parbattanews

মিয়ানমারের যুদ্ধ ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ স্বপ্নকে হত্যা করছে

মিয়ানমারে এখনও কোন করোনাভাইরাস তথা কোভিড-১৯ আক্রান্তের কোন খবর পাওয়া যায়নি। মিয়ানমারের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণে তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা কি হবে, সেটিও এখন প্রশ্ন হয়ে ঝুলে আছে। এ অবস্থায় দেশটির জাতিগত সঙ্ঘাতকে নিত্যদিনের একটা অপ্রধান বিষয় হিসেবে দেখা যেতে পারে।

কিন্তু পশ্চিম মিয়ানমারে যেখানে ভারত আর চীনের কৌশলগত স্বার্থ এক হয়েছে, সেখানে  মিয়ানামার পরিস্থিতিকে তেমন করে দেখাটা হবে মারাত্মক ভুল।

আগামী মাসগুলোকে ভাইরাসের প্রভাব যা-ই হোক না কেন, রাখাইন এবং চিন রাজ্যের আশপাশের এলাকায় যেভাবে সামরিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে, সেটা শুধু মিয়ানমারের রাজনৈতিক ভবিষ্যতই বদলে দেবে না, বরং এই এলাকায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলায় ভারতের যে পরিকল্পনা রয়েছে, সেটাও সম্পূর্ণ বদলে যাবে।

সঙ্কটের তীব্রতাটা পরিস্কার হয়ে গেছে ১০ ও ১১ মার্চের লড়াই থেকে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বা তাতমাদাও এ সময় আরাকান আর্মির (এএ) কাছে তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরাজয়ের শিকার হয়েছে।

১০ মার্চ সকালের দিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ক্র্যাক ৭৭তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশানের (এলআইডি) সেনাদেরকে পালেতওয়া টাউনশিপের কালাদান নদীর পূর্ব তীরের কাছে প্যারাশুটের মাধ্যমে নামিয়ে দেয়া হয়।

নদীর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য বেপরোয়া হয়েই এই পদক্ষেপ নেয় তাতমাদাও, যেহেতু অন্য কোন পদ্ধতি সেখানে কাজ করেনি। এই এলাকাটি আরাকান আর্মির পেছনের ঘাঁটি হিসেবে কাজ করে এবং এখান থেকেই সংলগ্ন রাখাইন রাজ্যে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা হয়।

তাতমাদাও সেনাদের প্যারাশুট ব্যবহারের অভিজ্ঞতা খুবই সীমিত এবং এটা এই ধরনের প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে হয়েছে। কিন্তু পদক্ষেপটা হয়েছে মারাত্মক ভুল। প্যারাশুটে ল্যাণ্ড করার পরপরই অনেক শক্তিশালী আরাকান আর্মি হয় তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, অথবা তারাই মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

পরদিন যখন যুদ্ধ শেষ হয়েছে, তখন ইউনিটের অন্তত ২০ সেনা নিহত হয়েছে এবং ৩৬ জন বন্দী হয়েছে। এদের মধ্যে ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারও রয়েছে, যাকে আরাকান আর্মি লেফটেন্যান্ট কর্নেল থেট নাইং ও নামে চিহ্নিত করেছে।

২০১৫ সালের শুরু থেকে উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় শান রাজ্যে সেনাবাহিনী যত যুদ্ধ করে এসেছে, তারমধ্যে একক কোন যুদ্ধে এটাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হলো তাদের।

সেখানে লড়াইরত কোন সেনা সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসতে পেরেছে কি না, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।

সঙ্ঘাত কবলিত চিন ও রাখাইন রাজ্য থেকে যেহেতু সরাসরি সংবাদ সংগ্রহের কোন উপায় নেই এবং ইন্টারনেটও সেখানে কার্যকরভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে, সে কারণে মিয়ানমার ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া উভয়ের কাছেই এ অঞ্চলের প্রকৃত তথ্য অজানা রয়ে যাচ্ছে।

কালাদান নদীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই যে দীর্ঘ রক্তস্নাত সংগ্রাম শুরু হয়েছে, সেখানে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে।

প্রথমত, তাতমাদাও এ অঞ্চলে ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ সেনা মোতায়েন করেছে। কিন্তু এলাকার জনগণের মধ্যে তাদের কোন সমর্থন না থাকায় এখানে তাদের কোন কৌশলগত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের উপায় নেই।

এই পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করার অন্য কোন উপায়ও নেই, যেখানে এক ব্যাটালিয়ন আকারের ইউনিট সরাসরি শত্রুর ব্যারিকেডের মধ্যে ঝাঁপ দিয়েছে। তাদের বহু সেনা নিহত ও আটক হয়েছে এবং তাদের মধ্যে কমাণ্ডিং অফিসারও রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, নেপিদোর র‍্যাপিড রেসপন্স ফোর্সের একটি ক্র্যাক ইউনিটের বড় একটা অংশ আত্মসমর্পণ করার ঘটনা থেকে বোঝা গেছে যে, বাহিনীর মধ্যে নৈতিক মনোবলের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।

সেনাবাহিনীর মধ্যে যখন এই খবর ছড়িয়ে গেছে, তখন বাহিনী আরও অসহায় হয়ে উঠবে। বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর ওয়েস্টার্ন কমাণ্ডে যে সব স্থানীয়দের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তারা এতে আরও ভীত হবে।

তৃতীয়ত, গোয়েন্দা তথ্যের সীমাবদ্ধতা এবং সেনাদের নৈতিক মনোবলে ঘাটতির কারণে তাতমাদাওকে ভারসাম্য রক্ষার জন্য অন্যান্য সরঞ্জামের উপর বেশি ভরসা করতে হচ্ছে: যেমন হেলিকপ্টার গানশিপ, নতুন রাশিয়ান গ্রাউন্ড-অ্যাটাক বিমান ও যেখানে সম্ভব, সেখানে কামান ব্যবহার করা হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি যেটি নজর কেড়েছে, সেটি হলো দূরপাল্লার ট্রাক-মাউণ্টেড মাল্টিপল রকেট লঞ্চ সিস্টেমস (এমআরএলএস) মোতায়েন।

এগুলোর কোনটাই নয়াদিল্লীর জন্য ভালো খবর নয়। পালেতওয়ার জন্য লড়াইয়ের কারণে কালাদান মাল্টি-মডেল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের (কেএমএমটিটিপি) কাজ বন্ধ হয়ে গেছে, যেটা ভারতের পূর্বমুখী অর্থনৈতিক সংযোগের জন্য এবং চীনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

২০০৮ সালে এই প্রকল্পটির ধারণা গ্রহণ করা হয়। এর অধীনে ভারতের স্থলবেষ্টিত মিজোরাম রাজ্যকে কালাদানের উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরের সাথে যুক্ত করার কথা।

ভারতে এর আগে যে ‘লুক ইস্ট’ নীতি ছিল, তার অধীনে এ প্রকল্পের কিছু অগ্রগতি হয়। ১৯৯১ সালে কংগ্রেস দলীয় সরকার এই নীতি গ্রহণ করেছিল। পরে নরেন্দ্র মোদির প্রশাসন এটাকে আরও জোরালো করে ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি গ্রহণ করে।

এই পরিকল্পনা অনুসারে ভারতের অর্থায়নে সিত্তুইয়ে গভীর সমুদ্র বন্দর এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট পালেতওয়া শহরে কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।

সমস্যা হলো, এর মাঝে যেগুলো রয়েছে, সেগুলো। পালেতওয়া শহরের দক্ষিণের জোরিনপুরি সীমান্ত থেকে রোড লিঙ্ক নির্মাণের কাজ এখনও চলছে। এটাকে কেন্দ্র করে অনেক প্রতিকূলতা রয়েছে, সেখানে সরঞ্জাম পরিবহনে বাধাগ্রস্ত হতে হচ্ছে। তাছাড়া আরাকান আর্মি সেখানে কর আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে আরাকান আর্মির প্রধান তুন মিয়াত নাইং এ ঘোষণা দেন।

অ্যাক্ট ইস্ট পরিকল্পনার যে উত্তরাংশ – সেখানে মিয়ানমারের সীমান্ত থেকে ভারতের মনিপুর থেকে মান্ডালি এবং থাইল্যাণ্ড পর্যন্ত সড়ক লিঙ্ক স্থাপনের কথা। কিন্তু ভারত ও মিয়ানমার সরকার – দু’তরফেই এই প্রকল্পের ব্যাপারে মনোযোগের অভাব রয়েছে।

পূর্ব চীন যখন সীমান্তবর্তী বাণিজ্য কেন্দ্র মিউজ থেকে মাণ্ডালি পর্যন্ত ৪৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ রেল সংযোগ স্থাপনের কাজ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেখানে গৃহযুদ্ধ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ভারতের বহুল কাঙ্ক্ষিক ভূ-কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি থমকে গেছে।

Exit mobile version