বিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ না করেই বরাদ্দের টাকা তোলার অভিযোগ

fec-image

বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র কেনার জন্য সাড়ে ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে সরকারি দুইটি প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও বিদ্যালয়টিতে এখনো কোনো আসবাবপত্র পৌঁছায়নি। কী কাজে কত টাকা বরাদ্দ , তাও জানতে দেয়া হয়নি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। জনস্বার্থে গৃহীত প্রকল্পটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা, তা সরেজিনে যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকল্পের টাকা দিয়েছিলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

এ অবস্থায় দুইটি প্রতিষ্ঠান থেকে বিল উত্তোলন করে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া সুযোগ হয়েছে – প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও পাইন্দু ইউপি চেয়ারম্যান উহ্লামং মারমার। অনুসন্ধানকালে বান্দরবানের রুমায় পাইন্দু ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের তথ্য পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে উপজেলা পরিষদের এক লাখ ৮০ হাজার টাকার ব্যয়ে পাইন্দু ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের দুর্গম শুক্রমনি পাড়ায় নতুনপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’র নামে আসবাবপত্র সরবরাহ প্রকল্প নেয়া হয়। ওই প্রকল্পের সব টাকা উত্তোলন করা হলেও দুর্গম এলাকার শুক্রমনি তঞ্চঙ্গ্যা পাড়ায় অবস্থিত নতুনপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো আসবাবপত্র সরবরাহ করা হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আসবাবপত্র সরবরাহ করতে ১ম কিস্তির বিল উত্তোলন করার পর রুমা সদরে পাইলট পাড়াস্থ পাইন্দু ইউপি চেয়ারম্যান উহ্লামং মারমা তার অস্থায়ী কার্যালয় সংলগ্ন একটি ফার্নিচার দোকান থেকে লো-বেঞ্চ ও হাইবেঞ্চ নিয়ে আসা হয় ইউপি কার্যালয়ে। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি সভাপতি হিসেবে দেখানোর জন্য রুমা বাজার থেকে এক তঞ্চঙ্গ্যাকে তার ইউপি কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। কারণ প্রকল্পটি যে বিদ্যালয়ের নামে নেয়া হয় ওই পাড়ার সবাই তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের বসবাস।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউনিয়ন পরিষদের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চেয়ারম্যান নিজেই উদ্যোগ নিয়ে চালাকি ও মিথ্যা আশ্রয়ে আসবাবপত্র বিতরণ সভা আয়োজন করেন। এতে আমন্ত্রিত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসে পৌঁছালে তাকে (ইউএনও) বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি সভাপতি হিসেবে সত্য কুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে পরিচয় করিয়ে আসবাবপত্র বিতরণের প্রমাণ স্বরূপ ছবি তোলা হয়েছিল।

সূত্রমতে, সত্য কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (৩৫) পাইন্দু ইউনিয়নের কোনো ওয়ার্ড বা কোনা পাড়ায় থাকেন না কিংবা বাসিন্দাও নয়। সে রোয়াংছড়ি উপজেলার রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের রৌনিন পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা।

যেসব লো-বেঞ্চ ও হাইবেঞ্চগুলো এনে ইউএনওকে দেখিয়ে ছবি তোলা হয়েছিল, সেইসব বেঞ্চগুলোর প্রকৃত মালিক তংমক পাড়ার বাসিন্দা মংবাসা মারমা। ওই বেঞ্চগুলো পাইন্দু ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের তংমক পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য তৈরি করা হয়েছিলো।

ওই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মংবাসা মারমা পার্বত্যনিউজকে বলেন, তার বিদ্যালয়ের জন্য তৈরি করতে দেওয়া লো-বেঞ্চ ও হাইবেঞ্চগুলো ফার্নিচার দোকানে রাখা ছিলো । এসব বেঞ্চ নিয়ে গিয়ে ছবি তুলবে বিষয়টি পাইন্দু ইউপি চেয়ারম্যান উহ্লামং মারমা আমাকে কিছু জানাননি।

সত্য কুমার তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ওই দিন রুমা বাজারে কেনাকাটা কাজে ব্যস্ত ছিলাম। পাইন্দু ইউনিয়নের তার পরিচিত এক মেম্বার তাকে (সত্য কুমার) চেয়ারম্যান ডাকছেন, ১ হাজার টাকা দেবে, একথা জানিয়ে পাইন্দু ইউপি কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। ইউপি কার্যালয়ে গিয়ে দেখতে পান, বেশ কয়েক জোড়া লো-বেঞ্চ ও হাইবেঞ্চ অফিসে সাজানো। বলা হয়- ইউএনও’ র সাথে ছবি তোলা হবে। ইউএনও স্যার আসলে সবাই দাঁড়িয়ে বেঞ্চসহ ছবি তোলার পর স্যার চলে যান। পরে আমাকে ৫শ টাকা দিয়েছিলেন চেয়ারম্যান।

তবে স্থানীয়রা জনান, আসবাবপত্র বিতরণের ছবি তোলা হলেও পরে একটি বেঞ্চও ওই বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন শিবলী (ইউএনও) বলেন, বিষয়টি শুনেছি। ঘটনাটি তার যোগদানের আগে উল্লেখ করে বলেন, প্রকল্পটি পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বান্দরবান পার্বত্য জেলার বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কর্মসূচির আওতায় রুমার পাইন্দু ইউপি চেয়ারম্যান নামে পাঁচটি প্রকল্পের বিপরীতে ৪০ মেট্রিকটন চাউল ও ১০ মেট্রিক টন গম সর্বমোট ৫০ মেট্রিকটন খাদ্য শষ্য বরাদ্দ প্রদান করা হয়। যাহা সরকারিভাবে বর্তমান বাজার মূল্য ২২ লাখ টাকার বেশি।

পাঁচটি প্রকল্পের মধ্যে একটি প্রকল্পের নাম- নতুনপাড়া বেসরকারি স্কুলে আসবাবপত্র বিতরণ। বরাদ্দ ১০ মেট্টিকটন (চাল)। যাহা সরকারি খাদ্য গুদাম সূত্রমতে, সরকারিভাবে প্রতি কেজি চালের মূল্য ৪৭ টাকা ২৫ পয়সা। এই হিসাবে ১০ মেট্রিকটন চালের মূল্য সাড়ে চার লাখ টাকার বেশি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে প্রাপ্ত ৫০মেট্টিক টন খাদ্যশষ্য ইতোমধ্যে বান্দরবান জেলা পরিষদের মাধ্যমে উত্তোলন করে নিয়েছেন প্রকল্প সভাপতি ও পাইন্দু ইউপি চেয়ারম্যান উহ্লামং মারমা। তবে এই প্রকল্পের টাকায় পাইন্দু ইউনিয়নের সেই নতুন পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো আসবাবপত্র বিতরণ করা হয়নি।

নতুন পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মুনথন বম বলেন, গত পাঁচ বছরে পাইন্দু ইউপি বা জেলা পরিষদ থেকে তার বিদ্যালয়ের জন্য কোনো চেয়ার টেবিল আসবাবপত্র পাননি। বিদ্যালয়ের নামে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকায় দুইটি প্রকল্প বানিয়ে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি বান্দরবান জেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনের জোর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন- প্রধান শিক্ষক মুনথন বম।

তিনি বলেন, নতুন পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি গত এপ্রিল সরকারি গেজেটেডের মধ্য দিয়ে জাতীয়করণ করা হয়। ফলে এখন এই বিদ্যালয়টি পুরোপুরি সরকারি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ ব্যাপারে জনাতে চাইলে পাইন্দু ইউপি চেয়ারম্যান উহ্লামং মারমা উহ্লামং বলেন, ওই সব প্রকল্প অনেক দিনের আগের। কী হয়েছে, হয়নি; সেটা আমার জানা নেই বলে তার মুঠোফোনের কল কেটে দেন। পরে বারবার কল করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)’র দায়িত্বে থাকা প্রকৌশল শাখা কার্যসহকারী উনেইউন মারমা বলেন, জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। তিনি ফিরলে বিষয়টি জানাবেন। এই মুহূর্তে ব্যবস্থা নেয়ার মত তার কোনো এখতিয়ার নেই বলে জানিয়েছেন পিআইও উনেইউন মারমা।

তবে জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা কবে নাগাদ ভারত থেকে দেশে ফিরছেন, তা সঠিক করে জানাতে পারেননি- পিআইও।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: উন্নয়ন প্রকল্প, বিদ্যালয়
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন