মিয়ানমারে আরেক দফা গণহত্যার মুখে পড়তে পারে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা

fec-image

বাংলাদেশে অবস্থানরত এক মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে আসার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে দেশটির সরকার। বহির্বিশ্বের কাছে নিজেদেরকে শান্তিকামী ও সমঝোতার প্রচেষ্টারত ইমেজ তুলে ধরার জন্যই এটা শুরু করেছে তারা। তবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এখন যে অবস্থা – যেটা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির, সেখান থেকে মিয়ানমারে ফিরলে তাদের পরিণতি হবে আরও খারাপ।

এতে তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে মুসলিম সংখ্যালঘু এই রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠির কেউই মিয়ানমারের প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছে না। গত নভেম্বরে মিয়ানমারের প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা একবার ব্যর্থ হওয়ার পর এটা তাদের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। বাংলাদেশের সরকার প্রত্যাবাসনকে সমর্থন করে এবং এখন তারা রোহিঙ্গাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলছে। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ সরকার শরণার্থী ক্যাম্পে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিয়েছে, যে সিদ্ধান্তের নিন্দা করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো, কারণ এতে করে সেখানে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।

সম্ভাব্য রোগের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশের সরকার জনাকীর্ণ এই ক্যাম্পগুলো বন্ধ করে দিতে চায়। কিন্তু রোহিঙ্গারা যদি বাংলাদেশ ছেড়ে যায় এবং মূল জণগোষ্ঠির সাথে না মিশে, কেবল তখনও সেটা সম্ভব। সরকার বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের বাজারের উপর শরণার্থীদের প্রভাবের ভয় করছে এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা করছে।

মিয়ানমার সীমান্ত লাগোয়া কক্সবাজার জেলায় বিশাল শরণার্থী ক্যাম্প ঘিরে এখন উত্তেজনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি গ্রুপ স্থানীয় এক বাংলাদেশী রাজনীতিবিদকে হত্যা করেছে অভিযোগ উঠেছে। জবাবে বাংলাদেশ পুলিশ চার রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে যে, পুলিশের দাবি এই রোহিঙ্গারা ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যার ক্ষেত্রে সাধারণত এই ভাষা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের ব্যবহৃত একটি দোকানে উত্তেজিত জনতার হামলা হয়েছে। অন্যদিকে বিশিষ্ট বাংলাদেশীরা সমস্ত ক্যাম্পগুলোকে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেয়ার প্রচারণায় নেমেছেন। চলতি মাসের শুরুর দিকে ব্যাপক বন্যা হয়েছে। ত্রাণ সংস্থাগুলো এ সময় ক্যাম্পে তাদের সবচেয়ে বৃহৎ জরুরি সহায়তা দিয়েছে।

তবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্ভোগের খবরের আড়ালে এই সত্যটা চাপা পড়ে গেছে যে মিয়ানমারের পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। এই পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, আরও বর্বরতা সেখানে ঘটতে পারে।

জাতিসংঘের তদন্তকারীরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর জন্য মিয়ানমারের জেনারেলদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার আহ্বান জানিয়েছেন। ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তাদের উপর। মিয়ানমারের সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য পদক্ষেপের ব্যাপারে প্রাক-তদন্ত শুরু করেছে হেগের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট।

মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংঘি লি বলেছেন, “সহিংসতা ও নির্যাতনের সিস্টেম নষ্ট করার জন্য মিয়ানমারের সরকার কিছুই করেনি এবং রাখাইনে যে সব রোহিঙ্গারা এখনও রয়ে গেছে, তারা এখনও সেই অনিশ্চয়তার মধ্যেই বাস করছে, যেমনটা ২০১৭ সালের আগস্টের সময় তারা ছিল”। তথ্য অনুসন্ধানী মিশনের প্রধান মারজুকি দারুসমান তার পর্যবেক্ষণে আরও কড়া ভাষা যোগ করেছেন: “গণহত্যা বন্ধে মিয়ানমার তাদের বাধ্যবাধকতা পূরণে ব্যার্থ হচ্ছে, গণহত্যা প্রতিরোধে কার্যকর আইন প্রণয়ন ও অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার ব্যাপারেও তারা ব্যার্থ হচ্ছে”।

রাখাইনে আরেকটি গণহত্যা সঙ্ঘটিত হওয়ার বহু কারণ রয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রাজ্যে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নতুন করে আক্রমণাত্মক অভিযান শুরু করেছে। যদিও মূলত বৌদ্ধ গেরিলা গ্রুপ আরাকান আর্মি তাদের প্রধান টার্গেট, কিন্তু রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধেও বর্বরতা চালাচ্ছে তারা।

তাছাড়া, সশস্ত্র বাহিনী আগের সহিংসতায় দোষি খুব সামান্য ব্যক্তিদেরই শাস্তি দিয়েছে। এর মাধ্যমে যে বার্তা দেয়া হয়েছে, সেটা হলো রাখাইনে রোহিঙ্গা ও অন্যদের উপর হামলা করা, তাদের ধর্ষণ ও হত্যার বিষয়টি সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মেনে নেয়া হয়েছে। এদিকে, জাতিগত নির্মূলের প্রচারণাও অব্যাহতভাবে চলছে। কর্তৃপক্ষ এমন বহু জায়গা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, যেখানে রোহিঙ্গারা থাকতো। সে সব জায়গায় সরকার হয় বাণিজ্যিক অবকাঠামো নির্মাণ করবে, না হয় বৌদ্ধদের বসতি নির্মাণ করা হবে। মিয়ানমার সরকার অব্যাহতভাবে রোহিঙ্গাদের বৈধ আইনি সুরক্ষা দিতে অস্বীকার করে যাচ্ছে, যেটার মাধ্যমে প্রকৃত নাগরিকত্ব পেতে পারে তারা।

সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমারে, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন