বেঁচে থাকুক ছোট্ট সেরো
বান্দরবানের দুর্গম গ্রাম থেকে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স (সিসিএ) এবং বন বিভাগের মিলিত চেষ্টায় উদ্ধার হয়েছে একটা সেরো বা বুনো ছাগলের বাচ্চা। এখন সেটি কেমন আছে খোঁজ নিয়েছেন ইশতিয়াক হাসান
বান্দরবানের কুরুকপাতা ইউনিয়নের মুরং অধ্যুষিত দুর্গম গ্রাম ইয়াংনং। আলীকদম উপজেলার মাতামুহুরী সংরক্ষিত অরণ্যের লাগোয়া গ্রামটি পাহাড়ের ওপর। গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে জঙ্গলে গিয়েছিল মুরংরা। ওখানে জুমক্ষেত। সঙ্গে কয়েকটা শিকারি কুকুর। এ সময়ই মুরংদলটির কাছে চলে আসে শাবকসহ একটা সেরো বা বুনো ছাগল। শিকারি কুকুর টের পেয়ে যায় সেরোর উপস্থিতি। তাড়া করে মা ও শিশু সেরোকে। পিছু পিছু ছুটে মুরংরাও। কুকুরের তাড়া খেয়ে পালায় মা সেরো। ছানাটা তাল মেলাতে পারেনি। বেড়াতে এসে এভাবে অতর্কিতে মানুষ আর শিকারি কুকুরের নজরে পড়বে কে জনত!
ছোট ছোট পায়ে এলোমেলো ছুটতে গিয়ে শাবকটা পড়ে যায় জলায়। একটা কুকুর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটার ওপর। কুকুরটার কবল থেকে রক্ষা করল মুরংরা। ধরে নিয়ে গেল গাঁয়ে। তাদের ইচ্ছা ছিল প্রাণীটাকে বেচে দেবে। না হয় খেয়েই ফেলবে। তবে ভাগ্য ভালো—ওই এলাকায়, মানে মাতামুহুরী নদীর আশপাশের বসতিগুলোয় কাজ করছিলেন সিসিএর পাঁচজন প্যারাবায়োলজিস্ট। এরাও মুরং। একসময় শিকার করতেন। এখন করেন না। উল্টো কোনো বন্য প্রাণী ধরা পড়লে সিসিএর কর্মকর্তাদের খবর দেন। কোথায় কোন পাখি ডিম পাড়ছে, কোন এলাকায় কোন বন্য প্রাণীর আনাগোনা বেশি—এসব তথ্য সংগ্রহ করেন। অন্যদের শিকার না করতে উত্সাহিত করেন। তো সেরোটা ধরা পড়ার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিজার রহমানকে ফোনে ঘটনাটা জানালেন তাঁরা। তিনি মুরং শিকারিদের অনুরোধ করেন সেরোটাকে ছেড়ে দিতে।
বন্য প্রাণী রক্ষায় ও স্থানীয় অধিবাসীদের উন্নয়নে সিসিএ নানা ধরনের কাজ করছে। শিশুদের জন্য ‘তম’ নামে একটি স্কুলও গড়েছে।
একসময় যখন মুরংদের পূর্বপুরুষরা শিকার করত তখন মানুষ ছিল কম, বন্য প্রাণী ছিল বেশি। এখন মানুষ বেড়েছে। অন্যদিকে কিছু বন্য প্রাণী কমতে কমতে বিলুপ্তির কাছে পৌঁছে গেছে। সব সময় যে তাদের বুঝিয়ে কাজ হয় তা নয়। তবে এ যাত্রা মুরংরা রাজি হয়ে যায় সেরোটাকে ছেড়ে দিতে। প্যারাবায়োলজিস্টদের নিয়ে তারা শাবকটিকে নিয়ে গেল জুমক্ষেতের ধারে। দেখে শাবকের মা নেই। দুই দিন ওখানেই শাবকটিকে ছেড়ে নজর রাখল তারা। ছাগশিশুটাও বেশ চিত্কার করল মায়ের খোঁজে। কিন্তু ভয়ে পালিয়ে যাওয়া মা সেরো আর ওই এলাকা মাড়াল না। বাধ্য হয়ে শাবকটাকে নিজেদের পাড়ায় নিয়ে এলো মুরংরা।
বন বিভাগের সাহায্য
মা সেরোকে পাওয়া যাচ্ছে না, এমনটা জানার পর শাহরিয়ার সিজার কথা বললেন বন বিভাগের ওয়াইল্ড লাইফ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড নেচার কনজারভেশন ডিভিশনের (চট্টগ্রাম) ডিএফও বা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাছের মো. ইয়াছিন নেওয়াজসহ আরো কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে। ইয়াছিন নেওয়াজের মাধ্যমে যোগাযোগ হলো লামার ডিএফও এস এম কায়সারের সঙ্গে। ঠিক হলো, সেরোটাকে নিয়ে আসা হবে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে। মুরংরা সেরোটাকে ২৩ জানুয়ারি বিকেল তিনটায় পৌঁছে দেবে আলীকদমের মাতামুহুরীর জানালিপাড়া আর্মি ক্যাম্পে। সেখানে থাকবেন মাতামুহুরী রেঞ্জের রেঞ্জার জহির উদ্দিন মো. মিনার।
ছোট্ট সেরো
মুরং গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার নদী ও পাহাড়ি পথ পেরিয়ে তবেই পৌঁছতে হয় জানালিপাড়া ক্যাম্পে। ছোট্ট সেরোকে নিয়ে রওনা দিল মুরংদের দলটি। এবার মিলল বাড়তি খাতির-যত্ন। কখনো মুরংদের কাঁধে, কখনো কোলে চড়ে এলো ওটা। বন্য ছাগলটাকে পৌঁছে দিতে এলো পাড়ার কারবারিও। কয়েক ঘণ্টা বাদে দলটি পৌঁছে গেল জানালিপাড়া ক্যাম্পে। কর্মকর্তারা ওটাকে নিয়ে এলেন বন বিভাগের লামা অফিসে। তারপর সেরোটাকে ডুলহাজরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে নিয়ে এলেন বন কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ইয়াছিন নেওয়াজ জানালেন, সেরোটার বয়স একেবারেই কম। দুই-আড়াই মাস হবে। ওজন এগারো কেজি এবং লম্বায় দুই ফুট। দুগ্ধপোষ্য। তা ছাড়া কিছুটা আহতও। পার্কের পশু চিকিত্সক মাহফুজুর রহমানের তত্ত্বাবধানে সতর্কতার সঙ্গে রাখা হয়েছে। ঘাস আর বরবটির মতো সবজি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চিবোতে পারছে না। একটু একটু করে দুধ খাওয়ানো হচ্ছে।
সেরোবৃত্তান্ত
একসময় অনেকে ভাবতে শুরু করেছিল, সেরোরা বুঝি বাংলাদেশ থেকে হারিয়েই গেছে। তবে বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ নিশ্চিত করছে, এখনো হারিয়ে যায়নি। গত কয়েক বছরে সিসিএর ক্যামেরা ট্র্যাপে সাঙ্গু-মাতামুহুরী রিজার্ভে ধরা পড়েছে একাধিক সেরোর ছবি। আকারে ছাগলের মতো। শাবকদের দেখে বাছুরও মনে হতে পারে। গায়ের রং লালচে। জাতটা রেড সেরো নামে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম পধঢ়ত্রপড়ত্হরং ত্ঁনরফঁং, এটি আবার পধঢ়ত্রপড়ত্হরং ংঁসধঃত্ধবহংরং-এর একটি উপ-প্রজাতি। বাংলাদেশে ও মিয়ানমারে বিচরণ। নামে বুনো ছাগল হলেও অ্যান্টিলোপ গোত্রের প্রাণী। বাংলাদেশে বিচরণ করা একমাত্র অ্যান্টিলোপ এই সেরোরা।
রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির দুর্গম পাহাড়গুলোয় এখনো এদের দেখা মিলবে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড-মিরসরাইয়ের জঙ্গল আর কুলাউড়ার লাঠিটিলা ও সাগরনালের জঙ্গলেও দেখা গেছে। অবশ্য কক্সবাজার কিংবা টেকনাফ গেম রিজার্ভের পাহাড়-জঙ্গল সাফ হওয়ার কারণে ওই এলাকায় আর আছে কি না নিশ্চিত নয় কেউ। তবে লামা-আলীকদমে এদের বিচরণের খবর শুনেছিলাম আগেও। রাতভর জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় সেরোরা। দিনে ঝোপ-ঝাড়, গুহা বা গর্তে বিশ্রাম নেয়। পাহাড় বাইতে ভারি ওস্তাদ। খাড়া পাহাড়েও হাঁটাচলা করতে পারে অনায়াসে।
সূত্র : কালের কণ্ঠ , ইশতিয়াক হাসান