের কথা ছির এই যে, বিশেষভাবে দূর্গামূর্তির সঙ্গে মাতৃভূমির দেবীরূপ মিশিয়ে দিয়ে তাঁরা শারদীয় পূজার অনুষ্ঠানকে নতুনভাবে দেশে প্রবর্তিত করতে চান, তার উপযুক্ত ভক্তি ও উদ্দীপনা মিশ্রিত স্তবের গান রচনা করবার জন্য আমার প্রতি তাদের ছিল বিশেষ অনুরোধ।… আমি রচনা করেছিলুম ‘ভুবনমনমোহিনী’।… এ গান সর্বজনীন ভারত রাষ্ট্রসভায় গাবার উপযুক্ত নয় কেননা এ কবিতাটি একান্তভাবে হিন্দু সংস্কৃতি আশ্রয় করে রচিত। অহিন্দুর এটা সুপরিচিতভাবে মর্মাঙ্গম হবে না।” (রবীন্দ্রজীবনী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১২৪ দ্রষ্টব্য)।
নববর্ষের এই উৎসবে আগত জনতার ৯০% মুসলমান সম্প্রদায়ের। খুবই বিস্মিত হতে হয় যখন কোনো মুসলমান শিল্পী নতুন বছরের মঙ্গল কামনায় গেয়ে ওঠে-
‘জাগ হে পিনাক পাণিনি, জাগ হে মৌণী শিব ধ্যানী…।’ ৯০% মুলসলানের দেশে শিবের জাগরণ কামনায় নতুন বছর শুরু কিসের আলামত?
এভাবেই পূজা, আরতি, উলুধনী, রাখিবন্ধন, মনসার গান, শিবের গাজন, কাঁসার ঘণ্টা, মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, রাজটীকা ধারণ, দীপাবলী উৎসবকে এখন সার্বজনীন ‘বাঙালী’ সংস্কৃতি বলে দাবী করা হচ্ছে। বৈশাখী গানে যেমন গাওয়া হয়:
‘মুছে যাক গ্লানী, ঘুচে যাক জরা
অগ্নিস্নানে সূচী হোক ধরা..
এসো হে বৈশাখ …’।
এবার পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে গণভবনে আয়োজিত সম্বর্ধনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখেও গণমাধ্যমের কল্যাণে এই লাইন ক’টি গীত হতে শুনেছি। কিন্তু কি এই অগ্নিস্নান?
মহাভারত, বিষ্ণু পুরাণ, হরিবংশ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থে ‘অঙ্গীরার পুত্র’, সন্ধিলার প্রপৌত্র, ব্রহ্মার জ্যেষ্ঠ পুত্র, দক্ষকন্যা স্বাহার স্বামী(অগ্নীপুরাণ), ধর্মের ঔরসে ও বসুভার্যার গর্ভে অগ্নির জন্ম(মহাভারত অনুশাসন)। উপমহাদেশের সনাতনী সম্প্রদায়ের কাছে অগ্নি প্রত্যক্ষ দেবতারূপী ভগবান। ঋগ্বেদে অগ্নিকে পার্থিব দেবতাদের মধ্যে প্রধান বলে দাবী করা হয়েছে। অগ্নি দেবতা ও মানবের মধ্যস্থতাকারী- যজ্ঞ সারথী। অগ্নি নিজের রথে দেবতাদের বহন করে যজ্ঞস্থলে বা মঙ্গলকাজে নিয়ে আসেন। সেকারণে অগ্নির অপর নাম যজ্ঞ পুরোহিত। ঋগ্বেদে সংহিতায় ২০০ সুক্তে অগ্নির স্তব করা হয়েছে, যা দেবরাজ ইন্দ্র ভিন্ন অন্য কোনো দেবতার বেলায় করা হয়নি।
ঋগ্বেদ শুরু হয়েছে অগ্নি বন্দনা দিয়ে এবং শেষও হয়েছে অগ্নি বন্দনা দিয়েই। মহামুণি বশিষ্ঠকে ব্রহ্মজ্ঞান শিক্ষা দেয়ার জন্য অগ্নি দেবতার মুখ থেকে যে ১৫৪০০টি শ্লোক নির্গত হয় তাই অগ্নিপুরাণ নামে খ্যাত। দেবতাগণ অগ্নি ব্যতিত যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হননা। সেকারণেই হিন্দুরা জন্ম, মৃত্যু, বিয়েসহ সকল মঙ্গলকাজে অগ্নিকে স্বাক্ষী রাখে, সম্মুখে রাখে। শুধু মানুষ নয়, রামায়ণে দেবতা রামকেও দেখা যায় তার স্ত্রী সীতার পবিত্রতা প্রমাণে অগ্নিস্নানের নির্দেশ দিতে। কাজেই আগামী একটি বছর যে ধরায় আমরা বসবাস করবো সেই ধরাকে মুসলমানগণ অগ্নিস্নানে সূচী বা পবিত্র করতে কখনই চাইবে না।
নদী বিধৌত এই দেশে কোনো দিন কোনো মুসলিম মাঝি মাল্লা ‘ এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে জয় মা’ বলে নদীর বুকে তরী ভাসায়নি। কিম্বা ‘মা ভৈ, মা ভৈ’ অর্থাৎ মা ভৈরবীর( মা কালী) নামে জয়ধ্বনি দিয়ে যাত্রা শুরু করেনি। চিরকাল এখানকার মুসলিম মাঝি মাল্লার কণ্ঠে নাও ভাসানোর গান ছিল ‘দাড়ি মুখে সারী গান লা শারীক আল্লা’।
পর্ব-২
গত ১৩ এপ্রিল ২০১২ তারিখে এই লেখার প্রথম অংশ ছাপা হবার পরদিন পহেলা বৈশাখে বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ পালিত হয়েছে মহা সাড়ম্বরে। আয়োজন ও ব্যাপ্তিতে এবারের নববর্ষ উৎযাপন সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। শুধু রমনার অশ্বত্থমূল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এবারের নববর্ষ উৎযাপন সমগ্র রাজধানী পেরিয়ে বিস্তৃতি লাভ করেছিল সারা বাংলাদেশে জেলায়, উপজেলায়। এই বিস্তৃতিতে কর্পোরেট কোম্পানীগুলো ও স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শুধু রাজধানী বা বিভাগীয় শহর নয় বেশ কয়েকটি জেলা শহর থেকেও এবারের পহেলা বৈশাখ উৎযাপন সরাসরি সম্প্রচার করেছে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো। চ্যানেলগুলোর এই ব্যাপক প্রচারে পহেলা বৈশাখের উৎসব বিশ্বব্যাপী প্রচার হয়েছে। ফলে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে বাংলাদেশে পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর নিজস্ব অনুষ্ঠান রয়েছে এবং সেসব অনুষ্ঠান দেখতে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পর্যটক ঐসব দেশে গমন করে থাকে।
এবছর ছায়ানট নববর্ষ উৎযাপন শুরু করে সেতারে ভৈরবী রাগের আলাপন দিয়ে। ভৈরবী হিন্দুদের দেবী কালীর অন্য নাম। সম্ভবত সে কারণেই এবার ছায়ানট তার কর্মীদের ট্রাডিশনল পোশাকের রঙে পরিবর্তন আনে। ছায়ানট এতোদিন পহেলা বৈশাখের পোশাক হিসাবে লাল সাদা রঙের শাড়ি ও পাঞ্জাবীকে ব্রান্ডিং করিয়েছে। মূলতঃ হিন্দু নারীদের শাখার সাদা ও সিঁদুরের লাল কম্বিনেশন থেকে ছায়ানট এই পোশাককে প্রচলন করিয়েছে হয়। হিন্দু নারীরা তাদের শাখা-সিঁদুর অক্ষয়, অক্ষুণ্ন রাখতে দেবী দূর্গার কাছে প্রার্থনা করে বিজয়ী দশমীতে শাখা সিদুরের রঙে লাল সাদা শাড়ি পরিধান করে থাকে। ছায়ানট এবারে সম্ভবত ভৈরবী রাগের সাথে মিল করে তাদের কর্মীদের পোশাক নির্ধারণ করেছে শাক্ত পূজারীদের বা সন্ন্যাসীদের(কালী ভক্ত) গেরুয়া পোষাকের গৈরিক রঙে। ধারণা করা হচ্ছে, ছায়ানটের দেখাদেখি এদেশের ফ্যাশন হাউসগুলো আগামী নববর্ষে পোশাক হিসাবে এই গৈরিক রঙ ব্যবহার করে মুসলিম অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীর মাঝে তুলে ধরবে।
এদিকে রমনা অশ্বত্থমূলের বাইরেও কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে একটি মঙ্গল শোভা যাত্রা বের করে। এর সাথেও আমাদের হাজার বছরের নববর্ষ উৎযাপনের ঐতিহ্যের কোনো মিল নেই। মূলতঃ ১৯৮৫ সালে চারুপীঠ নামের একটি সংগঠন সর্বপ্রথম যশোরে বাংলা নববর্ষে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রচলন করে। তারই অনুকরণে ১৯৮৯ সালে চারুশিল্পী সংসদ ঢাকায় নববর্ষে মঙ্গল শোভা যাত্রার প্রচলন করে।
এ শোভা যাত্রাকেও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির নগ্ন প্রদর্শনী বলা চলে। মনসাপট, লক্ষীর সরা, বেদ-এ বর্ণিত নানা দেবদেবীর বাহন বিভিন্ন পশুপাখির ডামি, পূরাণের নানা অসূর, রাক্ষস, ভূত-প্রেত, প্যাঁচার মুখোশ সহকারে এই শোভাযাত্রা বের হয়। আগামী বছরের সুফলা কামনা করে ধনের দেবী লক্ষ্ণীর সরা রাখা হয়, বিদ্যার উন্নতি কামনা করে বিদ্যার দেবী সরস্বতীর বাহন হংস ও বীণা রাখা হয়, অমঙ্গল থেকে দুরে থাকতে অমঙ্গলের দেবী মনসার পট রাখা হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রায়। আর মুসলিম তরুণ তরুণীরা সংস্কৃতির নামে তা গলাধঃকরণ করে নিজের অজান্তেই শিরক-এর সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
এই মঙ্গল যাত্রার উদ্বোধনী গান হিসাবে গাওয়া হয়:
‘দ্বার খোল দ্বার খোল
ওহে পুরবাসী
জলে স্থলে বনতলে লাগলো যে দোল..।’
বলাবাহুল্য এটি হিন্দু ধর্মের দোল পূজার বা হোলি উৎসবের অভিন্ন অনুষঙ্গ দোল যাত্রার উদ্বোধনী গান। অবতার শ্রী কৃষ্ণ একদা বৃন্দাবনে রাধা ও তার সখীদের সঙ্গে লীলারত ছিলেন। সে সময় হঠাৎ শ্রী রাধার রজঃশ্রাব শুরু হয় এবং তাতে তার বসন রঞ্জিত হয়। এতে করে শ্রী রাধা ও শ্রী কৃষ্ণ লজ্জিত ও বিব্রত হয়ে পড়েন। এ সময় শ্রী কৃষ্ণ রাধার লজ্জা ঢাকতে এবং বিষয়টি তার সখীদের নিকট গোপন করতে শ্রী রাধা ও তার সখীদের সাথে আবীর খেলা শুরু করেন এবং তাদের আবীর দিয়ে রাঙিয়ে দেন। শ্রী কৃষ্ণ, রাধা ও তার সখীদের এই আবীর খেলার স্মরণে হিন্দু সমাজে হোলি উৎসবের প্রচলন হয়েছে। বাংলাদেশে এই হোলি উৎসব দোল উৎসব নামে সমধিক পরিচিত। এই দোল বা হোলি উৎসবের উদ্বোধনী গান উদ্বোধনী গান ‘‘দ্বার খোল দ্বার খোল ওহে পুরবাসী..’’ গাওয়া হয় নববর্ষের মঙ্গল যাত্রায়।
সম্রাট আকবরের আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজী যার নামে ঢাকার পাশের ফতুল্লার নামকরণ করা হয়েছে বলে মনে করা হয় তিনি এই বাংলা সনের প্রচলন করেন। বাংলা তথা ভারতবর্ষে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ও প্রসারে মুসলিম শাসকদের অবদান সবচেয়ে বেশী- এ কথা সর্বজন স্বীকৃত। অথচ সেই মুসলমানদের প্রবর্তিত বাংলা নববর্ষ পালিত পালিত হচ্ছে সম্পূর্ণ হিন্দুয়ানী কায়দায়। তাতে মুসলমাদের মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের কোনো উপস্থিতি নেই।
সম্প্রতিকালে বাংলা নববর্ষ উৎযাপনের সাথে সাথে আরো একটি উৎসবকে হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। পহেলা বৈশাখের আগের দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিন চৈত্র সংক্রান্তি নামে এই জাতীয়ভাবে পালনের চেষ্টা করা হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। ‘সংক্রান্তি এলায়েন্স’ নামের একটি সংগঠন চৈত্র সংক্রান্তিকে জাতীয়ভাবে পালনের এবং এদিনে জাতীয় ছুটি ঘোষণার দাবী জানিয়েছেন। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে চৈত্র সংক্রান্তির ইতিহাসটা একবার জেনে নেয়া যাক:
চৈত্র সংক্রান্তি ও চড়ক পূজা
ষাটের দশকে ছায়ানট শিল্পী গোষ্ঠী যখন বাংলা নববর্ষ উৎযাপনের সিদ্ধান্ত নেয় তখন তারা একই সাথে বর্ষাবরণ, হেমন্তবরণ, বসন্তবরণ উৎসব পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কালের বিবর্তনে নববর্ষ বরণের পাশাপাশি বসন্তবরণও অনেকটা জনপ্রিয়তা পায়। বিগত শতাব্দীর শেষ দশকে ছায়ানটি চেতনার সাংস্কৃতিক কর্মীরা এরও একধাপ এগিয়ে ‘বাঙালী’ সমাজে উৎযাপিত হওয়া ১২ মাসে ১৩ পার্বনকে উৎযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সন্দেহ নেই বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ তাদের ১২ মাসে অনুষ্ঠিত ১৩ পূজাকে ঘিরে ১৩টি পার্বন বা উৎসব পালন করে থাকে। বাঙালী হিন্দুদের এই উৎসবকে ‘বাঙালী সংস্কৃতি’ বলে ব্যাপকভাবে উৎযাপনের ও প্রসারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মুসলমানের ঘরে জন্ম গ্রহণকারী ও মুসলমান নাম ধারণকারী কিছু রবীন্দ্রপ্রেমী সংস্কৃতি কর্মী। অথচ এদেশের অধিবাসী ৯০% মুসলমানের যেসব উৎসবে সমগ্র বাংলাদেশ জেগে ওঠে সেই ঈদুল ফেতর, ঈদুল আযহা, মুহররম, ঈদে মিলাদুন্নবী প্রভৃতি উৎসবগুলো উদযাপনে ব্যাপারে তারা থাকে সম্পূর্ণ নির্বিকার।
যাই হোক, এই ১২ মাসে ১৩ পার্বণের অন্যতম হচ্ছে চৈত্র সংক্রান্তি। বাংলা বছরের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে বাংলাদেশের এবং ভারতের বেশ কিছু এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এই চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব পালন করে আসছে। উল্লিখিত সাংস্কৃতিক বলয়ের লোকেরা বিগত দেড় দশক ধরে ঘরোয়াভাবে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব পালন করে আসছিল এবং তা জাতীয়ভাবে পালনের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ২০০৭ সালে প্রথম তাদের এ প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখে। বাংলা ১৪১৭ সালের শেষদিন ৩০ চৈত্র বেশ কিছু জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয়ভাবে পরিচিত সংগঠন প্রকাশ্যে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব পালন করেছে। এ বছর বেশ কিছু জাতীয় পত্রপত্রিকা চৈত্রসংক্রান্তি নিয়ে বিশেষ প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রকাশ করে। বলাবাহুল্য এ সব প্রবন্ধ-নিবন্ধে চৈত্রসংক্রান্তি ও চড়ক পূজাকে ‘সার্বজনীন বাঙালী উৎসব’ বলে তুলে ধরা হয়।
চৈত্র সংক্রান্তি মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব। শাস্ত্র ও লোকাচার মতে, এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি কাজকর্মকে পূণ্যজনক বলে মনে করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তি উৎসবের প্রস্তুতি চলে গোটা মাস জুড়ে। পুরো মাস জুড়ে সন্ন্যাসীরা দল বেঁধে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান করে ভিক্ষা মাগে। আর এই ভিক্ষার প্রাপ্ত চাল- ডাল ও অন্যান্য দ্রব্যাদি দিয়ে চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব আয়োজন করা হয়। গানের দলে শিব হনুমান কালীর মুখোশ পরে থাকে অনেকে। কোথাও কোথাও সন্ন্যাসীরা এ সময় সাথে একটি শিব লিঙ্গ(চড়ক) বহন করে থাকে। সাধারণ সময়ে এই শিব লিঙ্গকে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। ঢোল বাদ্য বাজিয়ে সন্নাসীরা শিব কীর্তন গেয়ে পানি থেকে এই গাছ তুলে আনে। এরপর এই গাছকেও পূজা করা হয়।
চৈত্র সংক্রান্তির মূল উৎসব হচ্ছে চড়ক পূজা। বাংলাপিডিয়া মতে, এটি হিন্দুদের একটি ধর্মানুষ্ঠান। চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে এটি পালিত হয়। এর অপর নাম নীলপূজা। পশ্চিম বঙ্গের গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন এই চড়ক পূজারই রকমফের। এ পূজা খুবই আড়ম্বরপূর্ণ। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিব লিঙ্গ রাখা হয়, যা পূজারীদের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। এ পূজার পুরোহিত হলেন আচার্য ব্রাহ্মণ বা গ্রহবিপ্র, অর্থাৎ পতিত ব্রাহ্মণ। চড়ক ফ’জার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুরির উপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়ক গাছে দোলা এবং দানো-বারানো বা হাজারা পূজা। দানো- বারানো বা হাজারা পূজা করা হয় সাধারণত শ্মশানে। চড়কপূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পূণর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ।
চড়ক উৎসবে বহু প্রকার দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে অর্থাৎ একটি উচুঁ খুঁটিতে ভক্ত বা সন্নাসীকে লোহার হুক দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুত বেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে পায়ে জিহ্বায়এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ ফোঁড়া অর্থাৎ লোহার শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে বিদ্ধ করা হয়। ১৮৬৫ সালে ইংরেজ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে কোথায়ও কোথাও এ অনুষ্ঠান এখনো প্রচলিত আছে।
চড়কপূজা আদি লোক সংস্কৃতির অন্যতম ধারাও বটে। এর উদ্যোক্তারা কয়েকজনের একটি দল নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন শিব ও দুজন সখী। একজনকে সাজানো হয় লম্বা লেজওয়ালা হনুমান। তার মুখে থাকে দাড়ি আর হাতে থাকে কাঠের তরবারী। পুরো দেহ ঢাকা থাকে মাছ ধরার পুরোনো জাল দিয়ে, আর মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল।সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। এদেরকে নীল পাগলের দলও বলা হয়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় আর নাচ পরিবেশন করে। গ্রামবাসীরা তাদের ইচ্ছামত টাকা-পয়সা ও চাল-ডাল দান করে। কেউবা তাদের একবেলা খাবারও দেয়। এবাবে সারা গ্রাম ঘুরে দলটি দান হিসাবে যে দ্রব্যাদি পায় তা দিয়ে হয় চড়ক পূজা। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। সাধারণতঃ তিন থেকে পাঁচদিন পর্যন্ত এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
অন্য একটি সূত্রে বলা হয়েছে, পশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীন কাল থেকেই এ পূজার প্রচলন ছিল। লোকশ্রুতি আছে, চৈত্রের শেষ দিন শিবভক্ত বানরাজা তার সঙ্গীদের নিয়ে শিবকে পাওয়ার জন্য প্রর্থনায় মত্ত হয়ে নিজের শরীর থেকে রক্ত বের করে শিবের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। এতে ভগবান শিব খুশী হন। এ কারণেই শৈব সম্প্রদায়ের মানুষ চৈত্র সংক্রান্তি দিন শিবকে খুশী করতে শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়ে চড়ক উৎসবের আয়োজন করে। চড়ক পূজার মূলে রয়েছে ভুত প্রেত ও পূনর্জন্মবাদে বিশ্বাস। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে চড়কপূজার প্রচলন রয়েছে। তবে যে বিষয়টিতে সবার মিল রয়েছে তা হলো: একজন সন্ন্যাসীর পিঠের মাংস পেশীতে লোহার শিক বা বড়শী গেঁথে দেয়া হয়। তারপর মাঠের মাঝখানে খাঁড়া ভাবে পোঁতা চড়ক গাছের(লম্বা শাল অথবা গজারীর গাছ) শীর্ষে মাটির সমান্তরালভাবে স্থাপিত ঘূর্ণণ সক্ষম লম্বা বাঁশ বা কাঠের এক প্রান্তে সন্ন্যাসীর শরীরে গাঁথা লোহার শিকের সাথে বাঁধা দড়ি আটকে ঘুরানো হয়।
“লোকশ্রুতিতে জানা যায়: চড়কের গাছটি হচ্ছে শিবলিঙ্গের প্রতীক। আর সেই গাছের উপর আড়াআাড়িভাবে টানানো বাঁশটি হচ্ছে কালী দেবীর যৌনাঙ্গ। শিবলিঙ্গের উপর ভর করে কালির যৌনাঙ্গের ঘুর্ণন হচ্ছে চড়ক পূজার মর্মকথা। নতুন বছরটা যেন শিব-কালীর যুগল মৈথুনের মতো শস্য উর্বর হয়ে উঠে…” (দৈনিক আমার দেশ, ১১ মে ২০০৭ দ্রষ্টব্য)। “চড়কের মাঠে যাওয়ার আগে বাড়ির উঠানে সন্ন্যাসীদের দেবাংশী বা শিবের অংশ হয়ে উঠার কৃত্যাচারে তাণ্ডব নৃত্য করতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে জয় ঢাক বাদ্যের সাথে ভক্তদের হরিবোল উচ্চারণের ভেতর সন্ন্যাসীরা রামদা ও ত্রিশূল নিয়ে বহুবিধ কসরত করে। এরপর সন্ন্যাসীরা চড়ক উপলক্ষে শিবের কাছে মানতকারী গ্রামবাসীদের আনা আমপাতা দিয়ে ঢাকা জলপাত্রের সামনে এসে জয়ঢাক বাদ্যের ভেতর ধূপ ধোঁয়ার ইন্দ্রজাল তৈরী করে মহিষের শিঙ্গা বাজায়। মানতিদের মানত গ্রহণের পর উঠানের একপাশে বিছানো শিতল পাটির দিকে সম্মোহিতের মতো ছুটে যায় শিব-সন্ন্যাসীরা। পাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে তারা তাদের পিঠে চড়কে ঝুলে পড়ার জন্য বড়শি বিঁধিয়ে নেয়।
চড়কের মাঠে উপস্থিত অন্য কিছু ভক্তের গালে ও জিহ্বায় লোহার শিক বিদ্ধ করা হয়। চড়কের মাঠে উপস্থিত কালির মুখোশ পরা জ্যান্ত কালী মূর্তির সামনে জয়ঢাক বাদ্যের সঙ্গে শিবের তাণ্ডব নৃত্য করা হয়। লৌকিক মহাকাব্য রামায়ণের জনপ্রিয় চরিত্র হনুমানজি, রাবণ ও রামের যোদ্ধাদের ভূমিকায় তরুণ ও শিশুদের অভিনয় করতে দেখা যায়। বহুপূর্বে চড়ক পূজার সাথে নরবলীর সম্পর্ক ছিলো বলে কোথাও কোথাও শোনা যায়। তবে কয়েক বছর আগেও সদ্য মৃত মানুষের কাটা মাথা ও তার রক্ত ছাড়া পঞ্চগড় অঞ্চলের চড়ক পূজা হতো না।
চড়ক পূজার আয়োজনের জন্য পুরোহিতের সেবকরা তখন চৈত্র সংক্রান্তির সময়ে আশে পাশের গ্রামে এবং করবস্থানগুলোতে নজর রাখতো কেউ মারা গেল কিনা? কাউকে কবর দেয়া হলো কিনা? আর চৈত্র সংক্রান্তির ভেতর কেউ মারা গেলে তাকে কবর দিয়ে আসার পর রাতের আঁধারে খুব সতর্কতার সাথে চড়ক পূজার পুরোহিতের সেবকেরা সেই মৃত মানুষের মাথাটা কেটে আনতো। তারপর সেই মাথাকে চড়কের আয়োজনের মধ্যে কালিকে উপহার দেয়া হতো। বর্তমানে ঐ অঞ্চলের মুসলমান জনগণ বিষয়টি সম্পর্কে সতর্ক হয়ে পড়ার পর এখন আর মানুষের মাথা নিয়ে পঞ্চগড় অঞ্চলে চড়কের আয়োজন হচ্ছে না ঠিকই তবে তার পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে কবুতর হত্যার রক্ত এবং মৃত মানুষের মাথার খুলি। বর্তমানে একই খুলিকে বারবার চড়কপূজায় ব্যবহার করা হচ্ছে। পূর্বে একেক বছর সদ্য মৃত মানুষের মাথার আলাদা আলাদা মাথা নিয়ে চড়ক পূজা করা হতো।” (পূর্বোক্ত দ্রষ্টব্য)।
এই হলো চৈত্র সংক্রান্তি ও তার মূল উৎসব চড়ক পূজা। এ বছর এটিএন নিউজের কল্যাণে দেশবাসী গাজীপুরের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠান সরাসরি দেখার সুযোগ পেয়েছেন। যারা দেখেছেন তাদের কাছে বিনীত প্রশ্ন, এই অনুষ্ঠান কি বাঙালী সংস্কৃতি বলে বাঙালী মুসলমানদের সমাজে উদযাপন যোগ্য? উল্লিখিত আলোচনায় নিঃশঙ্কভাবে প্রমাণিত হয়, এটি হিন্দুদের একটি বিশেষ ধর্মীয় উৎসব। উৎস, ইতিহাস ও পালন পদ্ধতি সবকিছু প্রমাণ করে এটি হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তা পালনে মুসলমানদের মনে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে না। কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তি বা চড়কপূজাকে ‘বাঙালী সংস্কৃতি’ বলে বাংলাদেশী মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলা নববর্ষে অনুষ্ঠানে শরীরে উল্কি আঁকা নামক আরেকটি উপাচার যোগ হয়েছে ইদানিং। প্রথমদিকে এটি চালু করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা। এখন এর সাথে নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সৌখিন চিত্রকরেরাও যোগ দিয়েছে। এমনিতেই শরীরে উল্কি আঁকা ইসলামে বা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু পহেলা বৈশাখে যেভাবে রমনা পার্ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছেলেরা মেয়েদের এবং মেয়েরা ছেলেদের শরীর ছুঁয়ে উল্কি আঁকে তা অপসংস্কৃতি ছাড়িয়ে বেহায়াপনার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত চিত্রে দেখা যায়, প্রথম প্রথম ছেলেরা মেয়েদের কপালে, কপোলে, চিবুকে উল্কি এঁকে দিত। এখন সেটা নীচে নেমে বুক ও পিঠের অনাবৃত অংশে পৌঁছেছে। সেটেলাইট টিভির কল্যাণে আমরা রিও ডি জেনিরোতো সাম্বা উৎসব এবং বিভিন্ন ক্রীড়া উৎসবে পাশ্চাত্যের মেয়েদের শরীরের নানা গোপন অঙ্গে উল্কি এঁকে প্রদর্শন করতে দেখেছি। তাই ভয় হয় এখনই এ প্রবণতা রোধ করতে না পারলে এই নীচে নামাটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছুবে?
বৈশাখী মেলা উপলক্ষে ফিডব্যাক ব্যান্ডের মাকসুদ গেয়েছেন তার বহুল জনপ্রিয় গান: ‘…বখাটে ছেলের ভিড়ে ললনাদের রেহাই নাই, মেলায় যাইরে..।’ মাকসুদের এই গান বাস্তবেও দেখা দেয় বৈশাখী মেলায় ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে ২০ ছাত্রীর লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে।
পর্ব-৩
(১৯ এপ্রিল প্রকাশের পর বাকী অংশ)
পহেলা বৈশাখে তরুণ তরুণীরা উৎসবের নামে, শোভাযাত্রার নামে যেভাবে অবাধ মেলামেশার উপলক্ষ্য বানিয়েছে তা একটি কোনো ভাবেই মুসলিম সংস্কৃতির মধ্যে পড়েনা। পাশ্চাত্য ও ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলো এভাবেই মুসলিম তরুণদের অবাধ যৌন্যতার দিকে ঠেলে দিয়ে লক্ষ্যচ্যুত করে ফেলছে। এই অবাধ মেলামেশার ফলে আমাদের সমাজে নানা প্রকার অবক্ষয়, অপরাধ বাড়ছে। বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতাও। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক আত্মহত্যার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে এর প্রধান কারণ হিসাবে ধরা পড়বে নারী পুরুষের অবাধ ও অবৈধ মেলামেশা।
পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাকিব হোসেন ও একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাভিলা তাবাচ্ছুম ঘনিষ্ঠ হয়ে হাঁটছিলেন। বিষয়টি নিয়ে তাদের কাছে প্রশ্ন রাখা হলে কিছুটা লজ্জিত হয়ে রাকিব বলেন, ঠিক নয়; তবে আজ পহেলা বৈশাখ বলে টিভি চ্যানেলের কল্যাণে আপনারা এই সাধারণ দৃশ্য দেখে হয়তো আপত্তি করছেন। কিন্তু এই ঢাবি ক্যাম্পাস ও তার সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বছরের বাকি ৩৬৪ দিন ২৪ ঘণ্টা তরুণ তরুণীরা যেভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থাকে তা নিয়ে আপনারা কথা বলেন না কেন? বিশেষ করে সন্ধ্যার পর এই এলাকায় এমন কোনো আপত্তিকর কাজ নাই যা হয় না। প্রশ্ন তুললে গোটা ব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন তোলা উচিত?রাকিব হয়তো ঠিকই বলেছেন। কিন্তু তার পরও কথা থেকে যায়।
পহেলা বৈশাখের পর থেকে বাংলাদেশী পর্ণোগ্রাফি নির্ভর সাইট ও ব্লগগুলোতে ইতোমধ্যেই নববর্ষে প্রেমিক প্রেমিকাদের ডেটিং এর সময় একান্ত মূহুর্তের বেশ কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ ও ছবি আপলোড করা হয়েছে ‘নববর্ষ স্পেশাল’ নাম দিয়ে- ঠিক যেভাবে ভ্যালেন্টাইনস ডে বা থার্টি ফার্স্ট নাইটের পর হয়ে থাকে। এ ছাড়াও ‘স্পাই ক্যাম’ নাম দিয়ে নববর্ষে বেড়াতে যাওয়া তরুণী ও মহিলাদের বিভিন্ন অসতর্ক মুহুর্তের প্রচুর ছবি ক্যামেরা ও মোবাইলে তুলে ইতোমধ্যে আপলোড করা হয়েছে ইন্টারনেটে। কারো ওড়না পড়ে গেছে, ভীড়ে কারো শাড়ির আঁচল সরে গেছে, কেউবা উবু কেনাকাটা করছেন, তপ্ত রোদে ঘর্মাক্ত নারীর শরীর প্রভৃতি অসতর্ক মূহুর্তে তরুণী, গৃহবধুদের ছবি তুলে আপলোড করা হয়েছে। সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা হলে কেউ এই অসাধু কার্য পরিচালনা করতে পারতো না।
পহেলা বৈশাখে আমরা যারা বাঙালীয়ানার প্লাবনে ভেসে যাই, মাত্র এক সপ্তাহ পরে তাদের বৈশাখ মাসের তারিখটি বলতে বললে মাথার চুল ছিঁড়তে হবে। আমাদের জাতীয় জীবনে এই একটি দিন ছাড়া বাংলা সনের কোনো ব্যবহার চোখে পড়ে না। গত বছর ইরান সফরকালে এ লেখক তেহরানে ইরানীদের সাথে কথা প্রসঙ্গে ঈশায়ী তারিখের প্রসঙ্গ এলে তাদের কেউই মোবাইল না দেখে, ক্যালেন্ডার না দেখে বলতে পারেনি। ইরানে রাষ্ট্রীয়ভাবে সকল কাজে ফার্সি সন ব্যবহার করা হয়। তাদের নওরোজ বা নববর্ষ উৎসব পৃথিবী বিখ্যাত। ইতিহাস ও উৎযাপন সব বিচারেই তা বাংলা নববর্ষের থেকে অনেক উন্নত। কিন্তু সেই নওরোজ উৎসব পুরোটাই পালিত হয় ইরানী সংস্কৃতিকে ধারণ করে। এ উৎসবের যেকোনো একটি বিচ্ছিন্ন ছবি দেখলেও বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে মানুষ তাকে ইরানের নওরোজ উৎসব বলে চিহ্ণিত করতে পারবে।
কিন্তু বাংলা নববর্ষে মুসলিম ছেলেরা ধুতি পরে, ললাটে তিলক এঁকে বাঙালী সেজে যেভাবে নাচগান শোভাযাত্রা করে তার ছবি দেখে বিশ্ববাসীর বোঝার উপায় থাকে না এটা বাংলাদেশের, না ভারতীয় উৎসব? কাজেই বাংলাদেশী সংস্কৃতির বিশ্বায়নের কথা বললে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতি দিয়েই তাকে ব্রান্ডিং করতে হবে। ধুতি-তিলক দেখতে বিশ্ববাসীর বাংলাদেশে আসার প্রয়োজন নেই।
অন্যদিকে নববর্ষে পান্তা ইলিশ খেয়ে বাঙালী হবার যে পদ্ধতি তাকে গ্রামের সাধারণ মানুষের দারিদ্র নিয়ে শহুরে মানুষদের নির্মম বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। গ্রামের মানুষ গরমের সময় এক বেলা খাবার পর কিছু ভাত বেঁচে গেলে তা অন্য বেলা খাওয়ার জন্য পানি দিয়ে ভিজিয়ে সংরক্ষণ করে। এর নাম পান্তা ভাত। দরিদ্র মানুষেরা মরিচ, পিঁয়াজ ও লবণ দিয়ে মাখিয়ে এই ভাত খেয়ে কোনো রকমে জীবনধারণ করে। ইলিশভাজা দিয়ে খাওয়ার জন্য কোনো দিন কোনো গ্রামবাসী ভাত পান্তা করেছে এ ইতিহাস মাথা কুটলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ ৫/৬ হাজার টাকা কেজি দরে ইলিশ মাছ না কিনে কিম্বা দেড় দুই হাজার টাকা দিনে এক শানকি পান্তা ইলিশ না খেয়ে যদি এই টাকা গ্রামের বা শহরের দরিদ্র মানুষের মাঝে বিতরণ করা যেত, সেটা অপেক্ষাকৃত উন্নত সংস্কৃতির পরিচয় বহন করতো।
এসব কারণেই বাংলা নববর্ষ পালনের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়, সংস্কৃতিক কর্মী ও অভিভাবকবৃন্দ। বাংলাদেশের শতকরা নব্বইভাগ জনগোষ্ঠী মুসলিম। কাজেই এদেশের জাতীয় উৎসব উৎযাপনের রীতি ও পদ্ধতিতে সেই জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও আচারে প্রতিফলন থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলা নববর্ষকে ঘিরে সার্বজনীন বাঙালী সংস্কৃতির বরণ ডালায় যেভাবে পৌত্তলিকতাকে মুসলিম সমাজে, পরিবারে ও ব্যক্তি জীবনে অনুপ্রবেশ করানো হচ্ছে তাতেই তারা আপত্তি তুলেছেন। বিশেষ করে এর সাথে বাংলা নববর্ষ উৎযাপনের হাজার বছরের ঐতিহ্যের কোনো সাদৃশ্য না থাকার পরও তা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করানোর জোর চেষ্টাই তাদের আপত্তির মূল কারণ।
ছায়ানট শুরু থেকেই রবীন্দ্র সংস্কৃতির রঙে বাংলাদেশকে সাজাতে চেয়েছে। কিন্তু এটা পরিস্কার যে, রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি আর বাংলাদেশের সংস্কৃতি সাংঘর্ষিক, বাংলাদেশী মুসলমানদের তো বটেই। রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা ‘এক মহাভারতের সাগর তীরে’ বিলীন হবার। তাও আবার ‘এক ধর্মরাজ্য’ মহাভারতের রাষ্ট্রভাবনা। বাংলাদেশ বলে আলাদা কোনো রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক সত্ত্বার স্বীকৃতি নেই সেখানে।
ভারতবর্ষ ভাগের আগেই রবীন্দ্রনাথ মারা যান। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় যখন বঙ্গভঙ্গ নামে বাংলা ও আসাম নিয়ে আলাদা রাষ্ট্রসত্ত্বার জন্ম হয় বৃটিশদের হাতে রবীন্দ্রনাথ তার ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার কথা প্রকাশ হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ ‘বঙ্গবিভাগ’ নামে এক প্রবন্ধে লেখেন, “…বাংলার পূর্বপশ্চিমকে চিরকাল একই জাহ্নবী তাঁহার বহু বাহুপাশে বাঁধিয়াছেন, একই ব্রহমপুত্র তাঁহার প্রসারিত ক্রোড়ে ধারণ করিয়াছেন; এই পূর্বপশ্চিম, হৃৎপিণ্ডের দক্ষিণ বাম অংশের ন্যায় একই সনাতন রক্ত স্রোতে সমস্ত বঙ্গদেশের শিরা-উপশিরায় প্রাণ বিধান করিয়া আসিয়াছে।”(বঙ্গভঙ্গ রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ, কঙ্কর সিংহ, পৃষ্ঠা-১৬ দ্রষ্টব্য)।
রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালের ২৫ আগস্ট বঙ্গভঙ্গ নিয়ে আয়োজিত একটি জনসভায় তাঁর ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ প্রবন্ধটি পাঠ করেন। তাতে তিনি লেখেন, “আমাদের দেশে বঙ্গব্যবচ্ছেদের আক্ষেপে আমরা যথাসম্ভব বিলাতি জিনিস কেনা বন্ধ করিয়া দেশী জিনিস কিনিবার জন্য যে সঙ্কল্প করিয়াছি সেই সঙ্কল্পটিকে শুদ্ধভাবে, গভীরভাবে, স্থায়ী মঙ্গলের উপর স্থাপিত করিতে হইবে।…ইহা দেশের পূজা, ইহা একটি মহান সংকল্পের নিকটে আত্মনিবেদন।”(রবীন্দ্র রচনাবলী-৩, অবস্থা ও ব্যবস্থা, পৃষ্ঠা-৬৭১ দ্রষ্টব্য)।
বঙ্গভঙ্গের সাতদিন আগে ৯ অক্টোবর ১৯০৫ সালে কোলকাতার বাগবাজারে পশুপতি বসুর বাসভবনে রবীন্দ্রনাথ বিজয়া সম্মিলন নামে এক ভাষণে বলেন, “… হে বন্ধুগণ আজ আমাদের বিজয়া সম্মিলনের দিনে হৃদয়কে একবার আমাদের এই বাংলাদেশের সর্বত্র প্রেরণ করো।… আজ বাংলাদেশের সমস্ত ছায়াতরুনিবিড় গ্রামগুলির উপর এতক্ষণ যে একাদশীয় চন্দ্রমা জোৎস্ন্যাধারা অজস্র ঢালিয়া দিয়াছে সেই নিস্তব্ধ সূচী রুচির সন্ধ্যাকাশে তোমাদের সম্মিলিত হৃদয়ের ‘বন্দেমাতরম’ গীতধ্বনী একপ্রান্ত হইতে আর এক প্রান্তে পরিব্যাপ্ত হইয়া যাক। একবার করজোড় করিয়া নতশিরে বিশ্বভুবনেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো-
বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার বায়ু বাংলার ফল
পূণ্য হউক পূণ্য হউক
পূণ্য হউক হে ভগবান।”
(প্রাগুক্ত, বিজয়া সম্মিলন, পৃষ্ঠা-৭৫৯ দ্রষ্টব্য)।
এদিকে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি লেখেন, “আগামী ৩০শে আশ্বিন(১৩১২) বাংলাদেশ আইনের দ্বারা বিভক্ত হইবে। কিন্তু ঈশ্বর যে বাঙালীকে বিভক্ত করেন নাই তাহাই বিশেষরূপে স্মরণ ও প্রচার করিবার জন্য এইদিনকে আমরা বাঙালীর রাখী বন্ধনের দিন করিয়া পরস্পরের হাতে হরিদ্রাবর্ণের সূত্র বাঁধিযা দিব। রাখী বন্ধনের মন্ত্রটি এই, ‘ভাই ভাই এক ঠাঁই।’ তাঁর প্রস্তাব অনুযায়ী নির্ধারিত দিনে কলকাতায় রাখী বন্ধন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়; প্রত্যুষে মন্দেমাতরম সঙ্গীতসহ প্রভাত ফেরী ও শোভাযাত্রা পথ প্রদক্ষিণ করে। এর সংগঠক ছিল বন্দেমাতরম সমাজ। রবীন্দ্রনাথও শোভাযাত্রার পুরোভাগে ছিলেন। শোভাযাত্রা গঙ্গার তীর পর্যন্ত যায়, অনেকে প্রথাগতভাবে এর পবিত্র প্রবাহে অবগাহন করে; সেখানে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির সমাবেশে রবীন্দ্রনাথ বাংলার সার্বিক কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করেন, এবং অসংখ্য পথচারীর হাতে রাখী বেঁধে দেন।”(রবীন্দ্রনাথ-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, অরবিন্দ পোদ্দার, পৃষ্ঠা-১১০ দ্রষ্টব্য)।
আমরা জানি বঙ্গভঙ্গ ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র সত্ত্বার কাঠামোগত প্রথম স্বীকৃতি। সে কারণেই এটা বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছে বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের পথ ধরেই বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু কোলকাতার সকল হিন্দু জমিদারদের মতোই রবীন্দ্রনাথও এই বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন চরমভাবে। তাদের এই আন্দোলনের ফলে ইংরেজ সরকার বাধ্য হয় বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা রদ করতে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এর ক্ষতিপুরণ স্বরূপ বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দের দাবীর প্রেক্ষিতে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তারও প্রবল বিরোধিতা করেন। এর নিয়ে অতীতে (লেখকের) বিস্তারিত লেখা হয়েছে বিধায় লেখার পরিসর চিন্তা করে এখানে সে আলোচনা পরিহার করা হলো। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলা বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ঘোষণা করায় আমাদের ঘৃণ্য হলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বাংলাকে বাদ দিয়ে হিন্দীকে ভারতের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার সুপারিশ করার পরও বাঙালীর নমস্য হয়েই রইলেন।
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতির মূল উপজীব্য হচ্ছে বেদ, পুরাণ, উপনিষদ। বেদ পুরাণ উপনিষদের সংস্কৃতি কখনো কোনো মুসলমানের সংস্কৃতি হতে পারে না। তাঁর ধর্মবিশ্বাস যাই ই থাক কিন্তু তার প্রকাশে তিনি বেদ পুরাণ ও উপনিষদের চেতনা উপমা, রূপক ও কাহিনী যেভাবে ধার করেছেন তা কোনো মুসলমানের অনুসরণীয় হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের বেদ ও উপনিষদের উপমা ও চেতনা এবং জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রদর্শনের চেতনার বাইরেও রবীন্দ্রনাথের আরো অনেক সৃষ্টি রয়েছে সেগুলো নিয়ে কেউ আপত্তি তোলেনি কখনো।
তবে একথা অনস্বীকার্য যে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়। পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন ইসলামের নির্দেশ। হাজার বছর ধরে এ দেশের হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বসবাস করে এই সহিষ্ণুতার বিরল নজির স্থাপন করেছে। চৈত্র সংক্রান্তি কিম্বা দূর্গাপূজার মেলায় অনেক বাঙালী মুসলিম তরুণরা অংশ নিয়ে থাকে। কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তি বা দূর্গাপূজাকে কোনো দিন তাদের সংস্কৃতি বলে মনে করেনি। একইভাবে মুসলমানদের ঈদের মাঠের রাস্তায় হিন্দুরা মিষ্টির দোকান দিয়ে থাকে, চকবাজার থেকে ইফতারীর স্বাদ তারাও গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু ঈদ বা রমজানকে কেউ তাদের সংস্কৃতি বলে গ্রহণ করেনি।
আমরা চাই বাংলাদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর লোকেরা নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ধারা বজায় রেখেই একসাথে জাতীয় উৎসবগুলো উৎযাপন করে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ও বৈচিত্রময় সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর বৈসাবি উৎযাপনকে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। এ তিনটি সম্প্রদায়ই পহেলা বৈশাখকে তাদের নববর্ষ হিসাবে উৎযাপন করে। চাকমারা ‘বিজু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’, ত্রিপুরারা ‘বৈসু’ নামে একইসাথে এ উৎসব উৎযাপন করে থাকে। একইসাথে পালনের সুবিধার্থে তারা তিনটি উৎসবের নামের প্রথম শব্দ নিয়ে ‘বৈসাবি’ উৎসব নামে এক সাথে পালন করে। একই সময়ে সেখানে বসবাসরত বাঙালীরা নববর্ষ পালন করে থাকে। একই লাইনে দাঁড়িয়ে শোভা যাত্রায় শামিল হয়। তবে একই সাথে পালন করলেও উদযাপন রীতি ও আচারে তারা নিজ নিজ সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে থাকে।
ইসলাম ধর্মে শিরক ও পৌত্তলিকতা হারাম। কিন্তু নববর্ষ উৎযাপনের নামে বাঙালী সংস্কৃতির বরণ ডালায় শিরক, পৌত্তলিতা সাজিয়ে, অপসংস্কৃতির নানা পসরা যেভাবে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলছে, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বিরোধিতা শুধু সেখানেই। তারা চায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের জাতীয় অনুষ্ঠানে তাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটুক। একথা সত্য যে, সংস্কৃতি একটি প্রবাহমান ধারা। এর আদান প্রদান খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এবারের পহেলা বৈশাখে বাঁশির সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত ভুভুঁজেলা বেজেছে, তা নিয়ে কেউ আপত্তি তোলেনি। কিন্তু হংস বা বীণা যখন বিদ্যাদায়িনীর প্রতীক হিসাবে মুসলিম সন্তানদের হাতে তুলে দেয়া হয় আপত্তিটা তখনই ওঠে।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বন্ধের উপায়
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন নিয়ে এই যে এত কথা বলা হলো তা রোধের উপায় কি? শুধু অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন হচ্ছে বলে শোরগোল তুললে, প্রতিবাদ করলে, লেখালেখি করলেই কি তা রোধ করা সম্ভব? প্রকৃতপক্ষে প্রতিবাদ করে প্রতিরোধ করে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সর্বক্ষেত্রে বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সব সময় দৃশ্যমান বা প্রত্যক্ষ হয় না। অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন বন্ধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে, সুস্থ ও নিজস্ব সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে জোরদার ও জনপ্রিয় করা। এ লক্ষ্যে কার্যকর সচেতনতা, কর্মসূচী ও প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করা। সুস্থ ও দেশীয় সাংস্কৃতিক কর্মসূচী নিজে থেকেই অপসংস্কৃতি ও বিদেশী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বন্ধ করে দেয়। যেমন, সমুদ্রগামী নদীতে যদি নিজস্ব পানির প্রবাহ অপ্রতুল হয়ে পড়ে তখন সহজেই সেখানে লবণাক্ত পানির প্রবাহ প্রবেশ করে। কিন্তু সে নদীতে নিজস্ব পানির সঠিক প্রবাহ থাকলে তা আপনা আপনি সমুদ্রের লবণাক্ত পানি প্রবেশে বাধা দিয়ে থাকে। প্রতিবাদ করে তা বন্ধ করা যায় না।
কাজেই আমরা যদি পহেলা বৈশাখসহ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবিষ্ট অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন বন্ধ করতে চাই তাহলে, নতুন প্রজন্মের কাছে জাতীয় সংস্কৃতির প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরে তাদের সামনে অপসংস্কৃতির মুখোশ উন্মোচন করতে হবে, পাশাপাশি সুস্থ ও দেশীয় সাংস্কৃতিক কর্মসূচীতে তাদের জড়িত করতে হবে। সাংস্কৃতিক কর্মীদের, সংগঠকদের খুঁজে বের করতে হবে সেই জাতীয় সংস্কৃতির পথ ও পদ্ধতি। নববর্ষ কিভাবে পালন করলে আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষা পায় আবার তরুণরা তাদের আনন্দ থেকেও বঞ্চিত না হয় সে রাস্তা তাদের সামনে বের করে দেয়ার দায়িত্ব সংস্কৃতি কর্মী ও সংগঠকদের। সে কর্মসূচী এমন হতে হবে যা তরুণদের কাছে জনপ্রিয়, আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, তারুণ্যই উৎসব, উৎসব তরুণদের জন্য, তরুণরাই উৎসবের প্রাণ।
কাজেই সুস্থ ধারার উৎসবের পন্থা তাদের সামনে বের করে দিতে হবে, নয়তো বক্তৃতা দিয়ে তাদের আটকে রাখা যাবে না। আবার সে কর্মসূচী একবিংশ শতাব্দির বিজ্ঞানমনষ্ক ডিজিটাল যুগের তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। ঐতিহ্যের পাশাপাশি আধুনিকতা ছোঁয়া থাকতে হবে সেখানে। আর এসবই করতে হবে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারাকে অক্ষুণ্ন রেখেই। তাহলেই কেবল সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধ করা সম্ভব।
ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা পুরুষ, লেনিন, স্ট্যালিন, সান ইয়েৎসেন-এর সহচর্য পাওয়া মানবেন্দ্র নাথ রায় তার ‘হিস্টোরিক্যাল রোল অব ইসলাম’ গ্রন্থে লিখেছেন, “মুসলমানদের কাছে জ্ঞান আহরণ করেই ইউরোপ আধুনিক সভ্যতার অধিনায়ক হয়ে রইল। এমনকি আজও তার শ্রেষ্ঠ মণীষীরা অতীত ঋণের এই বোঝা স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হন না। দূর্ভাগ্য আমাদের, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ইসলামের সংস্কৃতি থেকে ভারত তেমন উপকৃত হতে পারে নি। কেননা অনুরূপ সম্মানের অধিকারী হবার যোগ্যতা তার ছিলনা। এখনও এই বিলম্বিত রেনেঁসা সৃষ্টির বেদনায় মানবেতিহাসের এই স্মরণীয় অধ্যায় থেকে প্রেরণা সংগ্রহ করে হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে ভারতবাসীরা প্রভূত লাভবান হতে পারে।” তিনি আরও বলেছেন, ‘ ইসলামের সমাজ ব্যবস্থায় জীবনের প্রতি যে দৃষ্টি ভঙ্গি ছিল হিন্দু দর্শনের চেয়ে তা ছিল শ্রেয়। কেননা, হিন্দু দর্শন সমাজ দেহে এনেছিল বিরাট বিশৃঙ্খলা, আর ইসলাম তা থেকে ভারতীয় জনসাধারণকে মুক্তির পথ দেখায়’।
(লেখাটি দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার আদিগন্ত বিভাগে ২০১২ সালের ১৩ এপ্রিল, ১৯ এপ্রিল ও ২১ এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাঠকদের জন্য পার্বত্যনিউজে পুনর্মুদ্রণ করা হলো।)
♦ মেহেদী হাসান পলাশ: সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ ও সহকারী সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব।
email: palash74@gmail.com
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিষয়ে লেখকের অন্যান্য লেখা
- ♦ বিশ্ব আদিবাসী দিবস ও বাংলাদেশের আদিবাসিন্দা
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সরকারী সিদ্ধান্তে দৃঢ়তা কাম্য
- ♦ বিতর্কিত সিএইচটি কমিশনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে
- ♦ আদিবাসী স্বীকৃতি দিতে সমস্যা কোথায়?
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় দৃষ্টির মধ্যে রাখতে হবে
- ♦ একটি স্থায়ী পার্বত্যনীতি সময়ের দাবী
- ♦ বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক
- ♦ আদিবাসী বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনের ভুল ব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগ
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ১
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ২
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ৩
- ♦ শান্তিচুক্তির এক যুগ: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ গোষ্ঠির অতিআগ্রহ বন্ধ করতে হবে
- ♦ হঠাৎ উত্তপ্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম: খতিয়ে দেখতে হবে এখনই
- ♦ অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান সময়ের দাবী
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর কি কাজ
- ♦ রোহিঙ্গা ইস্যু : শেখ হাসিনা কি ইন্দিরা গান্ধী হতে পারেন না?
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক নীতি-কৌশলের পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন
- ♦ পাহাড়ের উৎসব: ‘বৈসাবি’ থেকে হোক ‘বৈসাবিন’