মনিকা চাকমা ম্যাজিক গোলের রাজকন্যা

fec-image

বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট আবারও আলোচনায় নিয়ে আসে বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের। এই আলোচিত ফুটবল রাজকন্যাদের একজন মনিকা চাকমা। কুশলী এই খেলোয়াড় বল জোগান দেন। তবে দলের প্রয়োজনে দারুণ সব গোল করে দর্শকদের চোখে তাক লাগিয়েও দেন। ম্যাজিক গোল করে ফিফার ফ্যানস ফেভারিটের সেরা পাঁচে উঠে আসা এই মনিকার ফুটবল যাত্রা শুরু ২০১১ সালে বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল দিয়ে। খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়ার বর্মাছড়ির মনিকা ২৭ আগস্ট আড্ডায় বসেন আলোর পথযাত্রীর সঙ্গে। আশিক মুস্তাফাকে শোনালেন স্বপ্ন ও বাস্তবতার নানা কথা-

বেড়ে ওঠা সোনালি দিন

মনিকার বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়ার বর্মাছড়িতে। পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা শৈশব তার। কৃষক বাবা বিন্দু কুমার চাকমা ও মা রুবি মালা চাকমার পাঁচ মেয়ের মধ্যে সবার ছোট মনিকা। বাবার সঙ্গে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানোই ছিল যেন ছোট্ট মনিকার কাজ। পাহাড় বেয়ে নিচে নামা আবার দৌড়ে ওপরে ওঠাও একটা খেলা ছিল তার। সেই যে ওপরে ওঠার কষ্টটা আপন করেছেন, এখনও খেলছেন ফুটবল। জয় করেছেন বিশ্ব। ছোট্ট মনিকার এইটুকুন বয়স থেকেই ছিল ফুটবল-প্রীতি। তবে বাবা বিন্দু কুমার খুব একটা পছন্দ করতেন না। যদিও মনিকার অন্য চার বোন অনন্ত দেবী, রিতা দেবী, মিতা দেবী ও অনিকা দেবীও ফুটবল খেলতেন। ফুটবলপাগল মেয়েদের আদুরে বোন মনিকাকে একদিন বাবা ভর্তি করিয়ে দিলেন স্থানীয় মরাচেঙ্গি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই স্কুলে এসে ফুটবলের নতুন দুনিয়া খুঁজে পেলেন যেন। স্কুল-মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে রুটিন করে ফুটবল খেলা শুরু করেন মনিকা। তার ফুটবল কারিকুরিতে মুগ্ধ হন স্কুলের প্রধান শিক্ষক গোপাল দে। ছোট্টমোট্ট মনিকার ওপর ভর করেই ২০১১ সালে নাম লেখান বঙ্গমাতা প্রাইমারি স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টে। তখন মনিকা পড়েন তৃতীয় শ্রেণিতে।

রূপকথার শুরু…

প্রথম বছরেই ছোট্ট মনিকাদের স্কুল উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে জেলা পর্যায়ে খেলতে যায়। তবে জেলা পর্যায়েই প্রথম জার্নিটা শেষ হয়। ২০১২ সালে জেলা টপকে বিভাগে চলে যায় মনিকার মরাচেঙ্গি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিভাগীয় পর্যায়ে এসে হেরে গেলেও মনিকার খেলায় মুগ্ধ দর্শক। মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোচ বিরো সেনও অবাক হয়ে দেখেন মনিকার খেলা। ডাক পড়ে রাঙামাটি থেকে। ২০১৩ সালে বঙ্গমাতা প্রাইমারি স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলেন রাঙামাটির মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে। বিভাগ টপকে এবার জাতীয় পর্যায়ে এসে রানারআপ হয় তার স্কুল। তবে তার খেলায় মুগ্ধ হন ফুটবল পর্যবেক্ষকরা। ২০১৪ সালে রাঙামাটিতে অনূর্ধ্ব-১৪ টিমের একটা ট্রায়াল হয়। সেখানে ভালো পারফরম্যান্স আর অনবদ্য কারিকুরি দেখিয়ে মনিকা জায়গা করে নেন বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল দলে। ২০১৫ সালে এসে গায়ে জড়ালেন লাল-সবুজের জার্সি। এ যেন স্বপ্নের পথে ছুটে চলার হাইওয়েতে উঠে পড়েছেন তিনি।

তেজি ঘোড়া হয়ে ছুট!

ঘুমকাতুরে চোখের আদুরে মেয়েটি ২০১৬ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ দলের হয়ে তাজিকিস্তানে দেশকে চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে ঘরে ফেরেন। ছুটে তেজি ঘোড়া হয়ে। সেই টুর্নামেন্টে স্বাগতিক তাজিকিস্তানের জালে উপর্যুপরি গোল জড়িয়ে তুলে নেয় হ্যাটট্রিক। তাক লাগিয়ে দেন বিশ্বকে। ২০১৭ সালে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন বা এএফসি আয়োজিত অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপ কোয়ালিফায়ারস টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। মনিকার কল্যাণে এই খেলায় বাংলাদেশ টিম চীনা তাইপে, ইরান, আমেরিকা, কিরগিজস্তান ও সিঙ্গাপুরকে একত্রে ২৬ গোলে হারিয়ে ফাইনালে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর সুযোগ করে নেন। ওই টুর্নামেন্টে লাল-সবুজের তেজি ঘোড়াগুলো মাত্র দুই গোল হজম করে। তার খেলায় অভিভূত হয়ে সাফের বিচারক তাকে সবচেয়ে ভালো ফুটবলার হিসেবে বিবেচনা করেন।

ম্যাজিক গোল যেভাবে হলো

গত ৩০ এপ্রিল মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে বঙ্গমাতা আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপের সেমিফাইনাল খেলার সময় শেষ গোলটা দেন মিডফিল্ডার মনিকা। এতে ৩-০ গোলে জিতে যায় বাংলাদেশ টিম। মনিকার জাদুকরী গোলের ভিডিও যারা দেখেননি তারা বর্ণনাটা পড়তে পারেন- ডি-বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ের দুরন্ত ভলি দিয়ে বল জালে পাঠালেন মনিকা চাকমা। মনিকা এক ডিফেন্ডারকে গতিতে পেছনে ফেলে বল নিয়ে এগিয়ে যান। এরপর ছয় নম্বর জার্সি পরিহিত আরেক ডিফেন্ডারের মাথার ওপর দিয়ে বলটা সুবিধামতো জায়গা করে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন তিনি। এমন সময় তাকে আটকাতে এগিয়ে আসে প্রতিপক্ষ দলের আরও দুজন খেলোয়াড়। কিন্তু মনিকা বল হাতছাড়া হতে দেননি। পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকেই বাঁ পায়ে জোরালো কিক করে বসেন। প্রতিপক্ষ গোলকিপার গোল ঠেকানোর জন্য বেশ জোরে লাফ দেন। কিন্তু তাতে লাভ হয় না। বল গোলকিপারকে বোকা বানিয়ে ঢুকে যায় গোলবারের একেবারে ডানপাশ ঘেঁষে। প্রতিপক্ষের জালে তৃতীয় গোল, ফাইনালে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ।

ফিফার চোখে মনিকা

ফুটবল জ্বর পৃথিবীজুড়ে। এত এত ফুটবলপাগল দেশের মধ্যে প্রতিনিয়ত ঘটে অঘটন; খেলোয়াড়রা দেখায় ম্যাজিক। এত এত গোলের মধ্যে খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ার বর্মাছড়িতে বেড়ে ওঠা আদুরে মেয়েটির জাদুকরী গোল কীভাবে নজর কাড়ল ফিফার? আসলে ফিফা প্রতি সপ্তাহে বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফুটবল ফ্যানদের বলে, তাদের পছন্দের গোলের ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করতে; যেন ভালো গোল ফিফার চোখ এড়িয়ে না যায়। ফিফার এই ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশি এক ফুটবল ফ্যান তৌসিফ আক্কাস ফিফাকে জাদুকর মনিকার এই গোলের ভিডিওটি পাঠান। এভাবে তারা জানতে পারে মনিকা চাকমার জাদুকরী গোলের কথা।

বাবার আদুরে মেয়ে

দেশ-বিদেশ ঘুরে মনিকার হয়েছে রাজ্যের অভিজ্ঞতা। গ্রামের মেয়েটা পাঁচতারকা হোটেলের অভিজাত জীবনের সঙ্গেও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। অথচ বাবা বিন্দু কুমার চাকমা এখনও ভোর হলেই বেরিয়ে পড়েন কাজে। দিন আনি দিন খাই- এই নিয়মেই অভ্যস্ত যেন তাদের পরিবার। একসময় মেয়েকে ফুটবল খেলতে না দিতে চাইলেও এখন সেই মেয়েকে দেখলে প্রতিবেশীরা প্রশংসার ফুলঝুরি ফোটান। মেয়েও যতটা পারেন, বাবাকে সংসার চালাতে সহযোগিতা করেন। মনিকা মনে করেন, পরিবারের এই কষ্ট থাকবে না বেশিদিন। ফুটবল খেলে বাবার হাতে টাকা তুলে দিয়ে যে আনন্দ পান মনিকা, তা তার কাছে দুনিয়ার সব পাওয়ার চেয়েও আনন্দের মনে হয়।

ক্যাম্প জীবন

মনিকার দেওয়া সেই জাদুকরী গোলের ঘোষণা ফিফা দেওয়ার সময় ক্যাম্পেই ছিলেন মনিকা। একটু অবসর পেলে গান শোনেন মনিকা। সেদিনও গান শুনছিলেন। হঠাৎ ফোনে একজনের কাছ থেকে জানলেন এই খবর। এতে আনন্দে লাফিয়ে উঠে বাবাকে ফোন দিয়ে জানান। সেই গোলের কথা জিজ্ঞেস করলে মনিকা বলেন, ‘টিম অনুশীলনের বাইরেও আমি আলাদা গোল অনুশীলন করি। পোস্টের বাইরে গিয়েও শট করি। আমার কাজ গোল করানো। তবে কখনও কখনও মনে হয়,

আমার গোল করাটা জরুরি। সেদিনও এই জরুরি বিষয়টা অনুভব করে শট মেরেছিলাম। ভাগ্য সহায় ছিল।’ এই বলে হাসি। হাসলে চোখ ছোট হয়ে আসা মেয়েটার স্বপ্ন কিন্তু অনেক বড়। দেশকে নিয়ে যেতে চান আরও অনেক দূরে। হতে চান আরও বড় খেলোয়াড়। এমন আদুরে তেজি ঘোড়াদের নিয়ে তো আমরা স্বপ্ন দেখতেই পারি।

সূত্র: দৈনিক সমকাল

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ফিফা, বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল, মনিকা চাকমা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন