ভূষণছড়া আক্রমণে বিডিআরসহ ৪ শত জন নিহত এবং ৫ শতের মতো আহত হয়
(২২)
ফারুয়াতে পঁয়ত্রিশ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ড হস্তান্তর করলাম নতুন কমান্ডিং অফিসারের কাছে। আমার কমান্ড হস্তান্তরের দুই ঘণ্টার মধ্যেই আমাদের পেট্রোল পার্টির উপরে শান্তিবাহিনীর আক্রমণ হলো। আমার কমান্ডে ব্যাটালিয়ান থাকাবস্হায় শান্তিবাহিনী ফারুয়া অঞ্চলে কোথাও আমাদের পেট্রোলের উপরে কখনও কোনো আক্রমণের সাহস করে নাই। এটা ছিলো শান্তিবাহিনীর প্রথম গোলাবর্ষণ আমাদের পেট্রোলের উপরে।
শান্তিবাহিনীর এই আক্রমণ সংঘটিত হয় কুসুমছড়ি ক্যাম্পের উত্তর-পূর্বে এবং শুক্করছড়ি ক্যাম্পের পূর্বে কর্ণফুলী পেপার মিলের বেম্বু এক্সট্রাক্সন রুটে। আমাদের পেট্রোল পার্টি শান্তিবাহিনীর দিকে পাহাড়ের উপরে চেজ করে উঠে যায় গহীন জঙ্গল ভেদ করে দৃপ্ত মনোবল ও সাহসী উদ্যমে । পরে সৈনিকদের জঙ্গল কেটে কেটে নিচে নামতে হয়েছিলো।
আমি আমার পূর্বের লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে, হেডম্যানদের সাথে শান্তিবাহিনীর যোগাযোগ আছে। আমাদের পেট্রোলের উপরে শান্তিবাহিনীর আমার ব্যটালিয়ানের কমান্ড হস্তান্তরের দুই ঘন্টার মধ্যেই এই আক্রমণ তারাই পোষকতা করে। অর্থাৎ আমার ব্যটালিয়ানের কমান্ড হস্তান্তরের খবর শান্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথে শান্তিবাহিনী আমাদের পেট্রোলের উপরে গোলাগুলি করতে আরম্ভ করে।
আমার পোষ্টিং হলো সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসে স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি এন্ড ট্যাকটিক্সের ( এস আই এন্ড টি) চীফ ইনষ্ট্রাক্টর( সি আই ) হিসাবে। আমি এস আই এন্ডটি টি থেকে চীনের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটিতে জয়েন্ট অপারেশন কোর্সে অংশ নিতে চীনের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির ফরেন উইং এর কেম্পাস বে্জিইং এর চল্লিশ কিলোমিটার দুরে অবস্হিত চাম্পিং কাউন্টিতে গমন করলাম। চীনের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে কোন এক সুবিধাজনক সময়ে লিখবো ইনশাহআল্লাহ।
আমি দ্বিতীয় বার পার্বত্য চট্টগ্রামের বরোবুনিয়াতে রাঙামাটি ব্রিগেডের অধীনে ছাব্বিশ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও হিসাবে যোগ দিলাম। ফারুয়া জোনের মতো বরোবুনিয়াতে আমার অপারেশনাল এরিয়া ফারুয়ার মতোই বড় ছিলো। উত্তরে মাইনিমুখ ডাউন সাউথ হতে দক্ষিণে, রাঙামাটি উত্তর,পশ্চিমে কালাপাহাড় এবং পূর্বে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত।
মজার ব্যপার হলো ছাব্বিশ বেঙ্গলের পুরো অপারেশনাল এরিয়াতে ছাব্বিশটির মতো ক্যাম্প ছিলো। আমি ব্রিগেডের আদেশ মতো প্রতি মাসে একবার করে প্রতিটি ক্যাম্প পরিদর্শন করতাম। বরোবুনিয়াতে ব্যাটালিয়ানের লোকেশন ছিলো ছোট কাঠতলী বাজারের উজানে পশ্চিম প্রান্তে কাপ্তাই লেকের পাড়ে।
রাঙামাটি থেকে শুভলং বাজার হয়ে বড় কাঠতলী এবং ছোট কাঠতলী বাজার পার হয়ে বামে পশ্চিমে কাপ্তাই লেকের পাড়ে। ব্যাটালিয়ানে বসে পূর্বে তাকালে কাপ্তাই লেকের অথৈ জলরাশী। পূর্বের পাহাড়ের সারিকে মনে হবে যেন দীঘল বিটপী রেখার মতো ধূম্র কুয়াশায় ঢাকা । বর্ষার সময় বড় কাঠতলী এলাকায় কাপ্তাই লেকের পানির ঢেউয়ের উচ্চতা দশ/ পনেরো ফুটের উপরে হয়। বর্ষায় এখানে সমুদ্রের স্বাদ পাওয়া যায়।
বারবুনিয়াতে এসে দেখলাম রাঙামাটি অঞ্চলের অপারেশন এরিয়াতে পুলিশ ক্যাম্প আছে, যেমন কাপ্তাই এর বিলাইছড়িতে আর্মড পুলিশের একটি ব্যাটালিয়ান ছিলো। এতে সুবিধা হলো শান্তিবাহিনীর কেউ ধরা পড়লে তাড়াতাড়ি পুলিশে হস্তান্তর করা সহজ হয়।
ব্রিগেড থেকে টাষ্কফোর্স অপারেশনের আদেশ আসলো। আমার নেতৃত্বে বরকল এলাকায় তিনদিনের জন্য পরিচালিত হবে। আমি ম্যাপ রিকোন্যায়সেন্স শেষ করে জগন্নাথছড়াকে সিলেক্ট করলাম টাষ্কফোর্সের হেডকোয়ার্টার হিসাবে। জগন্নাথছড়া বরকল এবং ভূষণছড়ার মধ্যস্হলে।
জগন্নাথছড়ায় এসে যা দেখলাম তাতে বিমোহিত না হয়ে পারা যায় না। জগন্নাথছড়ার পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ পাহাড়ে ঘেরা। পশ্চিমে নদী । পূর্বের পাহাড়ের উচ্চতা অনেক বেশী। জগন্নাথছড়ার ভিতরে এসে দেখি একটি আস্ত শহর জনমানবহীন। প্রথমে মনে হলো এ যেন আরব্য রজণীর গল্পের কোনো রাজবাড়ি যার সব মানুষকে দৈত্য খেয়ে ফেলেছে। সমস্ত এলাকা জুড়ে কেবল নতুন বিল্ডিং আর বিল্ডিং সব খা খা করছে ।
আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে একটি নতুন বিল্ডিংএ। বিল্ডিংএর ভিতরে ঢুকে মনে হলো এটা বিচারকের এজলাসের জন্য নির্মিত একটি ইমারত। আমি সিনিয়র জেসিওকে ডেকে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলাম, এই সুন্দর সুন্দর ইমারত কিসের জন্য এখানে তৈরী করা হয়েছে এবং এটা জনমানবহীন কেন?
সিনিয়র জেসিওর জবাব শুনে আমার মন খুব ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। সিনিয়র জেসিও বললেন, স্যার এই জগন্নাথছড়ার সব নতুন বিল্ডিং তৈরী করা হয়েছিলো বরকল উপজেলাকে এখানে স্হানন্তরিত করার জন্য। উপজেলার জন্য সব ইমারত তৈরির পরে এখন উপজেলার সব কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা বেঁকে বসেছেন জগন্নাথছড়ায় তারা কেউ আসবেন না। তাই জগন্নাথছড়ার উপজেলার জন্য নির্মিত সব ইমারত ফাঁকা পড়ে আছে।
এটাও কি সম্ভব স্বাধীন বাংলাদেশে? এতো বড় অপচয় কি মেনে নেয়া যায়? আমি জানি না জগন্নাথছড়ার এখন কি অবস্থা? রাতে আমরা অপারেশন পরিচালনা করলাম। দিনেও পেট্রোল প্রেরণ করা হলো পরিকল্পনা মাফিক। বিকালে আমি বের হলাম এলাকার সব ইমারত ঘুরে দেখার জন্য। হঠাৎ সামনে দেখলাম একটা মায়া হরিণ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হবে যেন ডাকলে কাছে আসবে। প্রায় দশ/ পনেরো সেকেন্ড মায়া হরিণটা আমার দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা ঘুরিয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গেলো। এই মায়াময় স্মৃতি আমি আজীবন মনে রাখবো।
পরে আমি ভূষণছড়ার গণহত্যার স্পট পরিদর্শন করি এবং উত্তরে সম্ভবতঃ জারুলছড়িতে অবস্হিত বিডিআর ক্যাম্পও পরিদর্শন করি। এই ভূষণছড়াতে চারশত বাঙালি পরিবারের বসত ছিলো। উনিশ শত চুরাশি সালের একত্রিশে মে শান্তিবাহিনীর প্রীতি গ্রুপের মেজর মণিস্বপনের নেতৃত্বে একশত পঞ্চাশ জনের একটি আর্মড গ্রুপ ভোর চারটার দিকে ভূষণছড়ার বাঙালি বসতি এবং জারুলছড়ির বিডিআর ক্যাম্প আক্রমণ করে।
শান্তিবাহিনীর এই আক্রমণে বিডিআরসহ চারশত জন নিহত এবং পাঁচ শতের মতো আহত হয় । এর পরে ভূষণ ছড়া থেকে সব বাঙালি পরিবার অন্যত্র চলে যায়। এখন ভূষণছড়ার কি অবস্থা আমার জানা নাই। নীচের লিংকে ভূষণছড়া জেনোসাইডের বিশদ বর্ণনা পাওয়া যাবে।
ভূষণছড়া গণহত্যা পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তম হত্যাকাণ্ড
♦ জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানঃ প্রাক্তন মহাপরিচালক বিডিআর।