বান্দরবানে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগ
প্রবাদ আছে ‘শিক্ষার জাতির মেরুদণ্ড’। বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলায় শিক্ষকদের বলা হয় শিক্ষাগুরু। অথচ সেই শিক্ষক মাসে পর মাস বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকেন। বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও শহরে বিকাশে টাকা লেনদেনের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রোগ্রামে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকায় যেন তার নেশা। এমনই অভিযোগ পাওয়া যায় পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমার পাইন্দু হেডম্যান পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আল আমিনের বিরুদ্ধে।
গ্রামবাসীর অভিযোগ, বিদ্যালয়ে যোগদান করার পর থেকে প্রধান শিক্ষক মো. আল আমিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি থাকার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত অনিয়ম করে যাচ্ছে। আগস্ট মাসে তাকে বিদালয়ের মাত্র একদিন দেখা গেলেও পরে তিনি আবার শহরে চলে যান। এর আগেও গত জুলাই মাসে ৯ থেকে ১৭ তারিখের মধ্যে বিদ্যালয়ে মাত্র পাঁচ দিন এসেছিলেন। এরপর থেকে বিদ্যলয়ের না এসে শহরে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এছাড়াও গত ৩০ জুনের আগে বিদ্যলয়ের বরাদ্দকৃত প্রকল্পের চেকে শুধু সভাপতির সীল দিয়ে কোনো কিছু লেখা ছাড়াই প্রধান শিক্ষক তাঁকে স্বাক্ষর দেয়ার চাপ দেন। আর সেই চেক দিয়ে কত টাকা উত্তোলন করেছেন তা জানতেন না বিদ্যলয়ের ম্যানেজিং কমিটি সদস্যরা।
পাইন্দু হেডম্যান পাড়ার গ্রামপ্রধান থোয়াইসা মারমা বলেন, কয়েক বছর আগে পাইন্দু হেডম্যান পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বদলি হয়ে অন্য বিদ্যালয়ে চলে যান প্রধান শিক্ষক মো. আল আমিন। তখনও তিনি নিয়মিত স্কুলে আসতেন না। কয়েক বছর থাকার পর আবারো পাইন্দু হেডম্যান পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালযয়ে ফিরে আসেন তিনি। এখনো নিয়মিত স্কুলে উপস্থিত থাকেন না তিনি।
তিনি আরো বলেন, এ ধরনের শিক্ষক ১০০ জন থাকলেও পাড়াবাসীর ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখায় কোন উপকারে আসবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হেডম্যান পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আল আমিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। প্রধান শিক্ষকের অনিয়মিত উপস্থিতি ব্যাপারে এলাকাবাসীরা অভিযোগ দিলেও রুমা উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অনুপস্থিত থেকে উপস্থিত হাজিরা খাতায় দিন তারিখ লিপিবদ্ধ করে উপস্থিতি স্বাক্ষর রাখতেন তিনি। এছাড়াও স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করারও অভিযোগ এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির (এসএমসি) সাবেক সভাপতি ছোহ্লা মং মারমা বলেন, গত জুলাই মাসে ৯ থেকে ১৭ তারিখের মধ্যে বিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন মাত্র পাঁচদিন। চলতি আগস্ট মাসে প্রধান শিক্ষক আল আমিন এই পর্যন্ত মাত্র একদিন বিদ্যালয়ে এসেছিলেন। ওই দিন তিনি কোনো ক্লাস না করে আবার চলে যান।
তিনি আরো বলেন, ২০২৪ সালে বিদ্যালয় মেরামত কাজের জন্য অর্থের বরাদ্দ বিষয়ে তাকে কিছুই জানানো হয়নি। গত ৩০ জুনের আগে সভাপতি সীল দিয়ে কোনো কিছু লেখা ছাড়াই প্রধান শিক্ষকের চাপে স্বাক্ষর দিলেও কত টাকা উত্তোলন করেছেন তা জানতেন না তিনি। তাছাড়া ৩০ জুনের মধ্যে বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে স্কুলে মেরামত করার কথা থাকলেও প্রায় দেড়মাস পেরিয়ে গেছে এখনো করেননি।
উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যালয় মেরামত কাজের জন্য ২০২৩-২৪ অর্থ সালে ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ পায়। গত ২৮ ডিসেম্বর তৃতীয় কিস্তির মাধ্যমে ২১ হাজার পাঁচশ টাকা উত্তোলন করে প্রধান শিক্ষক। এর আগে দুই কিস্তি সভাপতি স্বাক্ষর ছাড়া টাকা উত্তোলন করা হয়। ২০২৩ সালে ৭ জুলাই কৃষি ব্যাংক থেকে জাল স্বাক্ষর করে পনেরো হাজার উত্তোলন করেন। কিন্তু টাকা উত্তোলনের পরও সঠিকভাবে কাজ করেননি তিনি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রুমা শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান হেডম্যান পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থেকেও জাতীয় পতাকাও উত্তোলনের দায়িত্ব কাউকে দেওয়া হয়নি। বিদ্যলয়ের বারান্দায় অগোছালোভাবে কাপড় টাঙানো। বিদ্যালয়ে তিনটি কক্ষে শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠদান করাচ্ছে ইউএনডিপির তিনজন শিক্ষক। এ সময় ইউএনডিপি থেকে দুইজন নিয়োগ প্রাপ্ত পিটিআইয়ের প্রশিক্ষণের শেষে সাময়িক সময়ের জন্য ওই বিদ্যালয়ে পাঠদানে দায়িত্ব পান। তবে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে চারমাসের জন্য পাঠিয়েছেন ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষ।
বিদ্যলয়ে ইউএনডিপি নিয়োগ প্রাপ্ত প্রুচিংথোয়াই মারমা বলেন, পিটিআইয়ের প্রশিক্ষণের শেষে চারমাস বিদ্যালয়ে পাঠদান করানো জন্য আমাদেরকে পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া আমরা কোন কিছুই জানি না।
এ ব্যাপারে পাইন্দু হেডম্যান পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আল আমিন জানান, পাড়াবাসী তো বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ান না। তাই প্রতিদিন স্কুলে যায় কিনা সেটা কেমন করে অভিভাবকরা জানবেন। এদিকে বিদ্যলয়ের বরাদ্দের নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
রুমা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আশীষ চিরান বলেন, জুলাই মাসে রাজনৈতিক কারণে বিদ্যালয় বন্ধ ছিল। এছাড়া অন্য বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি ।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, এই ইস্যুটা বান্দরবানের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হচ্ছে। শিক্ষার মানকে আরো শক্ত করতে ম্যানেজিং কমিটি সদস্যদের সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। আর যে অভিযোগ সেই বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।