বিলুপ্তির পথে মারমাদের লোকনাট্য পাংখুং’ জ্যা’

fec-image

আদিকাল থেকে যুগের পর যুগ ধরে আসছে মারমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির লোকনাট্য পাংখুং’ জ্যা’। মারমাদের এটি সর্বশেষ নিজেদের সংস্কৃতি। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের রীতিমতো লোকনাট্যটি পরিবেশন করা হত। এই সংস্কৃতির লোকনাট্যতে রয়েছে রাজা-রাণীর পোশাক, ছুড়ি, তলোয়ার, হাতিসহ আরো নানান কিছু গল্প। রয়েছে লোকনাট্য একটি বই। যে বইটিতে ‘পাংখুং ও জ্যা’ প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে মারমা ভাষা লেখাটি। ধাপে ধাপে লেখাগুলো মাধ্যমে পরিবেশন করা হত লোকনাট্যটি। আর এই নাট্যটি দেখতে বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসত পাহাড়ি জনপদের নানান ধরনের মানুষজন। জমে উঠত লোকনাট্য মেলাটি। কিন্তু আধুনিকতার ছোয়াতেই বিলুপ্তির পথে মারমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির লোকনাট্য পাংখুং’ জ্যা। সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে এই নাট্যধারা। তবে হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বান্দরবান ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট।

বান্দরবানে জেলায় মারমা জনগোষ্ঠীদের জনসংখ্যা সাড়ে ৮০ হাজারে বেশি। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা নৃগোষ্ঠীর জনজীবনে ও সমাজ জীবনে জীবন বোধ ভিত্তিক এবং মাতৃভাষা ভিত্তিক, সাংস্কৃতিক কৃত্যপ্রযুক্তি জীবনাচারে সংগীতকলা, নৃত্যকলা, বাদ্যকলা, নাট্য কলার গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ নিজেদের লোকনাট্য সংস্কৃতি উজ্জীবিত করতে কারো মাথা ব্যাথা নাই। দিন যতই সামনে আগাচ্ছে ততই বিলুপ্তি হচ্ছে মারমাদের নানা সংস্কৃতি। শহরকেন্দ্রীক যেসব গ্রাম রয়েছে সেই গ্রাম থেকে অনেক আগে থেকে হারিয়ে গেছে এই লোকনাট্য অনুষ্ঠানটি। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের যেসব লোকনাট্যটি হওয়ার কথা সেখানে শুরু হয়ে গেছে আধুনিকতা অনুষ্ঠান। তবে প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলগুলোতে এই লোকনাট্য প্রচলিত থাকলেও কমই দেখা যায়।

মারমা ভাষার লেখক ও গবেষক মংক্যশোয়েনু নেভী বলেন, রাঙামাটির বেতবুনিয়ার মারমা পাড়ায় ‘পাংখুং’ পালা এক সময় বহুল প্রচলিত ছিল। সেখান থেকে এ নাট্যধারা অন্যান্য মারমা প্রধান স্থানেও ছড়িয়ে পড়ে। পাড়ার জুমচাষি মরামা নারী-পুরুষ নিজেরাই এসব পালায় অভিনয় করেন এবং পাড়াবাসীরাই দর্শক-শ্রোতা হিসেবে তা উপভোগ করেন। যুগ যুগ ধরে এটি মারমা সমাজের প্রধান বিনোদন মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ২৫-৩০ বছর আগেও বড় বড় মারমা পাড়াগুলোতে ‘পাংখুং’ দল দেখা যেত। কালের গ্রাসে হারিয়ে যেতে বসেছে এ শিল্প। এখন দুই-একটি দল খুঁজে পাওয়া গেলেও চাহিদা না থাকায় তাদের তেমন কোনো কাজ নেই।

মারমা জাতিগোষ্ঠী সাথে কথা বলে জানা গেছে, মারমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি লোকনাট্য পাংখুং, জাইক, কাপ্যা ইত্যাদি মারমা সমাজে জনপ্রিয়। নাটক, গান, নৃত্য সমন্বয়ে সুন্দর একটা কাহিনীকে লোকনাট্য বলে থাকেন। এটি মারমা ব্যতীত অন্য কোন জাতিগোষ্ঠীর কাছে নেই। পাংখুং’ গীতিনাট্য অনেকটা বাংলার যাত্রাপালা ও গীতিনাট্যের মতো। তাদের শিল্পী, পোশাকসজ্জা, সুর, বাদ্যযন্ত্র ও কাহিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘মাহা জানাখা’ নামে ‘পাংখুং’ বৌদ্ধ জাতকের অবলম্বনে রচিত। রাজপুণ্যাহের মেলা, ধর্মীয় উৎসব ও অভিজাতদের জন্ম-মৃত্যু দিবসে রাতব্যাপী চলে ‘পাংখুং’ গীতিনাট্যের প্রদর্শনী। শীত উপেক্ষা করে রাত জেগে শিল্পীদের দরাজ গলার অভিনয় ও গানে মজে থাকেন দর্শক-শ্রোতারা। মঞ্চের বিয়োগান্ত দৃশ্যে কারও চোখের জল ঝরে, মিলনান্তক দৃশ্য জাগায় শিহরণ। তবে সেটি তেমন আর মেতে উঠে না আর কেউ গুরুত্ব দেয় না।

সম্প্রীতি রেনিং ও ডুলুপাড়া গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামের মধ্যখানে মাঠে চলছে লোকনাট্য মেলা পাংখুং। চারপাশে দেখতে উৎসুক জনতার ভীড়। অনুষ্ঠানকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের মেলা আসর বসিয়েছেন ক্রেতারা। লোকনাট্যটি দেখতে বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছুটে আসছেন ছোট- বড় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। লোকনাট্যে শুরুতে বাশিঁ বাজিয়ে ছয় জনের একটি দল নৃত্য পরিবেশন করতে বের হন। সেখানে নিজেদের সংস্কৃতি বাঁশি, ঢোলসহ রয়েছে নানান যন্ত্রপাতি। এরপরই ধাপে ধাপে লোকনাট্যটি পরিবেশন করা হয়। অন্যদিকে ‘জ্যা’ লোকনাট্যটি দেখতে ভীড় করেছেন দর্শকেরা।

বান্দরবান ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্যমতে, বান্দরবানের সাতটি উপজেলার মধ্যে তিনটি উপজেলায় পাংখুং ও জ্যা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারমধ্যে পরিপূর্ণ হয়েছে ছয়টি। প্রশিক্ষণের চলমান পর্যায়ের রয়েছে আরো দুটি। সেগুলো মধ্যে- বিশ বছর পর চালু হওয়া ‘রামা গল্পের মেওয়া পাড়া পাংখুং দল, সাতবছর পর উইজিয়া ধাম্মা গল্পের তালুকদার পাড়া পাংখুং দল, আটষট্টি বছর পর তঃক্কানু গল্পের চেমী ডুলুপাড়া পাংখুং দল, পনেরো বছর পর মাহাঃ জানাখা গল্পের রেনিং পাড়া পাংখু দল, মাঅংপ্রু গল্পের বুড়ি পাড়া জ্যা দল ও ঙি ঙি সাইং সাবায়া গল্পের সুন্দরী পাড়া জ্যা দল। এছাড়াও রুমা ও কুহালং ইউনিয়নের পাংখুং ও জ্যা দুটি দল এখনো প্রশিক্ষণের চলমান রয়েছে। যেসব গ্রামে এই লোকনাট্যটি বন্ধ ছিল সেগুলো গ্রামে বিভিন্ন স্থান থেকে প্রশিক্ষক এনে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্র, কাপড় ও প্রয়োজনীয় আনুষাঙ্গিক সহযোগিতা রয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট।

রেনিং পাড়া ও বুড়ি পাড়া গ্রামে পাংখু দলের সদস্য মংশৈপ্রু ও হ্লাশৈচিং মারমা বলেন, দীর্ঘ বছর ধরে মারমাদের লোকনাট্য পাংখুং ও জ্যা বন্ধ ছিল। ছাহ্ রা (লোকনাট্য গুরু) মারা যাওয়ার পর আর এই লোকনাট্যটি তুলতে পারেনি। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর লোকনাট্য পাংখুং মাহা জানাখা ও মাঅংপ্রু গল্পের জ্যা মঞ্চস্থ হয়েছে। আগামীতে যেন এই সংস্কৃতি ধারাকে ধরে রাখার আশা তাদের।

বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক মংনুচিং মারমা বলেন, বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে নিজেদের সংস্কৃতিকে তুলে আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যেসব স্থানে মারমাদের লোকনাট্য পাংখু” জ্যা’ হারিয়ে যাচ্ছে, সেসব গ্রামগুলোতে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি। কোথাও ছয়মাস, কোথাও আটমাস এভাবে করে কয়েকটি গ্রামের লোকনাট্যটিকে দাঁড় করাতে পেরেছি। আশা করছি আগামীতে এই সংস্কৃতি ধরে রাখতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট কৃর্তক আরও উদ্যোগ নেওয়া হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Notice: Trying to access array offset on value of type bool in /home/parbatta/public_html/wp-content/themes/artheme/ar_framework/functions_custom.php on line 255
আরও পড়ুন