ভাতা বা সাহায্যের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি: মনীষ দেওয়ান

fec-image

‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন, সবচয়ে বড় অহংকার। আমি কোনোদিন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নেইনি, কারণ আমি তো কোনো ভাতা বা সাহায্যের জন্য যুদ্ধ করিনি।’ এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিজের উপলব্ধির কথা জানান মনীষ দেওয়ান।

মনীষ দেওয়ান বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, একাত্তরে যারা পূর্ণবয়স্ক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান হয়েও যুদ্ধে অংশ নেয়নি, তারা হয় কাপুরুষ, নতুবা পাকিস্তানপন্থী।’

১৯৭১ সালে মনীষ দেওয়ান রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন, ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন ১৮ বছর বয়সী মনীষকে ঠিকই ছুঁয়ে গেছে। অন্য অনেকের মতো তাঁকেও উজ্জীবিত করেছে, কিন্তু ক্যাডেট কলেজের আবহ ও বাস্তবতার কারণেই রাজনীতির সঙ্গে কখনই সম্পৃক্ত ছিলেন না তিনি। সম্ভবও ছিল না।

কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীতে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার সংবাদ জেনে আর ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে স্থির থাকতে পারেননি এই তরুণ। আরো কয়েকজন বন্ধুসহ যাত্রা শুরু করেন অচিন গন্তব্যে।

প্রসঙ্গক্রমে মনীষ দেওয়ান বলেন, ‘আমার ক্লাসমেট ও প্রয়াত বন্ধু সাঈদ এস্কান্দারের বোনের জামাই ছিলেন জিয়াউর রহমান, এটা আমি জানতাম। কিন্তু সেই তিনিই স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, বিষয়টি আমাকে অন্যরকমভাবে প্রণোদিত করে।’

‘এপ্রিলের দিকে আমরা নোয়াখালী হয়ে রামগড়ে পৌঁছাই। সেখানে রামগড় হাই স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। সেক্টর নম্বর ১। সেখানে আমি মেজর জিয়াকে দেখি। তখন তাঁর মুখে বড় বড় দাঁড়ি, সম্ভবত বেশ কিছুদিন দাঁড়ি কামাতে পারেননি। সেখানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আফতাবুল কাদের (পরে শহীদ), আফজাল ইবনে নূরসহ (বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী) বেশ কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হয়।

সেখানে কয়েক দিন অবস্থানের পর আমরা সাব্রুম সীমান্ত হয়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টারে যাই। সেখানকার হাফলং প্রশিক্ষণ শিবিরে আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এক সপ্তাহের। প্রশিক্ষণ শেষে আমরা সাব্রুম আসি। সেখানে রণবিক্রম ত্রিপুরাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ কয়েকজন ত্রিপুরা ও মারমা মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। ততদিনে সেখানে জিয়াউর রহমানের স্থলে মেজর রফিক সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগ দেন এবং সেক্টরটিও আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছিল।

সেখানেই একদিন রণবিক্রম ত্রিপুরা আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, মুজিব বাহিনী গঠিত হচ্ছে, ওইটা হবে আরো বেশি শক্তিশালী ও সক্ষম বাহিনী। আমি যোগ দিচ্ছি, তুমি যোগ দিবে কি না। আমিও সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম এবং আগরতলা চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেরাদুনে এক মাসের প্রশিক্ষণ পেলাম। সেখানকার প্রশিক্ষণ বেশ উন্নত এবং থাকা-খাওয়াও ভালোই ছিল। আমারও ভালোই লাগল সবকিছু মিলিয়ে। তবে সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি রাজনৈতিক মোটিভেশনও দেওয়া হতো। ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল সুজান সিং ওভান সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।’

মনীষ দেওয়ান বলেন, ‘ট্রেনিং শেষে আমাকে বলা হয় মিজোরামের দেমাগ্রীতে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। কারণ সেখানে মিজোবাহিনী খুব সমস্যা করছিল। আমরা নির্দেশমতো দেমাগ্রী পৌঁছে যাই। সেখানে অশোক মিত্র কার্বারি, উ ক্য জেনের সঙ্গেও দেখা হয়। দেমাগ্রীতে আমরা প্রায় ২৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম, এদের প্রায় সবাই বাঙালি, পাহাড়ি ছিলাম আমরা হাতেগোনা কয়েকজন। আমরা বিভিন্ন সময় ঠেগামুখ দিয়ে ছোটহরিণা বাজার পর্যন্ত অভিযান চালাতাম।

ছোট ছোট অভিযান, আবার দ্রুত ফিরে যেতাম। রাঙামাটি পর্যন্ত যাওয়ার সাহস করতাম না। কারণ রাঙামাটি শহর ও আশপাশে রাজাকাররা কিলবিল করত। পাকিস্তানি বাহিনীর উপস্থিতিও ছিল প্রচুর। রাঙামাটি শহরে এত বেশি পরিমাণ পাকিস্তানের দালাল ও রাজাকার ছিল যে আমরা সেখানে সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য কোনো সোর্সও তৈরি করতে পারছিলাম না। দুঃখজনক হলেও সত্য, একাত্তরে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল রাজাকারের চারণভূমি।’

“বরকলের ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে ঠেগামুখের বেশ কাছেই ছিল আমাদের ক্যাম্প। একবার আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হলো, পাকিস্তানিদের সহযোগী মিজো বাহিনীর নেতা ‘লাল দেঙ্গা’কে হত্যা করার। লাল দেঙ্গা তখন রাঙামাটি শহরেই ডিসি বাংলোর পাশে এসডিওর বাসার পাশেই একটি বাড়িতে থাকতেন। কিন্তু এই অপারেশনে আমরা সফল হইনি রাঙামাটিতে আমাদের বিশ্বস্ত কোনো সোর্স না থাকায়। তখন রাঙামাটি শহরে পাকিস্তানিদের এত বেশি দাপট ছিল যে শহরে প্রবেশ করাও ছিল বেশ কঠিন আর লোকজনের মধ্যেও বড় একটা অংশ ছিল পাকিস্তানপন্থী। ফলে আমরা সুবলং পর্যন্ত এসে ফিরে যেতে বাধ্য হই।”

সহযোদ্ধাদের স্মরণ করে মনীষ দেওয়ান বলেন, ‘আমাদের আগে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্বপন চৌধুরীর নেতৃত্বে রাঙামাটি শহরে প্রবেশ করতে গিয়ে ডিসি বাংলো এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অ্যামবুশে পড়ে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হয়।’

যুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে মনীষ দেওয়ান বলেন, ‘নভেম্বর মাসেই পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে আসল যুদ্ধ শুরু হয়। এর আগে আমরা বিচ্ছিন্নভাবে যা করেছি বা করার চেষ্টা করেছি তাকে ঠিক যুদ্ধ বলা কঠিন। শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আমরা তখন পর্যন্ত পেরে উঠছিলাম না। নভেম্বরে ভারতীয় বাহিনী যোগ হয় আমাদের সাথে। নভেম্বরে জেনারেল সুজান সিং ওভান দেমাগ্রী আসেন এবং সেই সাথে ভারতীয় বাহিনীর বিপুল রসদও।’

মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময়গুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে মনীষ দেওয়ান বলেন, ‘নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এক রাতে আমরা দুই ব্যাটালিয়ান যোদ্ধা দেমাগ্রী থেকে ঠেগামুখ হয়ে ছোট হরিণা বাজারে অভিযান চালাই। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তিন-চারদিন যুদ্ধ শেষে আমরা ছোট হরিণা বাজারের নিয়ন্ত্রণ নেই এবং বরকল অভিমুখ অগ্রসর হই। সেখানে আমি নিজ হাতে দুজন পাকিস্তানি সেনা হত্যা করি।

তাঁদের ব্যাপক ক্ষতিও সাধিত হয়। এরপর আমরা বরকলে পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ করি। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের আশপাশের সাধারণ পাহাড়ি পরিবারগুলোকে সরে যাওয়ার জন্য তথ্য জানাতে।

আমি সেই মোতাবেক যাই। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী এই ফাঁকে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তাদের ক্যাম্প পুনর্দখল নেয় কিন্তু আমি আমার দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। অস্ত্র হাতে পাহাড়ি জঙ্গল, ছড়া দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটি আমি। রাতে জুমঘরে ঘুমাই। জঙ্গলের ফল-মূল খাই। এভাবেই দুই-তিনদিন পর আমি দেমাগ্রী পৌঁছাই।

আমাকে দেখে সবাই অবাক। তারা ভেবেছিল আমি মারা গেছি। টানা কয়েক দিনের হাঁটা আর শারীরিক দুর্বলতায় আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম আমি।’

মনীষ দেওয়ান বলেন, ‘এরপর একদিন আমাকে নিয়ে হেলিকপ্টারে রাঙামাটি শহরে রেকি করার জন্য নিয়ে যান ভারতীয় বাহিনীর একজন কর্মকর্তা। একদিনে তিনবার হেলিকপ্টারে রাঙামাটি শহর রেকি করি আমরা। এরপর ১৫ ডিসেম্বর তিনটি হেলিকপ্টারে করে অনবরত ফ্লাই করে প্রায় ২০০ ভারতীয় সৈন্য ও নয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে কুতুকছড়ি এলাকায় নামিয়ে দেওয়া হয়। আমার সঙ্গে ছিল সামসুদ্দিন (ওর বাবা ছিল রাঙামাটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আর ও ছিল রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র)। বাকিরা অন্যান্য জেলার বাসিন্দা।’

‘আমার কুতুকছড়িতে অবস্থান নেওয়ার খবর জেনে সাথে সাথে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক মর্টারশেল নিক্ষেপ শুরু করে। আমি আর সামসুদ্দিন সেইদিন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে যাই। ১৬ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণ অব্যাহত ছিল।’

মনীষ দেওয়ান বলেন, ‘তখন আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয় ফুরোমন পাহাড় অতিক্রম করে পুরনো কাউখালী বাজারের পাকিস্তানি অবস্থানে হামলা চালাতে। আমরা রাতভর পাহাড় অতিক্রম করে সকালে বাজারে গিয়ে দেখি পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প শূন্য, তারা সব পালিয়েছে। তখন আমাদের মূল সড়কটিতে ব্যারিকেড তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়।

রাস্তায় দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও যখন পাকিস্তানি বাহিনীর কোনো অস্তিত্ব দেখলাম না, তখন রাঙামাটি শহরের দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। কিন্তু আমি আর সামসুদ্দিন ছাড়া আর কেউ রাঙামাটি যেতে রাজি হচ্ছিল না। শেষে তারা চট্টগ্রামের দিকে রওনা হলো আর আমরা দুজন রাঙামাটির পথে। একটি পিকআপ পেয়ে যাই আমরা। সেটিতে করেই রাঙামাটির উদ্দেশে রওনা দেই। কিন্তু মানিকছড়ি এসে দেখি পাকিস্তানি বাহিনী যাওয়ার সময় ব্রিজটি ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। কোনো মতে ব্রিজটি পার হয়ে আমরা শহরে প্রবেশ করি।’

পার্বত্য এলাকায় প্রথম পতাকা ওড়ানোর ব্যাপারে মনীষ দেওয়ান বলেন, ‘আমি আর সামসুদ্দিন শহরে প্রবেশ করেই বর্তমান রাণী দয়াময়ী স্কুলের সামনে আমার খালার বাসায় গিয়ে জিনিসপত্র রেখে, ফ্রেশ হয়ে রিজার্ভ বাজারে ডিসি অফিসে গেলাম। ডিসির সাথে সাক্ষাৎ হলো আমাদের। আমাদের হাতে অস্ত্র।

ততক্ষণে পাকিস্তানি বাহিনীশূন্য রাঙামাটি, তাদের দালাল ও সহযোগী মিজোরাও পালিয়েছে। আমাদের আসার খবর পেয়ে শত শত মানুষ পুরাতন কোর্ট বিল্ডিংয়ে ছুটে আসতে থাকে। আমরা ডিসি অফিসে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের জন্য কোথাও একটা পতাকা পেলাম না। তাৎক্ষণিক পতাকা বানিয়ে সেই পতাকা ডিসি অফিসে টানিয়ে দিলাম। অবশ্য বিকেলে আবার শেখ ফজলুল হক মনি, জেনারেল সুজান সিং ওভানরা এলে আবারও পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছি আমরা।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা মনীষ দেওয়ান বলেন, ‘আমরা রাঙামাটিতে প্রবেশ করে কাউকে মারিনি, কারো ওপর হামলা করিনি।

অথচ আমরা জানতাম, জেনেছি, কারা রাঙামাটির সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল, কারা নিরীহ মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে নির্যাতন নিপীড়ন করেছিল। কিন্তু আমরা প্রতিশোধ নেইনি। আজ তাদের অনেককে দেখি রাজার হালে ঘুরে বেড়ায়। কষ্ট লাগে, অবাক হই। কিন্তু ভুলে যেতে পারি না তাদের অতীত। ইতিহাস নিশ্চয়ই তাদের অপকর্মের প্রতিশোধ নেবে।’

সুত্র: মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে এনটিভি রাঙামাটি প্রতিনিধি ফজলে এলাহীর সঙ্গে কথা বলেছেন মনীষ দেওয়ান

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন