parbattanews

বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনের জন্য সেখানকার জনগণের জনমত যাচাই করা হয়নি- সৈয়দ আবুল মকসুদ

 DSC05951

পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট:

বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, “বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনের জন্য সেখানকার জনগণের জনমত যাচাই করা হয়নি। তিনি উল্লেখ করেন রাষ্ট্রের কাজ জনগণের স্বার্থে কাজ করা”।

সিএইচটি কমিশনের উপর হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি উল্লেখ করেন,  “সংবিধান অনুযায়ি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ না করে বরং বিভিন্ন উন্নয়নের নামে নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে তাদেরকে আরো পিছনে ঠেলা হচ্ছে। বাবুছড়ায় ৫১ বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন করতে গিয়ে দুইটি আদিবাসী গ্রামউচ্ছেদ করার ঘটনা তিনি অমানবিক বলে উল্লেখ করেন। তিনি পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নসহ উচ্ছেদকৃত আদিবাসীদের দ্রুত পূনর্বাসন করার দাবি জানান এবং আদিবাসী বসতি ব্যতিরেকে অন্য কোন দূরবর্তী সীমান্তবর্তী জায়গায় বিজিবিক্যাম্প নির্মাণ করতে বলেন”।

৭ জুলাই ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির গোলটেবিল কক্ষে সম্প্রতি খাগড়াছড়ির ৪ নং দীঘিনালা ইউনিয়নের ৫১ নং দীঘিনালা মৌজার ৫১ বিজিবি সদর দপ্তর নির্মাণ ও পাহাড়ী পরিবার উচ্ছেদ ঘটনাবলী সরেজমিন পরিদর্শনোত্তর নাগরিক দলের উদ্যোগে একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

সংবাদ সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, কাপেং ফাউন্ডেশন ও জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র নাথ সরেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর এ্যাডভোকেট রেহানা কবীর, জীব বৈচিত্র ও আদিবাসীবিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ, হটলাইন বাংলাদেশের রোজালিন কস্তা, সাংবাদিক বিপ্লব রহমান, কাপেং ফাউন্ডেশনের দীপায়ন খীসাসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ। সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক সমাজের মূল বক্তব্য পাঠ করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও নাগরিক দলের প্রতিনিধি রাশেদ রাইন এবং সঞ্চালনা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রাজীব মীর।

সম্মেলনে আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, “রাষ্ট্র কতটুকু মানবিক তা দেশের আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি তাকালে বোঝা যায়। সিএইচটি কমিশনের মত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার ওপর হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, এ হামলার ঘটনাই প্রমাণ করে পাহাড়ে আদিবাসীদের অবস্থান কতটুকু নাজুক”।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, “সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না করে বরং পাহাড়ের আদিবাসীদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে”।

পরিদর্শনকারী নাগরিক প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য পাভেল পার্থ বলেন, “বাবুছড়া ইউনিয়নে বিজিবি ক্যাম্প করার অনুমতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি থাকলেও ক্যাম্প নির্মিত হচ্ছে দীঘিনালা ইউনিয়নের বাবুছড়া নামক একটি জায়গায়।তিনি আরো উল্লেখ করেন, যে কয়েকজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে তাদের মধ্যে তিনজন মৃত ব্যক্তির নামও আছে যা অত্যন্ত হাস্যকর। তিনি উল্লেখ করেন, উচ্ছেদ কৃত ২১ টি আদিবাসী পরিবার পাশের একটি স্কুলে আশ্রয় গ্রহণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন”।

সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে রাশেদ রাইন মূল বক্তব্যে বলেন, “আমরা যখন বাবুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়া উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসী পরিবারদের সাথে কথা বলি, আমরা স্কুলঘরের ভেতর তাদের সাথে প্রবেশ করেছি। ছোট তিনটি কামরায় গাদাগাদি করে ২১ পরিবারের ৮৪জনমানুষ থাকছেন। তারা এক কাপড়ে বাড়ি থেকে জানে পালিয়ে এসেছেন। কাপড়চোপড়, রান্নার বাসনপত্র কোনোকিছু আনতে পারেননি। আমরা সেখানে শরণার্থীশিবির বা ত্রাণকেন্দ্রের মতো একটি বড় হাড়িতে ভাত ও বিভিন্নধরণের সব্জি দিয়েএকটি তরকারি দেখতে পেয়েছি। জেনেছি তারা সকলে দুবেলা খাচ্ছেন। স্কুলের শিশু, বয়:সন্ধিকালিন মেয়ে ও ছেলেদের অবস্থা খুব করুণ। বুকের দুধ খায় এমন শিশুও আছে। খাবারপাত্র হিসেবে বেশকিছু টিনের থালা ধার করে এনেছেন। পানিখাওয়ার জন্য প্লাস্টিক বোতল রেখেছেন। স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন বলে উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাশেরও সমস্যা হচ্ছে। কারণ এখানে কক্ষ সংখ্যা সীমিত। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে আমরা কথা বলেছি। তারা উচ্ছেদ হওয়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। এঘটনার বিচার দাবি করেছে। এ ঘটনার সমাধান চেয়েছে। এখনও পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে কোনো ত্রাণ, খাদ্য সহযোগিতা, ঔষধ, নিরাপদ পানি কোনোকিছুর ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনকি প্রচন্ড ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা হওয়ার পরও কেউম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেনি।

সবচে বড় সমস্যা হয়েছে মলমূত্র ত্যাগের। কারণ স্কুলে এত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ও স্থানের জায়গা নেই। এ অবস্থায় কারো কারো চুলকানি ও কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যাও দেখা দিয়েছে। তবে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমাদের কথা দিয়েছেন প্রয়োজনীয় ঔষধ, কিছু খাদ্য ও পানীয় জলের ব্যবস্থা তিনি অচিরেই সেখানকার উচ্ছেদকৃত পরিবারের জন্য করবেন। উচ্ছেদৃকতরা সকলেই জোরগলায় জানিয়েছেন তারা কেউ ক্ষতিপূরণ চান না, কোনো টাকা চান না। তারা নিজেদের গ্রামে বসবাস করতে চান। নিজের জুম জমিনে চাষবাস করে খেতে চান। তারা অন্যায়ভাবে জমি দখল করে বিজিবি ক্যাম্প চান না। তবে গ্রামবাসী, স্থানীয় সরকার সকলেই চান বিজিবি ক্যাম্প নির্মিত হোক। তবে কোনোভাবেই তা কাউকে উচ্ছেদ করে বা কারো জায়গা দখল করে নয়। সরকারি খাস জমি এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যেখানে এই ক্যাম্প সবচে জরুরী সেখানেই বিজিবি ক্যাম্প করাদরকার। উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসীদের সাথে কথা বলে, তাদের চাহনি ও পোশাকআশাক দেখে আমাদের মনে হয়নি তারা কেউ মিথ্যা বলছেন। তারা আমাদের শরীরে পুলিশ ও বিজিবির হামলার দাগ দেখিয়েছে। প্রেমদিনী চাকমা পিনন থামিওঠিয়ে পায়ের গুলির দাগ দেখিয়েছেন, গোপা চাকমার এক হাত ব্যান্ডেজ দিয়ে ঝোলানো। প্রায় অনেকের শরীরে হামলার দাগ ও জখমের চিহ্ন আছে। বরং আমরা বিজিবি, জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদকে প্রশ্ন করে অনেক প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর পাইনি”।

সংবাদ সম্মেলনে নিম্নলিখিত সুপারিশসমূহ উল্লেখ করা হয়:
“১. বিজিবি ক্যাম্প নির্মাণ সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী তদন্তের জন্য উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করা। ২. অবিলম্বে উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসীদের নিজ নিজ ভিটেমাটিতে প্রত্যাবর্তনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্থদের যথাযথ ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থা করা। ৩. আদিবাসীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আটককৃতদের মুক্তি প্রদান করা। ৪. রাষ্ট্রীয় সীমান্ত সুরক্ষার জন্য বিজিবি ক্যাম্প নির্মাণ আবশ্যক হলে বসতিহীন স্থানে তা নির্মাণ করা এবং বর্তমান স্থান থেকে বিজিবি ক্যাম্প অন্যত্র সরিয়ে নেয়া। ৫. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়ের সমস্যা সমাধানের দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা”।

সংবাদ সম্মেলনে সংহতি জ্ঞাপন করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, এএলআরডি, ব্লাস্ট, আইইডি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, জনউদ্যোগ, কাপেং ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ইত্যাদি সংগঠনসমূহ।

উল্লেখ্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দিঘীনালা উপজেলার ৪নং দীঘিনালা ইউনিয়নের ৫১ নং দীঘিনালা মৌজার বাবুছড়াতে বিজিবি ক্যাম্প নির্মাণকে কেন্দ্র করে ২১টির অধিক পরিবার নিজ ভিটেমাটি উচ্ছেদ বিষয়ক ঘটনাবলী সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য লেখক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষক ও গবেষকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি নাগরিক প্রতিনিধি দল ২৬ জুন হতে ২৮ জুন স্কুলে অবস্থান নেয়া পাহাড়ী পরিবারসমূহ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, নব্য নির্মাণাধীন বিজিবি সদরদপ্তরের উপ-অধিনায়ক, ক্যাম্প এলাকা, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এবং খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-এর সাথে সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয়।

পরিদর্শন টীমে ছিলেন- পাভেল পার্থ- আদিবাসী ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক গবেষক, বিপ্লবরহমান, সংবাদকর্মী, দৈনিক কালের কন্ঠ, রাশেদ রাইন, চলচ্চিত্র নির্মাতা, এ্যাডভোকেট রেহানা কবীর রানু, কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, আবিদ আজাদ, ঢাকা ট্রিবিউন, অনির্বাণ সাহা, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, শফিকুল ইসলাম, এএলআরডি, শাহীন শিরীন, মাধবাধিকার কর্মী, রাজীব মীর, সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কনিম চাকমা, ব্লাস্ট, দিলীপ চৌধুরী, চ্যানেল আই, খাগড়াছড়ি, আকরাম হোসেন, ডেইলী স্টার এবং পপেন ত্রিপুরা প্রমুখ।

Exit mobile version