মিয়ানমারে যুদ্ধের ফাঁদে পড়ে গেছে তাতমাদাও ও আরাকান আর্মি

fec-image

যখন একটা প্রতিষ্ঠিত শক্তি উদীয়মান কোন শক্তির সামনে হুমকি অনুভব করে, তখন যুদ্ধ সেখানে অবশ্যম্ভাবী। এই বিষয়টিকে বলা হয়ে থাকে ‘থুসিডাইডস’ ট্র্যাপ’। হার্ভার্ডের অধ্যাপক গ্রাহাম অ্যালিসন ২০১২ সালে এই পরিভাষা তৈরি করেন। প্রাচীন গ্রিসে স্পার্টা আর এথেন্সের মধ্যে যুদ্ধের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি এই পরিভাষা ব্যবহার করেন, যে যুদ্ধের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন ইতিহাসবিদ থুসিডাইডস। তিনি দেখেছিলেন যে, এথেনিয়ানদের শক্তি বৃদ্ধির কারণে সেটা স্পার্টানদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তিনি এই উপসংহারে আসেন যে, এথেন্সের শক্তি বৃদ্ধি এবং সেটার কারণে স্পার্টার মধ্যে যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল, তার কারণেই যুদ্ধটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল।

তাতমাদাও (মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী) আর আরাকান আর্মিও এখন একই ফাঁদে পড়ে গেছে। যে কারণে তাতমাদাও আর আরাকান আর্মির লড়াইকে থুসিডাইডসের ফাঁদের সাথে তুলনা করা যায়, সেগুলো এ রকম:

আধিপত্য শক্তি: তাতমাদাও

তাতমাদাও মিয়ানমারের সবগুলো সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় শুধু নয়, বরং স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের সবচেয়ে কর্তৃত্বশীল শক্তিও তারাই।

দেশের বিভিন্ন গেরিলা গোষ্ঠির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে তারা। এর মধ্যে প্রাচীনতম হলো কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন, আর এই মুহূর্তে তারা লড়ছে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে। বিভিন্ন গ্রুপের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করেছে, অস্ত্রবিরতি করেছে, অনেককে পুরোপুরি মুছে দিয়েছি এবং অনেকের সাথে সমন্বয় করেছে। এদের মধ্যে কমিউনিস্ট বিদ্রোহী থেকে শুরু করে রয়েছে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স অর্গানাইজেশান/আর্মি (কেআইও/এ) বর্ডার গার্ড ফোর্সেস (যেমন, নিউ ডেমোক্র্যাটিক আর্মি-কাচিন) থেকে নিয়ে গেরিলা গ্রুপগুলো (যেমন কাউংখা-ভিত্তিক মাহতু নাউয়ের নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া গ্রুপ)।

সবচেয়ে আধিপত্যশালী শক্তি হিসেবে তাতমাদাও বাইরের ও ভেতরের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখেছে। দীর্ঘদিন তারা স্বাধীনভাব ও স্বায়ত্বশাসিতভাবে বিশ্বের দরবারে সক্রিয় ছিল। আসলে, বহু দশক ধরে বিশ্বের দরবারে মিয়ানমারের জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীকই ছিল তাতমাদাও।

উদীয়মান শক্তি: আরাকান আর্মি

আরাকান আর্মির জন্ম হয় ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল, লাইজাতে, কেআইএর সদরদপ্তরে। শুরুতে আরাকান আর্মি ছিল ২৬ জন যুবকের একটি দল, যাদের নেতৃত্বে ছিল তুন মিয়াত নাইং। নাইং এখন মেজর জেনারেল এবং সংগঠনের চিফ অব স্টাফ। গত দশকে আরাকান আর্মির জনবল ও সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে। বর্তমানে এই গ্রুপের ১০ হাজারের মতো সেনা রয়েছে বলে জানা যায়।

আরাকান আর্মি প্রাথমিক পর্যায়ে যদিও কেআইএ’র এলাকাতে সক্রিয় ছিল, কিন্তু ২০১৫ সালে তারা সেনাদের রাখাইনে সরিয়ে নেয় এবং সেখানে শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলে। বছরে আরাকান আর্মি কয়েকশ নতুন সেনা নিয়োগ দেয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত কেআইএ’র মিলিটারি একাডেমিতে তারা সীমিত সংখ্যক তরুণকে সামরিক বিষয়ে লেখাপড়ার জন্য পাঠাতো। গত বছর থেকে অবশ্য তাদের আর সেনা পাঠানোর প্রয়োজন পড়ছে না, কারণ তারা নিজেরাই নিজেদের একাডেমি গড়ে তুলেছে। সেখানেই বহু আরাকান আর্মির সেনাদের এখন প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

ফাঁদে পড়ে যাওয়া

আরাকান আর্মির উত্থান এবং তাতমাদাওয়ের আধিপত্যের প্রতি তাদের ছুড়ে চ্যালেঞ্জের কারণে তাতমাদাওয়ের সহ্যসীমা পার হয়ে গেছে। তাতমাদাও একবার বলেছিল যে, ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি তাদের ৩০তম বার্ষিকীর প্যারেডে নিজেদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনীর পর তাদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সংযম দেখাচ্ছে তাতমাদাও।

২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর দেশজুড়ে অস্ত্রবিরতি চুক্তির তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে তাতমাদাওয়ের কমাণ্ডার-ইন-চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাইং জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, ২০২০ সালে তাতমাদাও ‘চিরস্থায়ী শান্তি’ নিয়ে আসবে। তবে, তাতমাদাও যখন একতরফাভাবে অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করে, তখন ঘোষণা থেকে তাকের ওয়েস্টার্ন কমাণ্ডকে বাদ দেয়া হয়, যাদের অধীনে রাখাইন রাজ্য পড়েছে। আঞ্চলিক কমাণ্ডগুলোর মধ্য মাত্র পাঁচটির ক্ষেত্রে ওই আদেশ প্রযোজ্য হবে: কাচিন রাজ্যের নর্দার্ন কমান্ড, নর্থইস্টার্ন, ইস্টার্ন, এবং সেন্ট্রান ইস্টার্ন কমান্ড; এবং শান রাজ্যের ট্রায়াঙ্গেল কমাণ্ড। আরাকান আর্মি অভিযোগ করেছে যে, তাতমাদাওয়ের এই কৌশল গ্রহণ নিয়েছে, যাতে তারা রাখাইন রাজ্য তাদের অভিযান চালিয়ে যেতে পারে।

যখন প্রতিষ্ঠিত শক্তি স্পার্ট আর উদীয়মান শক্তি এথেন্স যুদ্ধে নামে, তখন এর মূল্যটা পুরো গ্রিস টের পেয়েছিল। যুদ্ধে বড় বড় শহরগুলো যেভাবে ধ্বংস হয়েছিল এবং এর ফলশ্রুতিতে যে দারিদ্র নেমে এসেছিল, সেটার প্রভাব সবার উপরেই পড়েছিল।

একইভাবে রাখাইনে মিয়ানমারের আধিপত্যবাদী শক্তি তাতমাদাও এবং উদীয়মান শক্তি আরাকান আর্মির যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে, বহু নিরপরাধ মানুষ জীবন হারিয়েছে এবং বহু গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে। তাতমাদাও আর আরাকান আর্মি যে ফাঁদে পড়ে গেছে, সেটা শেষ পর্যন্ত রাখাইন এবং চিন রাজ্যের জনগণের জন্য ব্যাপক দুর্দশা নিয়ে এসেছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আরাকান আর্মি, তাতমাদাও
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন