মানিকছড়িতে সরকারি সোলার দিতে ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ
খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বাস্তবায়নাধীণ “পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় বিনামূলে সোলার প্যানেল বিতরণ কার্যক্রমে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিনামূল্যের সোলার প্যানেল পেতে সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে ৩ থেকে ৬ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা এমন অভিযোগকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন দাবি করেছেন।
সুবিধাভোগী ও স্থানীয়দের অভিযোগ, মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউপি চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহিম এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আব্দুল মমিন, ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মানিক ত্রিপুরা ও ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. মহরম আলীসহ স্থানীয় একটি চক্র সোলার প্যানেল দেয়ার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তিকরণের কথা বলে প্রায় ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গত ২১ মার্চ বাটনাতলী ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড থেকে ৬৪ জন, ২নং ওয়ার্ড থেকে ১৩৯ জন, ৩নং ওয়ার্ড থেকে ১৬৯ জন ও ৭নং ওয়ার্ড থেকে ২৮৩ জন, ৮নং ওয়ার্ড থেকে ২৪৫ জন এবং ৯নং ওয়ার্ড থেকে ৫৪ জনসহ সর্বমোট ৯৫৪ জনের প্রস্তুতকৃত নামের তালিকানুযায়ী সোলার প্যানেল বিতরণী কার্যক্রমের উদ্বোধন করতে মানিকছড়ি উপজেলার ছুদুরখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে আসেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা ও ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল আলম চৌধুরী।
তাৎক্ষণিক টাকার বিনিময়ে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি জানতে পারেন এবং তাদের নির্ভরযোগ্য সূত্রের দেয়া তথ্যমতে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় সেদিন সোলার প্যানেল বিতরণ কার্যক্রম স্থগিত করে চলে যান। সেই সাথে উপকারভোগীদের কাছ থেকে নেয়া টাকা ফেরত দিয়ে নতুন করে নামের তালিকা প্রস্তুতের নির্দেশনা দেন। কিন্তু এ নির্দেশনা অমান্য করে প্রস্তাবিত তালিকার অনুকূলে স্বামীর পরিবর্তে স্ত্রীর, বোনের পরিবর্তে ভাই ও ভাইয়ের পরিবর্তে বোনের নাম অন্তর্ভুক্ত করে নতুন তালিকা করছেন এমন অভিযোগ উঠেছে। আর এ ক্ষেত্রে পুনরায় তাদের কাছ থেকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা নেয়ার খবরে স্থানীয়ভাবে বিষয়টি সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
বর্তমানে সোলার প্যানেলগুলো ছুদুরখীল সরকারি বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে তালাবন্দি অবস্থায় রয়েছে। যা পাহারা দিতে দুজন গ্রাম পুলিশ নিযুক্ত করেছেন সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারগণ।
সরেজমিনে গেলে এই প্রতিতবেদকে ৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আমির আলী জানান, উন্নয়ন বোর্ডের বরাদ্দকৃত বিনামূল্যের সোলার পেতে তিনিও স্থানীয় ইউপি সদস্য মানিক ত্রিপুরাকে ৩ হাজার টাকা দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সোলার পাননি। তাছাড়া সোলার বিতরণের জন্য প্রস্তুতকৃত তালিকার সকলেই ৩-৬ হাজার টাকা দিয়েছেন মর্মে বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি।
বারামপাড়া এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান আহম্মদ (মন্তাজ) বলেন, আমার মেয়ের জন্য একটি সোলার চেয়েছিলাম কিন্তু টাকা দিতে পারিনি বলে নাম তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
কথা হয় ছুদুরখীল বাজারের দোকানি পাইতু মারমার সাথে। টাকা দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করতে প্রথমে অপরাগতা জানালেও পরে ২ হাজার ৫০০ টাকা দিয়েছেন বলে তিনিও স্বীকার করেছেন। তাৎক্ষণিক উপস্থিত তানিমং মারমার ছেলে অংথোইপ্রু মারমা জানান, তার বাবাও (তানিমং মারমা) ২ হাজার ৫০০ টাকা দিয়েছেন। একইভাবে পাশের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. মমিন ও ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মহরম আলীর নিকট সোলার পেতে প্রস্তুতকৃত তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য ৩-৬ হাজার টাকা তাদের হাতে আবার কেউ তাদের চক্রের সদস্যদের হাতে জমা দিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ইউপি সদস্য ও স্থানীয় নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ উপকারভোগীদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এবং বিভিন্ন সময়ে টাকা নেয়ার ব্যাপারটি নিয়ে স্থানীয় দোকানপাটে সমালোচনা চলছে বলেও জানান তারা!
তবে টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্য মো. মমিন ও মানিক ত্রিপুরা। তারা বলেন, আমরা তালিকা প্রস্তুত করে ইউনিয়ন পরিষদে জমা দিয়েছি। সে অনুযায়ী গত ২১ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা সোলার প্যানেল বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করতে এসেছিলেন কিন্তু বৈরি আবহাওয়ার কারণে সেদিন বিতরণ করা হয়নি। টাকার বিনিময়ে নাম তালিকার অন্তর্ভুক্তি করার বিষয়টি সত্য নয় বলেও জানান তারা।
অর্থের বিনিময়ে সোলার প্যানেল বিতরণে নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে ২নং বাটনাতলী ইউপি চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহিম জানান, সোলার প্যানেল দেয়ার কথা বলে টাকা আদায় করা কথা আমি জানি না। তবে সেদিন বৃষ্টি থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা সোলার বিতরণী কার্যক্রমের উদ্বোধন করতে পারেননি। তবে খুব শীগ্রই সোলার প্যানেল বিতরণ করা হবে বলে জানান তিনি।
মানিকছড়ি উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. আতিউল ইসলাম জানান, টাকার বিনিময়ে সোলার প্যানেল বিতরণী তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়ে জানতে পেরে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেযারম্যান কার্যালয়ে অভিযুক্ত ইউপি সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে বিষয়টি তারা স্বীকার করেছেন। পরে উপকারভোগীদের দেয়া অর্থ ফেরতের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত উপকারভোগীদের টাকা ফেরত তো দূরের কথা পুনরায় আরো ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে বলে জানতে পেরেছি। যা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল আলম চৌধুরীকে অবহিত করা হয়েছে। দুর্গম জনপদে সৌরবিদ্যুতের আলোয়ে আলোকিত করতে সরকারিভাবে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অথচ অসহায় খেটে খাওয়া মানুষজনকে বোকা বানিয়ে তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। যা খুবই অমানবিক।
মানিকছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, অর্থের বিনিময়ে সোলার প্যানেল বিতরণী তালিকাতে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এমন গুঞ্জন শুনেছি। কিন্তু এ বিষয়ে লিখিত কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। তাছাড়া সোলার প্যানেল বিতরণী কার্যক্রমের সাথে সরাসরি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সমন্বয়ে হয়েছে। তারা কেউ উপজেলা পরিষদকে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত করেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল আলম চৌধুরীর সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বিষয়টি সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ’র সাথে যোগাযোগ করতে বলেন । কিন্তু মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করতে চাইলেও তিনি ফোন ধরেননি তিনি।