parbattanews

ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে ৩ গ্রুপের ১৮শ’ সন্ত্রাসী চলছে নীরব চাঁদাবাজি, জিম্মি সাধারণ মানুষ

পাহাড়ের সুখ-দুঃখ-২
পিনাকি দাসগুপ্ত, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে:
রক্তাক্ত জনপদ হিসেবে পরিচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা। দীর্ঘ বাইশ বছর আগে শান্তির পায়রা উড়িয়ে যে বার্তা ঘোষিত হয়েছিল তা আবার ম্লান করে দিতে চাইছে আঞ্চলিক তিন গ্রুপের ১৮শ’ সশস্ত্র সন্ত্রাসী। এদের টার্গেট পাহাড়ে জুম্মল্যান্ড ও স্বায়ত্তশাসিত সরকার গঠন। গ্রুপগুলো হচ্ছে- জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-সন্তু), জনসংহতি সমিতির সংস্কারপন্থি ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।
তারা বিভিন্ন দেশ থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করছে। আর অস্ত্র কেনা ও নিজেদের সংগঠন চালানোর জন্য তারা চাঁদা আদায় করছে সাধারণ মানুষ, চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে । ফলে  জিম্মি হয়ে পড়েছে তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ মানুষ। প্রাণ ভয়ে তারা কেউই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যান না। সম্প্রতি পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করছেন এমন একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এ সব তথ্য উঠে এসেছে। পাশাপাশি এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপের সময় তারাও একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন।
পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শান্তি চুক্তির মাধ্যমে হত্যা, লুণ্ঠন, জ্বালাও, পোড়াও, নারী নির্যাতনসহ অসংখ্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অবসান হবে বলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনসাধারণ আশা করেছিল। সে আশা এখন নিরাশায় পরিণত হতে শুরু করেছে। শুধু বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নয়, পাহাড়িরাও অত্যাচারিত, নিপীড়িত এবং ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন।
জেএসএস, ইউপিডিএফ এবং সংস্কারবাদী নামে গড়ে ওঠা সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মানুষের কাছ থেকে নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে জোর-জবরদস্তি করে চাঁদা আদায় করে, আদায়কৃত চাঁদার টাকা দিয়ে অস্ত্র  কেনে এবং সেই অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আরো বেশি চাঁদা আদায় করে। তাদের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না নিম্ন আয়ের মানুষও। চাঁদা দিতে হচ্ছে স্থানীয় বাজারে কৃষিপণ্য বেচতে গেলেও।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন ও এলাকাবাসীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আরো জানা যায়, এই তিন গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৮শ’। তারা বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পোশাক ব্যবহার করে থাকে। এর মধ্যে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের রয়েছে প্রায় ৯শ’ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী।
তাদের অধীনে রয়েছে সামরিক কায়দায় ৬টি কোম্পানি। জেএসএস (সংস্কার) এর রয়েছে ২টি কোম্পানি। তাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীর সংখ্যা প্রায় পৌনে ৩শ’। আর  ইউপিডিএফ এর ৪টি কোম্পানির অধীনে রয়েছে প্রায় ৭শ’ সশস্ত্র সদস্য। ক্যাপ্টেন বা মেজর পদবির সদস্যরা কোম্পানিগুলোর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
গোয়েন্দারা জানান, দুই উপায়ে সশস্ত্র সদস্যরা তাদের দল ভারি করার চেষ্টা করেন। প্রথম তারা পার্বত্য অঞ্চলে খোঁজ করেন কোন্ কোন্ উপজাতির নামে মামলা রয়েছে অথবা অপরাধের দায়ে কাদের পুলিশ খুঁজছে। তাদের তালিকা তৈরি করে নানা প্রলোভন দেখিয়ে দলে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালানো হয়। আবার কিছু উপজাতিকে স্বাধীন পার্বত্য অঞ্চল অথবা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা জুগিয়ে প্রশিক্ষণসহ হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়।
এ সব সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যরা আবার দল থেকে প্রতি মাসে নিয়মিত বেতনও পান। সম্প্রতি উদ্ভাস চাকমা ও রাজু চাকমা নামে দুজনকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। পরে তারা পুলিশের কাছে নিজেদের সংগঠন ও কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়।
উদ্ভাস চাকমা ও রাজু চাকমা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তাদের রয়েছে নিজস্ব সেনাপ্রধান, আলাদা আলাদা কোম্পানি, বিভিন্ন উইং, শরীরে থাকে বাহিনীর পোশাক, হাতে অত্যাধুনিক ওয়াকিটকি, কাঁধে চকচকে ভারি ও দামি অস্ত্র। তারা প্রত্যেকেই প্রশিক্ষণ পাওয়া দক্ষ ও ক্ষিপ্র। ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলগুলোতে তাদের বিচরণ।
শুধু পোশাক আর অস্ত্র নয় তাদের রয়েছে নিজস্ব পরিচয়পত্র, মুদ্রা ও পতাকা। পাহাড়ে জুম্মল্যান্ড ও স্বায়ত্তশাসিত সরকার গঠনকে টার্গেট করে নীরবে সশস্ত্র কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছে এই সশস্ত্র সংগঠনগুলো। এ সব সংগঠনগুলো  ফেসবুক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেদের পতাকা, মুদ্রা ও পরিচয়পত্রের প্রচারণা চালাচ্ছে।
এ ব্যাপারে গত ২৫ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় তার নিজ দফতরে। তিনি কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন, কিছু প্রশ্নের জবাব কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। তবে তিনি বলেন, একটি সশস্ত্র গ্রুপ তিন পার্বত্য জেলাকে নিয়ে জুম্মল্যান্ড গঠন করতে চায়, তবে তারা সংখ্যায় খুবই কম। যারা এ সব করছে তারা দেশবিরোধী কাজ করছে। এ সব সরকার ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়।
তবে সন্ত্রাসীদের আলাদা পরিচয় নেই। তাদের পরিচয় তারা সন্ত্রাসী। তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, সেই ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি হয়েছে। শান্তি চুক্তি কি আবারো হবে? হবে না। বরং শান্তি চুক্তি যেটা হয়েছে সেটাই হচ্ছে আমাদের অধিকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নিয়ে নিরন্তর কাজ করছেন।
কংজুরী চৌধুরী আরো বলেন, আমরা এ বিষয়ে সরকারের যে কোনো পদক্ষেপকে স্বাগত জানাব। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার দেশের সব মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন করছে। পাহাড়েও সেই উন্নয়নের বাতাস বইছে। এখানে তৈরি হচ্ছে রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেডিক্যাল কলেজ। নানা উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত থাকলে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসতে বাধ্য। এখানে কিছু লোক সরকারবিরোধী কাজে যুক্ত রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সরকার পদক্ষেপও নিচ্ছে। আমরা সরকারের অংশ, শান্তি চাই।
অপর দিকে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহেদুজ্জামান বলেন, সশস্ত্র সংগঠনগুলো স্বাধীনতা চাচ্ছে কিনা আমার জানা নেই। তবে তারা ভূমি, বন ও পুলিশি ক্ষমতা পেতে চায়। আমি মনে করি এর অর্থ হলো সার্বভৌমত্ব চাওয়া। রাষ্ট্রের কোনো সম্পত্তি আঞ্চলিক পর্যায়ে দেওয়া উচিত নয়।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মজিদ আলী বলেন, যারা আলাদা পতাকা, মুদ্রা ও পরিচয়পত্র নিয়ে তত্পরতা চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অস্ত্রের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগে এ অঞ্চল দিয়ে অনেক বেশি অস্ত্র আসতো। এখন সেনাবাহিনী ও পুলিশের অভিযানের ফলে অনেক কমেছে। এটা এক ধরনের সফলতা বলে মনে করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকেও অস্ত্রের কানেকশন নিয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, উপজাতিদের বিভিন্ন গ্রুপের সশস্ত্র সদস্যরা প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না। তারা গভীর অরণ্য থেকেই তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে বলে আমাদের কাছে খবর রয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে গোপন প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। পুলিশ হেড কোয়ার্টারের যে নির্দেশ আসবে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এলাকার আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপারে পুলিশ সুপার বলেন, এক অর্থে এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো। এলাকায় হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক এসেছে। আমরা পর্যটকদের নিরাপত্তার যথেষ্ট ব্যবস্থা নিয়েছি। এমনকি মাসব্যাপী বিজয় দিবসের মেলায় পাহাড়ি বাঙালির ভিড় ছিল উল্লেখ করার মতো।
– সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক
Exit mobile version