মায়ানমারের সাথে করিডোরের আড়ালে কি লুকিয়ে আছে অন্য খেলা?


মাত্র তিন দিন আগেই জানা গেল, বাংলাদেশ করিডোর সুবিধা দিতে সম্মত হয়েছে। তার উপর আজই ঘটা করে ডঃ ইউনুস বললেন, যুদ্ধের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে শক্তিশালীভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে, সেই প্রস্তুতি নেওয়াও হবে।
এই ‘প্রস্তুতি’ শব্দটাই বেশ আশঙ্কা তৈরি করার মতো। প্রস্তুতি মানে কি শুধুই নিজেদের গুছিয়ে নেওয়া? নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে সেই পুরনো খেলা – অস্ত্র কেনা, আর তারপর…?
আমরা হয়তো মাঝে মাঝে খুব সরলভাবে পৃথিবীকে দেখি। ভাবি, মানবিকতার ডাকে সাড়া দেওয়াটাই তো আসল। কিন্তু পৃথিবীটা কি আসলেই এত সরল? ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে।
২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের কথা মনে আছে? তার ঠিক আগে, ২০০২ সালে সৌদি আরব বিপুল পরিমাণ মার্কিন অস্ত্র কিনেছিল – প্যাট্রিয়ট মিসাইল, অত্যাধুনিক এফ-১৫ যুদ্ধবিমান, এম১ আব্রাহামস ট্যাংক। পরের বছর, ২০০৩ এর মার্চে, আমেরিকা সেই সৌদি আরবেরই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করে ইরাকে আক্রমণ চালালো।
ভাবুন একবার, যে অস্ত্র সৌদি আরব নিজেদের নিরাপত্তার জন্য কিনেছিল, সেই অস্ত্রই ব্যবহৃত হলো আমেরিকার ইরাক অভিযানে, তাদেরই মাটি থেকে! সেই যে মার্কিন সেনারা ঘাঁটি গাড়লো, তা আজও তারা ছাড়েনি। প্রিন্স সুলতান বিমান ঘাঁটি এখনো মার্কিন নিয়ন্ত্রণে, আইএস দমনের নামে। একই ঘটনা তো নব্বইয়ের দশকে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময়েও ঘটেছিল।
এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। আফগানিস্তান, সিরিয়া – বহু জায়গায় দেখা গেছে, বড় শক্তিগুলো স্থানীয় বা রুশ ব্লকের অস্ত্র ব্যবহার করেছে, নিজেদের কৌশলগত সুবিধা মতো।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, মানবিক সহায়তার জন্য দেওয়া একটা করিডোর কি আসলেই কেবল ত্রাণ পৌঁছানোর পথ হয়েই থাকবে? নাকি তা ধীরে ধীরে অন্য কিছুর প্রবেশদ্বার হয়ে উঠবে?
ভূরাজনীতির তাত্ত্বিকরা এই বিষয়টিকে দেখেন ভিন্ন চোখে। তাদের মতে, করিডোর, বন্দর বা যেকোনো কৌশলগত পথ আসলে কেবল ইট-পাথরের কাঠামো নয়, এগুলো ক্ষমতার দাবার গুটি।
একটি নিরীহ চেহারার করিডোর খুলে দেওয়ার ঘটনাকে দেখা যেতে পারে ট্রোজান হর্স স্ট্র্যাটেজি হিসেবে। প্রাচীন গ্রিক উপকথার মতো, যেখানে বিশাল এক কাঠের ঘোড়ার পেটে লুকিয়ে শত্রু সৈন্যরা নগরে প্রবেশ করেছিল, তেমনি মানবিকতার মোড়কে একটি করিডোর দিয়েও ধীরে ধীরে সামরিক বা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের পথ খুলে যেতে পারে।
তাত্ত্বিক স্টিফেন গ্রাহাম তার ‘সিটিজ আন্ডার সিজ’ বইতে দেখিয়েছেন, কীভাবে শহুরে যুদ্ধ বা দখলদারিত্ব কেবল অস্ত্রের জোরে হয় না, বরং ত্রাণ বিতরণ বা অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণের মতো আপাত নিরীহ কাজের মাধ্যমেও লজিস্টিক্যাল অকুপেশন বা সরবরাহ ব্যবস্থার দখল কায়েম করা হয়।
অর্থাৎ, করিডোর এখানে কেবল পথ নয়, এটা এক ধরনের অবকাঠামোগত উপনিবেশায়ন (Infrastructural Colonization) এর সূচনা হতে পারে। ডেবোরা কোয়েন তার ‘দ্য ডেডলি লাইফ অফ লজিস্টিকস’ বইতে আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, আধুনিক যুগের সামরিক নিয়ন্ত্রণ কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা ছড়িয়ে পড়ে সাপ্লাই চেইন, করিডোর আর বিভিন্ন অবকাঠামোর শিরা-উপশিরায়।
করিডোর খুলে দেওয়া মানে শুধু কিছু ট্রাক বা জাহাজকে পথ করে দেওয়া নয়, এটা আসলে পুরো একটা সরবরাহ ব্যবস্থা আর তার পেছনের ভূরাজনৈতিক শক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো।
এই যে সৌদি আরবের উদাহরণ আমরা দেখলাম, যেখানে অস্ত্র কিনে প্রকারান্তরে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতিকে আরও পোক্ত করা হলো, এটা আমাদের নির্ভরতাবাদ তত্ত্বের (Dependency Theory) কথা মনে করিয়ে দেয়।
আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক, সামির আমিন বা ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইনের মতো তাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলো আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হলেও অর্থনৈতিক এবং বিশেষ করে সামরিক দিক থেকে তারা উন্নত বা কেন্দ্রীয় (Core) শক্তিগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
অস্ত্র কেনা, সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে দেওয়া, এমনকি করিডোর সুবিধা দেওয়া – এই সবকিছুই সেই নির্ভরতার জালকে আরও জটিল ও গভীর করে তোলে। সামির আমিন তো বলেইছিলেন, প্রান্তিক দেশগুলো কেবল কাঁচামাল বিক্রি করে না, তারা বিক্রি করে ‘কৌশলগত প্রবেশাধিকার’ (Strategic Access)।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যখন বৃহৎ শক্তির কৌশলগত স্বার্থ পূরণের জন্য নিজেদের ব্যবহৃত হতে দেয়, তখন রুই মাউরো মারিনির তত্ত্ব অনুযায়ী তাদের উপ-সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র (Subimperialist State) হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
ডঃ ইউনুসের ‘প্রস্তুতি’ নেওয়ার আহ্বানকে এই তত্ত্বে ফেললে মনে হতে পারে, বাংলাদেশকে হয়তো একটি কৌশলগত ক্লায়েন্ট বা সহযোগী হিসেবে তৈরি করার প্রক্রিয়া চলছে।
শুধু তাই নয়, ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেন তার ‘স্টেট অফ এক্সেপশন’ (State of Exception) এর ধারণায় দেখিয়েছেন, আধুনিক রাষ্ট্রগুলো কীভাবে ‘জরুরি অবস্থা’ – যেমন যুদ্ধ, মানবিক সংকট – ইত্যাদিকে ব্যবহার করে আইনের স্বাভাবিক শাসনের বাইরে গিয়ে কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করে।
একটি সংকটময় মুহূর্তে ‘মানবিক’ কারণে করিডোর দেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং একইসাথে ‘শক্তিশালী প্রস্তুতি’র ডাক – এই দুটো মিলে এমন একটি পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে যেখানে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক সার্বভৌমত্ব ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসে এবং একটি স্থায়ী ‘ব্যতিক্রমী অবস্থা’ তৈরি হয়, যেখানে বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপের সুযোগ বাড়ে।
এই বিষয়টিকে কোপেনহেগেন স্কুলের তাত্ত্বিক ব্যারি বুজান ও ওলে ওয়েভার সিকিউরিটাইজেশন তত্ত্ব (Securitization Theory) দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। তাদের মতে, যখন কোনো সাধারণ বিষয়কে (যেমন ত্রাণ বা অভিবাসন) ‘জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি’ বা ‘জরুরি অবস্থা’ হিসেবে সফলভাবে উপস্থাপন করা যায়, তখন সেটিকে মোকাবেলা করার জন্য স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়ে যায়।
মানবিক করিডোর’ প্রথমে সহানুভূতির বিষয় হিসেবে আসলেও, একে ঘিরে যখন ‘নিরাপত্তা’ আর ‘প্রস্তুতি’র বয়ান তৈরি হয়, তখন তা সহজেই সামরিক বা কৌশলগত গুরুত্ব পেয়ে যায় এবং এর উপর প্রশ্ন তোলা কঠিন হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, বাস্তববাদী (Realist) তাত্ত্বিকরা, যেমন হান্স মরগেনথাউ বা কেনেথ ওয়াল্টজ, মনে করিয়ে দেন যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল চালিকাশক্তি হলো ক্ষমতা এবং জাতীয় স্বার্থ। প্রতিটি রাষ্ট্রই তার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, যা তৈরি করে নিরাপত্তা দোটানা বা সিকিউরিটি ডিলেমা।
