মানিকছড়ির পশ্চাৎপদ জনপদে থাকা সুবিধাবঞ্চিত সাঁওতাল জনগোষ্ঠিরা ভালো নেই!

fec-image

সাঁওতাল নেতা নকুন্দ সাঁওতাল ১৯৫০ সালের আগে কোন এক সময় স্ত্রী ও প্রথম সন্তান গণেশ সাঁওতাল ও ভাইদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পশ্চাৎপদ জনপদ মানিকছড়ির দাইজ্জাপাড়ায় বসতি গড়ে তোলেন। ১৯৭৪ সালে স্ত্রী ও ৩ পুত্র সন্তান রেখে মারা যান নকুন্দ সাঁওতাল। তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরসুরীসহ আজ এই জনপদে বসতি রয়েছে ৮পরিবারে শিশু, কিশোর ও বয়োবৃদ্ধ ৪০-৪২ জন সাঁওতাল জনগোষ্ঠি।

কালের আবর্তে বিশ্ব তথা দেশে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সবকিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন হলেও মৌলিক সুবিধার কিছুই পায়নি এখানকার সাঁওতালরা! এই প্রথম সাঁওতাল পরিবারের ৫/৬ জন শিশু আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিকে ভর্তি হওয়ার সুভাগ্য হয়েছে! এছাড়া সরকারি কোন সুযোগ-সুবিধা এখানে আদৌ পৌঁছায়নি!

সরজমিনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ফ্রেন্ডস জোন এর উপদেষ্টা মো. মাঈন উদ্দীন ও পাড়াপ্রধান( কার্বারী) অংথুইপ্রূ মারমার উপস্থিতিতে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের সাথে সম্প্রতি (২৪ সেপ্টেম্বর) কথা হয় প্রয়াত নকুন্দ সাঁওতালের মেঝ ছেলে ভূটো সাঁওতাল এর সাথে। তিনি জানান, পিতা নকুন্দ সাঁওতাল ভাই প্রয়াত(২০১৪) গণেশ সাঁওতালকে কোলে নিয়ে এখানে এসেছেন। আমার (ভূটো) জন্ম পশ্চাৎপদ এই জঙ্গলে, যাতে এখনো মঙ্গলের দেখা মেলেনি! বয়সের ভাড়ে নূজ্য হতে বেশি বাকি নেই। শুধু দেখা হলো না, কপালে জুটলো না সুখ নামক অচিন পাখির! এভাবে মনের আবেগ, অনুভূতি জানাতে গিয়ে তাঁর চোখের কোণে অশ্রুজমে যায়!

পরে পরিবারের অন্য সদস্যরাও জানালেন তাঁদের দুঃখগাঁথা জীবনের যৎসামান্য গল্প। যা শরীর শিহরে উঠার মতো। মানিকছড়ি-লক্ষ্মীছড়ির সীমান্তবর্তী কালাপানি খালের উত্তর-পশ্চিমপাড় মানিকছড়ি উপজেলার দাইজ্জাপাড়া গ্রামটিতে স্বাধীনতার ৫০ বছর আর সাঁওতাল বসতির প্রায় ৭০/৭২ বছর পরও অনুন্নত এলাকাটি আসলেই পশ্চাৎপদ জনপদ! ১০/১২একর নিজস্ব টিলা ভূমির পরতে পরতে মাটির দেয়াল ও ছনের তৈরি ছোট ছোট ঘরে মাটিতেই তাঁদের থাকা-খাওয়া, শোয়া ! নদীরপাড়ের কূয়ার পানিতে তৃষ্ণা, ছড়া পানিতে গাও-গোসল! বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে সব সারতে হয়।

যদিও ৫/৬ বছর আগে সংবাদকর্মীদের সহযোগিতায় প্রশাসন একটি টিউবওয়েল দিলেও সেটি অকালে নষ্ট হওয়ায় আর ঠিক করার সাধ্য জোটেনি তাদের! রাস্তা-ঘাট ঠিক না থাকা এই সাঁওতালপাড়ায় কোন মেকার, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী অবাধে যাতায়াতেরও সাধ্য নেই। মূল দাইজ্জাপাড়া থেকে একটি মাটির রাস্তা করা হলেও জমির মাঝখানে একটি ব্রিজ না হওয়ায় চলাচল বিচ্ছিন্ন রয়েছে! সেটি হলেও অন্তত পায়ে হেঁটে যাওয়া-আসাও সচল হতো।

উপজেলা থেকে প্রায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার এবং মানিকছড়ি-লক্ষ্মীছড়ির পাকা সড়ক রাঙ্গাপানি বা আদর্শপাড়া থেকে আরও ৪কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বের এই অনগ্রসর এলাকায় যাওয়া সত্যিই দুঃস্কর! ওই সাঁওতাল পাড়ার ২কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে মংশীকার্বারী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থান। তাও আবার সাঁওতালপাড়া থেকে কোন রাস্তা নেই। বন-জঙ্গল সরিয়ে যেতে হয়। ২০১৯ সাল থেকে সাঁওতালদের ৫/৬জন শিশু সবেমাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু! এটাই যেন তাঁদের জন্য প্রাপ্তি সরকারি সুবিধা।

ছোট্ট শিশু নিলা সাঁওতাল (৬) ও ইমন সাঁওতাল(৮)কে কোন ক্লাসে পড় জিজ্ঞেস করলেও তারা বলতে পারছিল না। অ,আ,ক,খ, এখনো ঠিকমতো চিনা-জানা হয়নি।

এছাড়া কিশোরী ও মায়েরা ৪কিলোমিটার হেঁটে কমিউনিটি ক্লিনিকে এসেও চিকিৎসা বা পরিবার-পরিকল্পনা সুবিধা গ্রহণ করেনা!  স্কুল পড়ুয়া ৫/৬ শিশুর কেউই এখনো প্রতিষেধক টিকা নেয়নি! সরজমিনে আরো দেখা গেল ১৫/১৬ বছরের কিশোরীর কোলে ২ সন্তান!

বিধবা বা বয়স্কভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফসহ কোন সরকারি সহযোগিতা কিংবা বৈশ্বিক মহামারীর দূর্যোগেও সরকারি সুবিধা ভাগ্যে জোটেনি!

এ প্রসঙ্গে রাঙ্গাপানির স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ফ্রেন্ডস জোন এর উপদেষ্টা মো. মাঈন উদ্দীন ও পাড়াপ্রধান( কার্বারী) অংথুইপ্রূ মারমা পিছিয়েপড়া সাঁওতাল জনগোষ্ঠির দূর্বিসহ জীবনমানের বিষয়টি স্বীকার করে তাঁরা বললেন, আসলে এখানে সাঁওতাল জাতির বসবাসের বিষয়টি অনেকেরই জানা নেই! গত ১০/১৫ বছর ধরে স্থানীয় নির্বাচন এলে মেম্বার প্রার্থীরা কেউ কেউ ভোট চাইতে এলেও নির্বাচনের পর সবাই এদের (সাঁওতাল) ভুলে যায়! ফলে অবহেলা, অনাদর ও অমানবিক পরিবেশে দূর্বিসহ জীবন কাটাচ্ছে এখানকার সাঁওতালরা। যা এই আধুনিক যুগে কাউকে বলে বিশ্বাস করানো সত্যিই কঠিন। তাই সাঁওতাল জনগোষ্ঠির প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগেই তাঁদের পাশে আমাদের দাঁড়ানো উচিৎ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন