parbattanews

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের মর্যাদা আর অধিকারের কথা কি শুধুই ‘আবদার’?

ফাইল ছবি

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক আশ্রয়দাতা দেশগুলোতে রোহিঙ্গাদের চাকুরী করার, জমি কেনার বা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে, এমন একটি খবর আমার পরিচিত কয়েকজন সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার সময় বিদ্রূপ করে লিখেছে যে, “এহ, মামার বাড়ির আবদার”। “আবদার” শব্দটি ব্যবহার করে গণমাধ্যমও সংবাদ পরিবেশন করেছে দেখলাম।

সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে আবদার বিষয়ক এই মন্তব্যগুলো যখন পড়ছিলাম তখন আমার হঠাৎ এ বছরের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে স্কটল্যান্ডের গ্ল্যাসগো শহরে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল।

ব্রিটেনের অভিবাসন কর্মকর্তারা যখন দুজন আশ্রয়প্রার্থীকে আটক করে তাদের ভ্যানে করে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন প্রায় দুশো প্রতিবেশী এগিয়ে এসে অভিবাসন কর্মকর্তাদের ওই ভ্যানের চতুর্দিকে ঘিরে ধরে। গাড়ি আর সামনে এগোতে পারে না, প্রতিবেশীরা স্লোগান দিতে থাকে আর বলে, “এরা আমাদের প্রতিবেশী, এদেরকে ছেড়ে দাও”।

দিনব্যাপী ওই প্রতিরোধের মুখে আটক করা ওই শরণার্থীদের ছেড়ে দেয়া হয়।

শরণার্থী চাকুরী পেলে ক্ষতি কী?
মানবাধিকার বলে যে একটা ব্যাপার আছে তা উপলব্ধি করতে পারলে আমাদের সমাজেও এমন ঘটনা ঘটতো। আমাদের সেই উপলব্ধি নেই বলেই স্বদেশে সামরিক জান্তা সরকারের নির্যাতন ও সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা লোকগুলোকে আমরা কী নির্দ্বিধায় সমুদ্রের মাঝে জনবিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপে পাঠিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।

আচ্ছা, কিছু মানুষ আমার-আপনার মতো স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করবে সেটাকে আবদার ভাবা আসলে কতটা যৌক্তিক? বাংলাদেশের মতো দরিদ্র একটা দেশে যেখানে ঘরে ঘরে তরুণ-তরুণী চাকুরী করার অধিকার থাকা সত্ত্বেও বেকার বসে আছে, সেখানে কিছু শরণার্থী চাকুরী করার অধিকার পেলেই কি আর না পেলেই বা কি!

কেউ তো তাদের জন্য চাকুরী নিয়ে বসে নেই। এমন তো নয় যে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক উন্নত দেশে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পেলেই থাকা-খাওয়ার জন্য মোটা অংকের মাসোহারা পাওয়ার লোভে রোহিঙ্গারা এদেশে এসেছে। তারা যে কেবল নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য এদেশে এসেছে তা নিয়ে তো কারোই কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়।

রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন কি সম্ভব?
এই মুহূর্তে রোহিঙ্গারাই সম্ভবত সবচেয়ে নিগৃহীত ও উপেক্ষিত জাতি যাদের নিজেদের দেশে বসবাসের উপায় নেই। আবার বাংলাদেশ তাদের শরণার্থী হিসেবেই স্বীকৃতি দেয় না। ফলে এদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

আমি-আপনি চোখ বন্ধ করলে সহজেই ভাবতে পারি অথবা স্বপ্ন দেখতে পারি যে আগামী কয়েক বছর পরে আমরা নিজেদের কোন অবস্থানে দেখতে চাই অথবা জীবন নিয়ে পরিকল্পনা করতে পারি, কিন্তু রোহিঙ্গাদের সেই অধিকার নাই।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে যে,বাংলাদেশের অগ্রাধিকার হচ্ছে যথাশিঘ্র সম্ভব রোহিঙ্গাদের নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন। এমন বক্তব্য যারা দিয়ে যাচ্ছেন তারা খুব ভালো করেই জানেন যে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে এতটাই নাজুক যে খুব সহসাই রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরার কোনও উপায় নেই।

বাংলাদেশে জন্ম নেয়া শিশুদের কী হবে?
আগামী পাঁচ বছরেও যদি সেদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় তাহলে রোহিঙ্গাদের কী হবে? কতদিন তারা এভাবে কক্সবাজারের আশ্রয় শিবির বা সমুদ্রের মাঝখানে একটা দ্বীপে বন্দী জীবন যাপন করবে? জন্মসূত্রে অথবা একটা নির্দিষ্ট সময় পরে পৃথিবীর অনেক দেশই শিশুদের নাগরিকত্ব দিয়ে দেয়, তাহলে রোহিঙ্গা শিশুদের কী হবে?

বাংলাদেশ এসব প্রশ্ন খুব সহজেই এড়িয়ে যায়। কারন বাংলাদেশ ১৯৫১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হওয়া ‘আন্তর্জাতিক শরণার্থী কনভেনশন’ এবং ১৯৬৭ সালে ‘শরণার্থী প্রটোকলে’ স্বাক্ষর করেনি। রোহিঙ্গা ইস্যুটি যতটা মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিৎ বাংলাদেশ ইস্যুটিকে তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে।

জাতিসংঘের কী করা উচিৎ?
যেহেতু বাংলাদেশ বর্তমানে রোহিঙ্গাদের একরকম বোঝা মনে করছে, তাই রোহিঙ্গাদের প্রতি দেশটির দৃষ্টিভঙ্গিও হতাশাজনক হয়ে উঠেছে। দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বারবার আগুন লাগার ঘটনায় রোহিঙ্গা মরছে, ক্যাম্পে বন্যার পানি উঠে শেল্টার ভেসে গিয়ে রোহিঙ্গা মরছে, দলবদ্ধ সহিংসতায় রোহিঙ্গা মরছে, করোনাভাইরাসের ভয় তো আছেই।

ফলে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, নিজেদের দেশে গণহত্যা থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে, সেই বাংলাদেশও তাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংস্থা রিফিউজি কাউন্সিলের এক জরিপে দেখা গিয়েছে, যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশে আশ্রয়প্রার্থীদের ৬১ শতাংশ গুরুতর মানসিক সমস্যায় ভুগছে। সেখানে বাংলাদেশে কক্সবাজার বা ভাসানচরের মতো জায়গায় এত প্রতিকূলতার মধ্যে বসবাস করতে গিয়ে রোহিঙ্গারা মানসিকভাবে কতটা সুস্থ রয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এই বাস্তবতায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উচিৎ আশ্রয়দাতা দেশগুলোতে রোহিঙ্গাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করার পাশাপাশি তাদের সুরক্ষায় বিকল্প কিছু ভাবা। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে আশা শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। সেসব দেশে রোহিঙ্গাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি হয়ে উঠেছে।

সূত্র: বিবিসি নিউজ

Exit mobile version