বাংলাদেশ যখন একটি শক্তিকে করিডোর ব্যবহারের সুবিধা দেয়, তখন তা প্রতিবেশীদের বা অন্যান্য শক্তিদের মনে সন্দেহের জন্ম দিতে পারে, যা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। জন মেয়ারশাইমারের আক্রমণাত্মক বাস্তববাদ (Offensive Realism) তত্ত্ব অনুযায়ী, বৃহৎ শক্তিগুলো সবসময়ই চায় নিজেদের প্রভাব বলয় বাড়াতে।
একবার করিডোর বা ঘাঁটির সুবিধা পেলে তারা সেই সুযোগকে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের কাজেই লাগাবে, এটাই তাদের স্বভাব। এমনকি হেজেমনিক স্টেবিলিটি থিওরি অনুযায়ী, যদিও একটি প্রভাবশালী শক্তি (Hegemon) বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু সেই স্থিতিশীলতা আসে তার নিজস্ব শর্তে এবং স্বার্থে।
মানবিক করিডোর সেই স্বার্থ পূরণের একটি মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।
এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর জৈবরাজনীতির (Biopolitics) ধারণা দিয়েও বোঝা যায়। ফুকো দেখিয়েছেন, আধুনিক ক্ষমতা কেবল দমন-পীড়নের মাধ্যমে কাজ করে না, বরং তা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার সূক্ষ্ম পদ্ধতির মাধ্যমেও কাজ করে – যেমন খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, চলাচল (করিডোর), ইত্যাদির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা।
মানবিক করিডোর দিয়ে যখন ত্রাণ বা মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন তা আসলে একটি জনগোষ্ঠীর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেয় বহিরাগত শক্তিকে। এটি আপাতদৃষ্টিতে মানবিক মনে হলেও, এর গভীরে লুকিয়ে থাকে নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি। ম্যারি ক্যালডর তার ‘নিউ ওয়ারস’ তত্ত্বে দেখিয়েছেন, কীভাবে অনেক আধুনিক যুদ্ধ বা হস্তক্ষেপ শুরু হয় ‘মানবিক কারণ’ দেখিয়ে।
একে তিনি এক ধরণের ‘ছদ্ম-মানবিকতাবাদ’ (Pseudo-humanitarianism) বলেছেন, যেখানে আসল উদ্দেশ্য থাকে ভূরাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করা, কিন্তু সামনে রাখা হয় মানুষের দুঃখ-কষ্টের ছবি। লিবিয়ায় ‘নো-ফ্লাই জোন’ প্রতিষ্ঠার ঘটনা এর একটি উদাহরণ।
ইতিহাস আর এই তত্ত্বগুলো আমাদের সাবধান করে দেয়। একবার শুধু জাতিসংঘ, ইইউ বা মার্কিনীদের ত্রাণ সহায়তার নামে করিডোরে পা রাখতে দিলে কী হতে পারে, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এখনই।
সৌদি আরব, ইরাক, আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। মানবিকতার ডাক নিঃসন্দেহে মহৎ, কিন্তু সেই ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ যেন অন্যের হাতে তুলে না দিই, সেই সতর্কতাটুকু জরুরি। ডঃ ইউনুসের ‘প্রস্তুতি’ নেওয়ার আহ্বান যদি কেবল নিজস্ব প্রতিরক্ষা শক্তি বাড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা এক বিষয়।
কিন্তু যদি তা হয় সেই পুরনো চক্রে প্রবেশের প্রথম ধাপ – অস্ত্র কেনা, তারপর ঘাঁটি ব্যবহার করতে দেওয়া, এবং অবশেষে অন্যের খেলার মাঠে পরিণত হওয়া – তবে তা হবে এক বিরাট ঐতিহাসিক ভুল।
সুতরাং করিডোরের দরজা খোলার আগে হাজারবার ভাবা দরকার, এই পথে কারা আসবে, কী নিয়ে আসবে, আর তারা কি আদৌ ফিরে যাবে? নাকি মায়ার জালে জড়িয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা নিজেরাই বন্দী হয়ে পড়ব? সময় থাকতে সাবধান হওয়াটাই হয়তো সবচেয়ে বড় প্রস্তুতি।
এই পোস্টটি দীর্ঘ হওয়ার জন্য সবার কাছে আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
সূত্র : লেখকের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেয়া। মতামতও সম্পূর্ণ লেখকের।