ভূষণছড়া গণহত্যা: বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে

fec-image

পার্বত্যাঞ্চলের সবচেয়ে লোমহর্ষক হত্যকাণ্ডের নাম ‘ভূষণছড়া গণহত্যা’। ১৯৮৪ সালের ৩০ মে দিবাগত মধ্যরাত ৪টা থেকে পর দিন সকাল ৯টা পর্যন্ত রাঙামাটির দুর্গম উপজেলা ভারতীয় সীমান্তবর্তী অঞ্চল বরকল উপজেলায় এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এ জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটায় পাহাড়ের তৎকালীন স্বশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন ‘শান্তিবাহিনী।’

স্থানীয় ও তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন পত্রিকা এবং দেশের স্বনামধন্য কলামিস্টদের লেখনীতে এ নৃশংসতম হত্যকাণ্ডের ঘটনায় যাদের নাম উঠে এসেছে তারা হলেন- শান্তিবাহিনী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমা, বর্তমান সময়ের বিএনপি নেতা ও বিএনপির সাবেক উপ-মন্ত্রী মণি স্বপন দেওয়ান। সন্ত্রাসী সংগঠন শান্তিবাহিনীতে যার নাম ছিলো তিনি রাজেশ ওরফে মেজর রাজেশ নামে সুপরিচিতি ছিলেন। তৎকালীন সময়ে তিনি শান্তিবাহিনীর মেজর এর দায়িত্ব পালন করেছিলেন ।

জানা যায়- সত্তর দশকের শেষ দিকে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার জনসংখ্যার সুষম বন্টন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হত দরিদ্র এবং ভূমিহীন মানুষদের এ অঞ্চলে নিয়ে এনে সরকারি খাস জমিতে পুনর্বাসন করে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম জনংহতি সমিতি এবং তাদের স্বশস্ত্র শান্তি বাহিনী সরকারের এ সিন্ধান্তকে মেনে নেয়নি। যে কারণে সেইদিন আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনটি এ জঘন্যতম হত্যকাণ্ডের ঘটনা ঘটায়। মাত্র কয়েক ঘন্টার ঘটনায় মাইলের পর মাইল গ্রাম ধ্বংস করা হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ঘর-বাড়ি। লুণ্ঠন করা হয় টাকা-পয়সা, স্বর্ণলংকার। শত মায়ের বুক খালি করা হয়। স্ত্রী স্বামী হারিয়ে বিধবা, স্বামী স্ত্রী হারিয়ে বিপত্নী। পিতা হারিয়েছে তার সন্তান, সন্তান হারিয়েছে পিতা। বুক ভরা কান্না এবং তাদের আত্মচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিলো সেইদিন।

যে কান্না দীর্ঘ ৩৮ বছর পার হলেও বন্ধ হয়নি। ভাগ্যর নিয়তিতে বেঁচে যাওয়া শোকার্ত পরিাবারগুলো এখনো বিচার পাওয়ার আশায় নিভৃতে চোখের জল ফেলে। সময় গড়ালো, কয়েক যুগও কেটে গেলো, বিচার তো তারা ফেলো না। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অংশ নেওয়া সেই সময়ের সন্ত্রাসীরা এখনো শার্টে বোতাম খুলে দাম্বিকতা নিয়ে ঘুরে বেড়া। ওই সময়ের সন্ত্রাসীদের অনেক নেতা বর্তমানে স্বাধীন দেশের পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে পদ মর্যাদা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আবার তাদের এক মেজরও হয়েছিলেন উপমন্ত্রী। ভুক্তভোগীরা এখনো বুকে বেদনার জ্বালা নিয়ে পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায় বিচারের দাবি নিয়ে।

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে:

৩০ মে ১৯৮৪ সাল। কানে আওয়াজ পেতে শোনা গিয়েছিলো সন্ত্রাসী দল শান্তিবাহিনী ভূষণছড়ায় যেকোন সময় হামলা চালাতে পারে। স্থানীয়রা কেউ কেউ ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিলো। তারা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বিষয়টি অবগত করেছিলো। স্থানীয়রা সেইদিন লাঠি-শোটা নিয়ে প্রস্তুত নিয়েছিলো সন্ত্রাসীদের মোকাবিলায়। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের কাছে ঠিকে থাকতে পারিনি তারা। সেইদিন রাতে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিলো। হঠাৎ করে ভূষণছড়ায় বুলেটের বিকট আওয়াজ বেজে উঠেছে। সন্ত্রাসীরা তাদের তাণ্ডবলীলা শুরু করে দিয়েছে। চারদিক মুহুরমুহু গুলি এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিরস্ত্র, নিরীহ মানুষকে হত্যা এবং ঘর বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে পোড়া শুরু। যে যেদিকে পেরেছে জীবন নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলো।
হত্যাকান্ডের শিকার:

সন্ত্রাসী সংগঠন শান্তিবাহিনী কর্তৃক সেইদিন ৪১৭ বা তারও বেশি মানুষ সেইদিন শহীদ হয়েছিলো। অনেক মানুষের লাশ পাওয়া যায়নি। আবার অনেকের লাশ নদীতে ভেসে গেছে। অনেকের লাশ আগুনে পুড়ে গেছে। গর্ভবতী নারী, ছোট শিশু, কিশোর-কিশোরী কেউ বাদ যায়নি তাদের হাত থেকে। সদ্য বিবাহিত নারীদের করা হয় ধর্ষণ এবং পরে হত্যা। শিশুদের আছড়ে মারা হয়। গর্ভবর্তী নারীদের চাকু দিয়ে পেট কেটে বাচ্চা বের করা হয়। বুলেট দিয়ে হত্যার পাশাপাশি হাত-পা বেঁধে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাদের হত্যা করা হয় সাধারণ বাঙালি পরিবারের মানুষদের লাশগুলোকে করা হয় বিকৃত।

ভূষণছড়াকে হত্যাকাণ্ডের জন্য যে কারণে টার্গেট করেছে:

ভূষণছড়া রাঙামাটি পার্বত্য জেলা থেকে প্রায় ৫৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার পূর্ব ও উত্তরে অবস্থিত একটি দুর্গম জনপদ। রাঙামাটি জেলা সদর থেকে নৌকায় ৭৬ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে দিয়ে যেতে হয় ক্ষুদ্রতম পাহাড়ি জনপদ ভূষণছড়ায়। এ এলাকাটি ভারতীয় সীমান্তবর্তী এবং যে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে সহজেই ভারতে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব। কাপ্তাই হ্রদের তীরবর্তী ভূষণছড়া তিন দিকে পাহাড় ঘেরা। ভৌগোলিক এ সব কারণেই গণহত্যার জন্য সেদিন শান্তিবাহিনী ভূষণছড়াকে বেছে নিয়েছিল বলে ধারণা করে ভূষণছড়ার বাসিন্দারা। মনিস্বপন দেওয়ানের নেতৃত্বে শান্তিবাহিনীর একদল নারী-পুরুষ মিলে গভীর রাতে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলো।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজনহারা ভোক্তভোগীরা যা বলছেন:

ভূষণছড়ার স্থানীয় বাসিন্দা মো. আব্দুল হামিদ কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার মুখের ভাষা বন্ধ হয়ে গেছে। আর পারি না বলতে। সেইদিনের ঘটনায় আমি মা, বোন, বউ, ভাতিজা সব হারিয়েছি। ছোট ভাই আহত হয়ে এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে।

আব্দুল মোতালেব বলেন, আমি বাবা হারিয়েছি, জায়গা হারিয়েছি। সহায়- সম্বল সব হারিয়ে এখনো বেঁচে আছি স্বজন হারার বিচার পাওয়ার আশায়।
একই এলাকার তাসলিমা বেগম আত্মচিৎকার করে বলেন, এ বিচার কারে দিবো। কে আমাদের কথা শুনবে। বাবা হারিয়েছি। হারিয়েছি ভাইয়ের বউ, ভাই মামা, মামী। নিজে গুলি খেয়ে কোনরকমে বেঁচে আছি। এ জীবনে স্বজনহারার বিচার দেখে যেতে পারবো কিনা জানি না। তারপরও বিচার হোক খুনী সন্তু লারমা এবং মণিস্বপন দেওয়ান ওরফে মেজর রাজেশের।

কুঁজো হয়ে হাঁটা ৮০ বছরের বৃদ্ধা গুনাই বিবি বলেন, সব হারিয়ে এখন ভিক্ষা করি। মানুষের খেয়ে পরে বেঁচে আছি। সেইদিনের ঘটনায় আমি আমার ৬ সন্তান হারিয়েছি। হারিয়েছি পরিবার। মৃত্যুর আগেও বিচার দাবি করছি।

মফিজুর রহমান বলেন, আমি হারিয়েছি ভাই। হারিয়েছি সম্পদ। এখন নিঃশ্বহারা জীবন-যাপন করছি। খুনি সন্তু লরিমা ও মণি স্বপন দেওয়ানের বিচার দাবি করছি।

তিনি আরও বলেন, যদি দেশে যুদ্ধপরাধীদের বিচার করা হয় তাহলে কেন ভূষণছড়া গণহত্যাকারীদের বিচার করা হবে না?

জহুর আলী বলেন, জায়গা নেই, ঘরবাড়ি নেই। অনেক বলেছি; আর বলবো না। বললে আমাদের আরও ক্ষতি হবে। খুনীরা এখনো বুকে দাপট নিয়ে আমাদের সামনে ঘুরে। কেউ তাদের বিচার করে না।

ভূষণছড়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. আক্কাস আলী বলেন, আমি ঘটনার দিন সকালে তথ্য পায় যে শান্তিবাহিনী যেকোন সময় আমাদের গ্রামে হামলা করবে। তাই দেরি না করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য প্রদান করি।

তিনি বলেন, যদি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যদি দ্রুত ব্যবস্থা নিতো তাহলে এত বড় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারতো না।

ভূষণছড়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ও পুর্নবাসন গ্রুপ লিডার আব্দুল রাজ্জাক বলেন, ৮৪ সালের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের স্ত্রী, শশুর-শাশুড়ি হারিয়েছি। শুধু তা নয়; আমার গ্রুপের ২৯ জনকে হারিয়েছি।

তিনি বলেন- সন্ত্রাসীরা ১৯৯০ সাল, ৯২ সাল ৯৩ সালেও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে। ২০১১ সালে আমার সন্তানকে গুম করেছে সন্ত্রাসীরা। এখনো খুঁজে পায়নি আমার ছেলেকে।

আমরা পুনর্বাসিত ১ হাজার ৬শ পরিবার। এরমধ্যে শুধু ৫০ জনকে পুনর্বাসন করা গেলেও আমাদের বেশিরভাগ জায়গা-জমি পাহাড়িরা দখল করে বসে আছে। আমার একটাই দাবি এখন-যতদিন বেঁচি আঠি ততদিন ধরে সন্ত্রাসীদে বিরুদ্ধে বিচার দাবি করছি। আর আমাদের দখলকৃত জমি যেন আমার ফেরত পায়।

তদন্ত ও বিচার:

এ গণহত্যাকাণ্ডের কোনো তদন্ত ও বিচার হয়নি। অভিযোগ আছে যে সেদিনকার হত্যাকাণ্ডের পর গ্রামের মানুষ মামলা করতে বরকল থানায় গিয়েছিল। কিন্তু মামলা না নিয়ে পুলিশ জেনারেল ডায়েরি নিয়েছিলো। ভূষণছড়ার গ্রামবাসী ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা এখনও গণহত্যায় নেতৃত্বদানের অভিযোগে বিএনপির সাবেক উপ-মন্ত্রী মণি সাবেক শান্তিবাহিনীর গেরিলা মেজর মণি স্বপ দেওয়ান ওরফে মেজর রাজেশের বিচার দাবি করে আসছে। অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে যে, ভূষণছড়া হত্যাকাণ্ডের পর শান্তিবাহিনীর যে সকল সদস্য সীমানা পার হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল সরকার তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে জমি, রেশন, ঘরবাড়ি, চাকরি ও ব্যাংকঋণ দিয়ে বিভিন্নভাবে পুনর্বাসিত করেছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বরকল, ভূষণছড়া গণহত্যা, রাঙামাটি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন