বিজিবি ও বিজিপির সীমান্ত সম্মেলনে ১২ বিষয়ে ঐক্যমত

fec-image

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং মায়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)-এর মধ্যে মায়ানমারের রাজধানী নেপিতো-তে অনুষ্ঠিত ৮ম সীমান্ত সম্মেলন গত ২৪ নভেম্বর সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে ২৭ নভেম্বর ২০২২ তারিখে শেষ হয়েছে।

সেই সীমান্ত সম্মেলনের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে মঙ্গলবার (২৯ নভেম্বর) বিজিবি সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদ বিস্তারিত তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ওই সম্মেলনে আমার নেতৃত্বে ১০ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করে। প্রতিনিধিদলে বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এবং অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

অপরদিকে ডেপুটি চিফ অব মিয়ানমার পুলিশ ফোর্সের পুলিশ মেজর জেনারেল অং নেইং থুর নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের মিয়ানমার প্রতিনিধিদল সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে।

তাদের দলে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়াও সে দেশের প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র এবং অভিবাসন ও জনসংখ্যা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

সম্মেলনের সূচনা বক্তব্যে মিয়ানমার পুলিশ ফোর্সের (এমপিএফ) ডেপুটি চিফ বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে উষ্ণ ও আন্তরিক অভ্যর্থনা জানান। তিনি বিজিবি ও বিজিপির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ মনোভাব বজায় রেখে এবং একে অপরের মধ্যে যাতে কোনো মতানৈক্য সৃষ্টি না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের পরামর্শক্রমে সীমান্ত সমস্যাগুলো সমাধানের সদিচ্ছা প্রকাশ করেন।

তিনি ‘বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত চুক্তি-১৯৮০’-এর প্রতি মিয়ানমারের অটল অবস্থানের কথা ব্যক্ত করে মাদক পাচার ও সীমান্ত পারাপার রোধসহ বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সম্ভাব্য হুমকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুনরায় উভয় বাহিনীর মধ্যে সমন্বিত টহল শুরু করার বিষয়ে তাগিদ দেন।

তিনি সম্মেলনের আয়োজনে অত্যন্ত সন্তুষ্টি প্রকাশ করে সম্মেলনটিকে বিজিবি এবং বিজিপির (এমপিএফ) মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাইলফলক অর্জন বলে অভিহিত করেন। সম্প্রতি মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতের কারণে সীমান্তে সৃষ্ট উত্তেজনাকর অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বিজিপির প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে মাদকের প্রবাহরোধ এবং অবৈধ অনুপ্রবেশসহ বিভিন্ন ধরনের আন্তঃসীমান্ত অপরাধ মোকাবিলায় উভয় বাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে বিজিপির অব্যাহত সহযোগিতা কামনা করা হয় সম্মেলনে।

এছাড়াও বিজিবি মহাপরিচালক বাংলাদেশে আশ্রয়প্রাপ্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের বিষয়ে জাতীয় উদ্বেগের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন এবং মিয়ানমারের পক্ষ থেকে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।

এবারের অষ্টম সীমান্ত সম্মেলনে নেওয়া ১২ সিদ্ধান্ত:
১. সীমান্ত এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তথ্য আদান-প্রদানের প্রয়োজনীতার কথা স্বীকার করে উভয় পক্ষই বিভিন্ন পর্যায়ে নির্ধারিত ফোকাল পয়েন্ট ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ ও তাৎক্ষণিক তথ্য আদান-প্রদান করতে সম্মত হয়েছে।

২. উভয়পক্ষই প্রতি দুই মাসে একবার ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ের সমন্বয় সভা/পতাকা বৈঠক, বছরে দুইবার রিজিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে এবং বছরে দুইবার বিজিবি এবং বিজিপি (এমপিএফ)-এর মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলনের আয়োজন করতে সম্মত হয়েছে। এছাড়া প্রতিমাসে/পরিস্থিতি বিবেচনায় বিওপি/কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠক করার কথাও বলা হয়েছে।

৩. উভয়পক্ষ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী/সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করার বিষয়ে একমত হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির বিষয়টি গুরুত্বারোপ করে।

৪. উভয়পক্ষ অবৈধ অনুপ্রবেশ/সীমান্ত পারাপার রোধে কার্যকরভাবে একে অপরকে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে।

৫. সীমান্তের দুইপাশে আন্তঃসীমান্ত অপরাধীচক্র/সন্ত্রাসগোষ্ঠীর অবস্থান পরিলক্ষিত হলে তাদের অপতৎপরতা রোধে তাৎক্ষণিক তথ্য আদান-প্রদানসহ একে অপরকে কার্যকরভাবে সহযোগিতা করতে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছে।

৬. মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ আইসসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক পাচাররোধে মিয়ানমার সে দেশের জাতীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ নীতি অনুসরণ করে মাদক বিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। উভয়পক্ষই মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সীমান্তবর্তী জনগণের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে।

৭. পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদান এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবগত করার মাধ্যমে চলমান সীমান্ত পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ সীমান্ত প্রতিষ্ঠায় উভয়পক্ষ যৌথভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছে।

৮. উভয়পক্ষ ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠক/অ্যাডহক বৈঠকের মাধ্যমে নিজ নিজ দেশের প্রচলিত আইন অনুসরণ করে দুই দেশের কারাগারে আটক নাগরিকদের কারাবাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর/গ্রহণের বিষয়ে একমত হয়।

৯. উভয়পক্ষই সীমান্ত সম্পর্কিত প্রচলিত আইন ও অনুশাসন মেনে চলতে সম্মত হয়েছে। দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সীমান্তবর্তী শান্তিপ্রিয় জনগণের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি এবং বিভ্রান্তি এড়াতে মিয়ানমার ড্রোন/হেলিকপ্টার/বিমান চলাচলের আগাম তথ্যসহ সীমান্তে গোলাগুলি/বিস্ফোরণ ও নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান পরিচালনা সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান করতে সম্মত হয়েছে। সীমান্ত কাঁটাতারে ইলেকট্রিফিকেশান এবং ল্যান্ড মাইন স্থাপনের বিষয়ে বিজিবি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলে বিজিপি বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করবে বলে আশ্বস্ত করে।

১০. উভয়পক্ষই খেলাধুলা, প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ড বিনিময় এবং বিজিবি ও বিজিপি’র মধ্যে শুভেচ্ছা সফরসহ বিভিন্ন আস্থা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণে সম্মত হয়েছে।

১১. উভয়পক্ষ দেশের প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে দ্রুত সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে।

১২. বিজিবি ও বিজিপির মধ্যে পরবর্তী ৯ম সীমান্ত সম্মেলন আগামী ২০২৩ সালের মে/জুন মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে উভয়পক্ষ পারস্পরিক সম্মতি জ্ঞাপন করেন।

উল্লেখ্য, সম্মেলনের বাইরে বিজিবি মহাপরিচালক মিয়ানমারের উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ইউনিয়ন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করেন। এই সময় তিনি বলপূর্বক বাস্তুচ্যূত মিয়ানমার নাগরিকদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি দুই বাহিনীর পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় এবং অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন