মাইকেল চাকমার বিরুদ্ধে এখনো যেসমস্ত মামলা চলমান

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ’র সশস্ত্র শাখার কমান্ডার মাইকেল চাকমার বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা চলমান রয়েছে। এরমধ্যে ১১টি মামলার বিস্তারিত তথ্য ইতোমধ্যে পার্বত্যনিউজের হাতে এসেছে।

রাঙামাটির লংগদু, নানিয়ারচর ও জুরাছড়িতে অনেকগুলো হত্যা ও চাঁদাবাজির মামলায় প্রধান আসামী মাইকেল চাকমা। তাছাড়া মাইকেল চাকমাকে একাধিকবার অস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাঙামাটি বিশেষ জজ আদালত গত বুধবার মাইকেল চাকমাকে ১০ বছরের কারা দণ্ডাদেশ দেয়ার পর বেশ ক’টি চাঞ্চল্যকর হত্যা ও চাঁদাবাজির মামলা সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য-উপাত্ত বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসতে শুরু করেছে।

জানা যায়, রাঙামাটি জেলার লংগদুতে ২০০৭ সালে ৩০ অক্টোবর মাইকেল চাকমা এবং তার সহযোগীরা মিলে স্থানীয় দুলাল উদ্দিন এবং বেশ কয়েকজন জেলেকে বেদম মারধর করে সাথে থাকা টাকা প্রকাশ্যে ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় দুলাল বাদি হয়ে মাইকেল চাকমাকে প্রধান আসামি করে মামলা করেন। মামলা দায়েরের পর অভিযুক্ত মাইকেল চাকমাসহ সহযোগীদের দ্রুত গ্রেপ্তারে এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অবশেষে অভিযুক্ত মাইকেল চাকমাকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সহ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় সেনাবাহিনী।

একই উপজেলার ভাইবোনছড়ায় খুন, চাঁদাবাজি এবং মারধরের ঘটনায় মামলা হয় মাইকেল চাকমার বিরুদ্ধে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তখন অভিযুক্ত মাইকেল চাকমাকে একটি দেশীয় অস্ত্র ও ছয় রাউন্ড গুলিসহ ফের আটক করতে সক্ষম হয়।

লংগদুতে মাইকেল চাকমা অনেকটা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। লংগদুর রঞ্জন চাকমা হত্যায় তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে। এই হত্যা মামলার আসামী মাইকেল চাকমা। মামলাটি এখনো চলমান। এই নির্মম হত্যায় অভিযুক্ত মাইকেল চাকমার বিচার চেয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালের ১৮ জুন মামলাটি দায়ের করা হয়। জানা যায়, রঞ্জন চাকমাকে দোকান থেকে ফেরার পথে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে অভিযুক্ত আসামীরা।

রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার তৎকালীন জনপ্রিয় চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা (৫৫) কে ২০১৮ সালে হত্যা করা হয়। এই মামলায় মাইকেল চাকমাকে অভিযুক্ত করে আসামী করা হয়। মোটরসাইকেলে অফিসে যাওয়ার সময় শক্তিমান চাকমাকে এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করে অভিযুক্তরা। মামলাটি এখনো চলমান।

শক্তিমান চাকমাকে হত্যা করেই খান্ত হয়নি অভিযুক্তরা। শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্যে অংশগ্রহণের জন্য তপন জ্যোতি চাকমা (বর্মা) তার সহযোগীদের নিয়ে যাওয়ার সময় গাড়িবহরে ইউপিডিএফ (মূল) সশস্ত্র অভিযুক্তরা হামলা করে তাদের সদলবলে হত্যা করে। এই চাঞ্চল্যকর নির্মম হত্যাকাণ্ডে তখন ফুঁসে ওঠে নানিয়ারচরবাসী। এসব হত্যা মামলায় মাইকেল চাকমা অভিযুক্ত হন এবং তাকে আসামী করা হয়। ২০১৮ সালের ৮ মে মামলাটি নীতিপূর্ণ প্রকাশ অচীন চাকমা বাদি হয়ে দায়ের করেন। মামলাটি এখনো চলমান।

জানা যায়, ২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি রাঙামাটির জুরাছড়ি থানায় নিরঞ্জন চাকমাসহ আরো ২ জনকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হন মাইকেল চাকমা। তিনি ওই মামলার প্রধান আসামি। মামলাটি নিরঞ্জন চাকমার স্ত্রী মিনা ঢাকমা দায়ের করেন। ওই বছরের ২১ জানুয়ারি দিবাগত রাতে ৩ জন ব্যক্তিসহ ৫ জনকে ইউপিডিএফ ধরে নিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে ৩ জনের গুলিবিদ্ধ লাশ ছোট তারাবুনিয়া এলাকায় পাওয়া যায়। বাকি ২ জন অপহৃত অবস্থায় ছিলেন। মামলাটি এখনো চলমান।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সিএমপির পাহাড়তলী থানায় একটি মামলার আসামি মাইকেল চাকমা। মামলার এজাহারে অভিযুক্ত আসামি মাইকেল চাকমা। তার কাছ থেকে ১৯০ পিস ইয়াবা অবৈধভাবে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিজের কাছে রাখা হয়। মামলায় উল্লেখ করা হয়, দু’টি এলজি ও ২ রাউন্ড কার্তুজ অবৈধভাবে নিজ দখলে রাখার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। মামলাটি চলমান।

