parbattanews

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছুরির নিচ থেকে যেভাবে বেঁচে বাংলাদেশ আসেন রোহিঙ্গা যুবক

 

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার, ধর্ষণসহ নিশৃংস হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে প্রাণ বাঁচতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হচ্ছে হাফেজ মোহাম্মদ ইউনুচ (২৫)। রাখাইনে বুথেডংয়ের খিয়াম্বু লামারপাড়া গ্রামে তার বাড়ি। পিতার নাম আলী হোসেন।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাত থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসার ঘটনাগুলো বর্ণনা দিতে গিয়ে শিহরিত হয়ে উঠছিলেন ভয়ার্ত ইউনুচ।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, গত ২৫শে আগস্ট থেকে বিভিন্ন রোহিঙ্গা গ্রামে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু হয়। মিয়ানমার সেনা ও বৌদ্ধদের মুসলিম নিধনের খবর পাচ্ছিলাম। পুড়িয়ে দিচ্ছিল ঘরবাড়ি। কিন্তু আমাদের খিয়াম্বু লামাপাড়ার কাছে মগপাড়া ও একটি সেনা ক্যাম্প এবং কিয়াং রয়েছে। তাদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সুসম্পর্কও ছিল। আমাদের কোন ক্ষতি করবে না এমন আশ্বাস দিয়ে গ্রাম না ছাড়তে বলে সেনা সদস্যরা। কোথাও না যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এতে এক সময় আমরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি। খাবার-দাবার, বাজার-সওদার অভাবে করুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

এরই মধ্যে ১৬ই সেপ্টেম্বর সকাল ৯টার দিকে গরু চরাতে বের হন আমার বাবা। সঙ্গে চাচা নবী হোসেন (৬০) এবং স্থানীয় আবুল কালাম (৫০)। পাশের ছোট্ট একটা খালের তীর দিয়ে তারা যাচ্ছিলেন। খালের ওপারে কয়েকজন সেনা সদস্য তাদের দেখেই বন্দুক তাক করে। তাদের দিকে যেতে বলে। তখন বাবা ও আবুল কালাম জিম্মি হয়ে পড়েন। চাচা নবী হোসেন তাদের কথা না শুনে গুরুর আড়ালে আড়ালে পালিয়ে আসেন। কিছু দূরে নিরাপদে এসে দেখেন ঘটনা। তারা দু’জন সামনে এগিয়ে খালের তীরে দাঁড়ান। তখন গলা পানি মাড়িয়ে খাল পার হতে বলে। তারা দু’জন পার হন। কাছে যেতেই দু’জনকে বন্দুক দিয়ে আঘাত করা হয়। দু’জনই পড়ে যান। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় পাশে কেয়াংয়ের দিকে। চাচা নবী হোসেন বাড়িতে গিয়ে এসব কথা জানান। প্রত্যক্ষদর্শী গ্রামবাসীও তা জানান। কিন্তু তাদের নেয়ার পর পরই যে কিয়াংয়ের চত্বরে পাহাড়ের ঢালে নিয়ে জবাই করে দেয়া হয়েছে, তা আমরা তখনও জানতে পারিনি। পরদিন এ খবর পেয়েছি অন্য গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে। তার আগে ওই রাতেই তিন যুবক গিয়ে তাদের লাশ দেখে আসে। মোবাইলে গলাকাট লাশের ছবি ধারণ করে আনে।

দু’জনকে ধরে নেয়ার আধঘণ্টা পর পাশের ইসলামের বাড়ি আসেন স্থানীয় চাক জনপ্রতিনিধি ওচিং। তিনি সেখানে একটা কাজে এসেছিলেন। তখন আমরা তাকে গিয়ে ধরি। বিস্তারিত ঘটনা খুলে বলি। যত টাকা চায়, তত টাকা মুক্তিপণ দিয়ে বাবাকে ছাড়িয়ে আনতে তার সহায়তা চাই। তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে সেনা সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য রওয়ানা হন। কাছের গ্রাম গোপীতে পৌঁছলে ৫ সেনা সদস্যের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের কাছে তিনি খিয়াম্বু লামারপাড়া থেকে কিছুক্ষণ আগে ধরে আনা দু’জনের কথা বলে সন্ধান চান। তখন এক সেনা সদস্য আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তুমিই কী তাদেরকে নিতে এসেছো?’ হ্যাঁ, বলতেই আমার ঘাড়ে উপর্যুপরি বেতের আঘাত করতে থাকে।

তারপর ওচিংয়ের সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে আমাকে নিয়েই তারা কেয়াং চত্বরের দিকে যাচ্ছিলো। তখনও জানতাম না যে সে দিকেই পাহাড়ের ঢালের কাছে নিয়ে আমার বাবাকে জবাই করে দেয়া হয়েছে। আমাকেও একই উদ্দেশ্যে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কেয়াংয়ের কাছে পৌঁছে চত্বর এলাকায় ঢোকার আগেই এক সেনা কর্মকর্তা সে দিকে না নিতে বলে। তখন ওই পাঁচজন পথ পরিবর্তন করে। কাছের কাঠের তৈরি স্কুল ঘরের দিকে নেয়া হয়। স্কুলের উঠানে নিয়ে উপুড় করে শুইয়ে রাখা হয়। দু’হাতের উপর তুলে দেয়া হয় ভারি জিনিস। সেই উঠানে কাদা মাটি ছিল। তা এড়াতে আমার পিঠের উপর পা দিয়েই আসা-যাওয়া করতে থাকে সেনা সদস্যরা। প্রচণ্ড রোদে এভাবে আমাকে অন্তত সাড়ে তিন ঘণ্টা রাখা হয়।

এরপর এক সেনা সদস্য এসে একটি ছুরি নিয়ে আমার গলায় বসায়। কোপ দেয়ার জন্য প্রস্তুতি হিসেবে প্রথমবার বসাতেই আমি চমকে উঠি। ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকানোর চেষ্টা করি। মাথা তুলতেই আমার মুখে জোরে লাথি মারে। কপালের এক পাশে এক চোখের উপর লাথি পড়ে। কিছুটা দূরে ছিটকে পড়ি। তারপর আর ছুরি চালায় নি। তারপর আমাকে তুলে দাঁড় করানো হয়। কিন্তু আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাই। পানি খেতে চাই। আমাকে পানি দেয়া হয়নি। আবার আমাকে দাঁড় করায়। মাথার উপর গুলির বোঝা ও ব্যাগ তুলে দেয়। সে সঙ্গে সৌর প্যানেলের প্লেটও তুলে দেয়া হয়। হাঁটতে না পারলেই পিঠে লাথির পর লাথি। তিন মাইল হাঁটিয়ে আর একটি স্কুলে নেয়া হয়। সেখানে মাথার উপর একটি হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছিলো।

এরপর জিনিসপত্রগুলো নামাতে বলে। কথামতো রাখি। সেখানে অন্তত ৪০ জনের মতো সেনা সদস্য ছিল। সবার বসার জন্য চেয়ার ছিল না। পাশেই একটি মাদরাসা। যে সেনা সদস্যরা গোপী থেকে আমাকে ধরে নিয়ে আসে তাদের একজন পাশের মাদরাসা থেকে একটি চেয়ার এনে দিতে বলে। মাদরাসাটি কাছেই ছিল। আমি তার কথা মতো মাদরাসার দিকে যাই। আড়াল হতেই ভাবি, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। জবাই করতে গিয়েও হয়তো মালামাল বহনের জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছে। এমনিতে তো মরবো। পালিয়ে যাই। বাঁচার চেষ্টা করে মরি। পেছন থেকে গুলি করলেও তো অন্তত বাঁচার চেষ্টাটা করা হবে। তখনই দৌড় দিই। কিন্তু প্রতিক্ষণে মনে হয়েছে এই বুঝি গুলি এসে লাগলো। এই বুঝি পড়ে গেলাম। কিছুক্ষণ দৌঁড়ানোর পর গ্রামে পৌঁছি পর মনে হলো ‘আমি বোধ হয় বেঁচে গেছি’। এরপরই বাংলাদেশের দিকে পা বাড়াই। তারপর বাংলাদেশে এসে ক্যাম্পে আশ্রয় নেই।

সূত্র: বিডি মর্নিং

Exit mobile version