parbattanews

বারুণী স্নানোৎসব: রামগড় সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারত মিলন মেলা

2 copy

মো. নিজাম উদ্দিন লাভলু , রামগড়:
ঐতিহ্যবাহি বারুণী  স্নানোৎসবকে ঘিরে  শুক্রবার রামগড় সাবরুম সীমান্তে ফেনী নদী পরিনত হয়েছিল  বাংলাদেশ ভারত দু’দেশের নাগরিকদের মিলন মেলায়। ১২ এপ্রিল ত্রিপুরায় লোকসভার নির্বাচন বিধায সীমান্তে ১৪৪ধারা জারী এবং বিপুল সংখ্যক  বিএসএফ ও পুলিশ মোতায়েন এমনকি ফেনীনদীতে তাবু গেড়ে মাইকে বিএসএফের পক্ষ থেকে সীমান্ত অতিক্রম না করার অবিরাম হুঁশিয়ারি ঘোষণা প্রচার করেও দুই বাংলার মানুষের স্রোত বেশীক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। উভয় দেশের হাজার হাজার পুণ্যার্থী ও দর্শণার্থীর সমাগমে সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি মুখরিত থাকে ফেনী নদী।

বৃটিশ আমল থেকেই চৈত্রের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশি তিথিতে প্রতিবছর ফেনী নদীতে বারুণী মেলায় মিলিত হন দুই দেশের হাজার হাজার  হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ। তারা পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য তর্পন করে এখানে। রামগড় ও সাবরুম অংশে নদীর দুই তীরে দুই দেশের পৌরহিতরা সকালেই বসেন পূজা অর্চণার জন্য। পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা ছাড়াও নিজের পুণ্যলাভ ও সকল প্রকার পাপ, পংকিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ফেনী নদীর বারুণী স্নানে ছুটে আসেন সনাতন ধর্মাবলম্বী আবালবৃদ্ধবণিতা।

সকাল ৭টা থেকেই শুরু হয় বারুণী স্নানোৎসব। স্নান কিংবা পুজা আর্চণা ছাড়াও দুই দেশে অবস্থানকারি আত্মীয়- স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করার জন্যও অনেকে দূর দূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসেন। ঐতিহ্যবাহি এ বারুণী মেলা উপলক্ষে বহুকাল থেকেই এদিনে দুদেশের সীমান্ত অঘোষিতভাবে কিছু সময়ের জন্য উন্মুক্ত থাকার সুবাদে এপার বাংলার মানুষ ছুটে যায় ওপারের সাবরুম মহকুমা শহরে , আবার ওপারের লোক এসে ঘুরে যান রামগড়। এ মেলাকে ঘিরে দুদেশের মানুষের মধ্যে তৈরী হয় ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির মেল বন্ধন। বারুণী মেলায় শুধু বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নয়, ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা, মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সমাগম ঘটে এখানে। বারুণী স্নান একটি ধর্মীয় উৎসব হলেও  দুদেশের বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও ধর্মের মানুষের সমাগমে এটি সার্বজনীন আনন্দ মেলার ঐতিহ্যে পরিনত হয়েছে। 

ঐতিহ্যবাহি এ বারুণী মেলা সম্পর্কে রামগড়ের অধিবাসি ও অসরপ্রাপ্ত সহকারি জেলা শিক্ষা অফিসার রামেশ্ব শীল বলেন, ‘ ভারত বিভক্তির পূর্বে এখানে বারুণী মেলায় বাংলাদেশ ভারত দুদেশের দূরদূরান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল পুণ্যার্থীর সমাগম হত। পাকিস্তান আমলেও ফেনী নদীতে বারুণী মেলা বসতো। অবশ্য তখন দুদেশের সীমান্ত পারাপারের সুযোগ ছিল না। দেশ স্বাধীনের পর থেকেই এ মেলাকে ঘিরে সীমান্ত আইনের অঘোষিত শিথিলতার কারণে দুদেশের মানুষ একে অপরের সান্যিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এ মেলাটি এখন দুদেশের সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়েছে। ধর্মীয় রীতি পালনের পাশাপাশি দুদেশে অবস্থানরত আত্মীয়  স্বজনদের দেখা সাক্ষাতেরও একটি চমৎকার ক্ষেত্র হয়েছে এ বারুণী মেলা।’ দুই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার  মানুষ এ বারুণী মেলায় আসেন আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতে। বাঙ্গালী হিন্দু ছাড়াও সনাতন ধর্মাবলম্বী  ত্রিপুরা  সমপ্রদায়ের অসংখ্য পুণ্যার্থীর সমাগম হয় এখানে। চট্টগ্রাম, ফেনী, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান,খাগড়াছড়ির, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, মানিকছড়ি প্রভৃতি এলাকা থেকে অসংখ্য  নারী পুরুষ পুণ্যস্নানে অংশ নিতে ছুটে আসেন ফেনী নদীতে। বাংলাদেশ ভারত দু’ দেশের পাহাড়ি বাঙ্গালী , বিভিন্ন ধর্ম,জাতি ও সম্প্রদায়ের আবালবৃদ্ধবণিতার বিপুল সমাগমে ফেনী নদী পরিণত হয় এক মিলন মেলায়।                           

রামগড় বাজার মুখরিত হয়ে উঠে ভারতীয়দের কেনাকাটা,পদচারণায়: বারুণী মেলা উপলক্ষে দুদেশের সীমান্ত অঘোষিতভাবে উন্মুক্ত থাকায় ওপারের সাবরুম থেকে হাজার হাজার ভারতীয় বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত ধেয়ে আসে রামগড়ে। একইভাবে রামগড় থেকেও ওপারে যান অগণিত মানুষ। ভারতীয়রা রামগড় বাজার থেকে সেমাই, নারিকেল, সাবান, শুটকি মাছ ইত্যাদি কিনে নিয়ে যায়। আবার ওপারের সাবরুম থেকেও এপারের লোকজন বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে আনে। আর কেনা কাটার সুবিধার্থে রামগড় বাজারের অলিগলিতে কতিপয় লোক দুদেশের টাকা বদলের ব্যবসা করেছে। রামগড় বাজারে আসা ভারতীয়রা ১০০ রুপিতে বাংলাদেশী  ১০০টাকা হারে পেলেও সাবরুমে বাংলাদেশীরা ১০০ টাকার পরিবর্তে ভারতীয় ৭০ রুপি করে পেয়েছে।

বিজিবি’র বক্তব্য

বারুনী মেলা উপলক্ষে সীমান্ত এলাকা দুদেশের মানুষে একাকার হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে  রামগড়স্থ ১৬ বিজিবির উপ অধিনায়ক মেজর রবিউল ইসলাম বলেন,‘ একদিকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ,অন্যদিকে যেভাবে স্রোতের মত মানুষ এপার ওপার হচ্ছে এদের বাধা দেওয়া দু:সাধ্যের ব্যাপার। তিনি আরও বলেন, আগামী ১২ এপ্রিল ত্রিপুরায় লোকসভার নির্বাচন। তাই আগে থেকে বিএসএফের পক্ষ থেকে সীমান্তে কড়াকড়ির অনুরোধ জানিয়ে ছিল বিজিবিকে। কিন্তু ওরাও শেষ পর্যন্ত জনস্রোত ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।
        রামগড় ও সাবরুমে  দুই দেশের বেশ কয়েকজন আটক: ফেনী নদী ও সাবরুম শহর থেকে প্রায় ২০জন  বাংলাদেশীকে বিএসএফ আটক করার পর রামগড়েও ভারতীয়দের ধর পাকড় শুরু করে বিজিবি ও পুলিশ। বেলা তিনটা পর্যন্ত বিজিবি ১৮জন ও পুলিশ ২৫জন ভারতীয়কে আটক করে। এব্যাপারে ১৬ বিজিবির উপঅধিনায়ক মেজর রবিউল ইসলাম বলেন, বিএসএফ আমাদের লোকদের আটক করায় আমরা সেদেশের কয়েকজনকে আটক করেছি। এ ব্যাপারে সারুমের ৫১ বিএসএফের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। মেলা শেষ হওয়ার পর  দুই দেশের আটককৃতদের  উভয় পক্ষ ছেড়ে দেবে।

Exit mobile version