২০১৮ সালে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে অনেকগুলো অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে মাইকেল চাকমার বিরুদ্ধে। ওই বছরের ১৮ জুন বাঘাইছড়ি থানায় সুরেন বিকাশ চাকমা (৫৫) হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হন মাইকেল চাকমা। এই মামলায় চার নম্বর আসামি তিনি। সুরেন বিকাশ চাকমাকে জেএসএস (সংস্কার) সন্দেহে ঘর থেকে ধাওয়া করে রূপকারী বিলের পাশে ছড়ায় নিয়ে ইউপিডিএফ (মূল) কর্তৃক গুলি করে এবং কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বলে জানা যায়।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাঙামাটির বাঘাইছড়ির বন কুসুম চাকমাকে (৪০) হত্যা করা হয়। এই মামলাটির আসামি মাইকেল চাকমা। মামলায় তিনি চার নম্বর আসামি। মামলায় উল্লেখ করা হয়, বন কুসুম চাকমা জমিতে চাষ করা অবস্থায় জেএসএস (সংস্কার) সন্দেহে, ইউপিডিএফ (মূল) কর্তৃক মাথায় ও শরীরে গুলি করে হত্যা করা হয়।

তাছাড়া ২০১৮ সালের ২৪ আগস্ট বাঘাইছড়ির মিশন চাকমা (২৮) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মাইকেল চাকমা জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। ওই হত্যা মামলায় তিনি তিন নম্বর আসামি। মামলার এফআইআরে উল্লেখ করা হয়, মিশন চাকমা দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে জেএসএস (সংস্কার) সন্দেহে, ইউপিডিএফ (মূল) কর্তৃক অস্ত্রের বাট, গাছের ডাল দিয়ে মাথা, ঘাড় এবং শরীরে স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত করে ধানী জমির পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।

একটি মামলায় রাঙামাটি বিশেষ জজ আদালত বুধবার মাইকেল চাকমাকে কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। জানা যায়, লংগদু উপজেলার ২টি পৃথক মামলায় ইউপিডিএফের সশস্ত্র গ্রুপের কমান্ডার এই মাইকেল চাকমা ও তার সহযোগী সুমন চাকমাকে মোট ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। দীর্ঘ ১৮ বছরের  বিচার প্রক্রিয়ার পর রাঙামাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল একযোগে এই রায় ঘোষণা করেন। আদালতের এই রায়ের পর স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আশা করছে যে, এটিই হবে পাহাড়ি এলাকায় সশস্ত্র চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস দমনের একটি দৃষ্টান্ত।

মাইকেল চাকমার এই দণ্ডাদেশের খবর ছড়িয়ে পড়লে তার নামে থাকা চলমান অন্যান্য হত্যা মামলার দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।

এদিকে মাইকেল চাকমার বিরুদ্ধে এই ১১টি মামলার তথ্য প্রকাশিত হলেও ২০১১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের এক প্রতিবেদনে ১৮টি মামলা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

তৎকালীন র‌্যাব-৭ চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধিনায়ক (ভারপ্রাপ্ত) মেজর আবদুস সামাদের বরাত দিয়ে বাংলানিউজ প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, ওই সময় (২০১১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি) র‌্যাব তাকে নগরীর পাহাড়তলীর বনিকপাড়ার একটি মেস থেকে ২টি এলজি এবং ২ রাউন্ড গুলিসহ গ্রেপ্তার করে। মাইকেল চাকমার বয়স তখন ৩৩ বছর এবং ইউপিডিএফের অঙ্গ সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম সদস্য সচিব। অস্ত্র বিক্রি করতে মাইকেল চাকমা রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রাম শহরে যায় এব তার পূর্ব পরিচিত এক চাকমা যুবকের সূত্র ধরে বনিকপাড়ার মেসে উঠে অস্ত্র বিক্রির জন্য গ্রাহক খুঁজছিলেন। মাইকেল চাকমাকে ধরার এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন র‌্যাবের তৎকালীন কোম্পানী কমান্ডার মেজর খুরশীদ আলম।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইউপিডিএফ, খুন, চাঁদাবাজী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন