মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হৃদপিণ্ডে আঘাত


সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্রোহী গ্রুপগুলো সবচেয়ে দু:সাহসিক হামলা চালিয়েছে গত বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট)। উত্তর পূর্বাঞ্চলে দেশটির সেনাবাহিনীর প্রধান প্রশিক্ষণ একাডেমি ও চীনের সঙ্গে প্রধান বাণিজ্যপথের উপর আকস্মিক এই হামলা চালানো হয়।
নর্দান এলায়েন্স-বার্মা (এনএবি) নামে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠীর এই জোটের তড়িৎ হামলা দেশের উত্তরাঞ্চলে কার্যকরভাবে আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করেছে। এসব গ্রুপ ফেডারেল অটনমির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করছে। উপকূলীয় রাজ্য রাখাইনে গত কয়েক বছর ধরে সংঘাতের আগুনে জ্বলছে।
ভোররাতে বিদ্রোহীরা শান রাজ্যের নাউং খিও টাউনশিপের কাছাকাছি বেশ কয়েকটি পয়েন্টে একযোগ হামলা করে। এই টাউনশিপ মান্দালে শহরকে চীন সীমান্তের মুসে শহরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ঔপনিবেশিক যুগের ঐতিহাসিক দীর্ঘ রেলসেতু গোটেইকের কাছে নাউং খিও’র অবস্থান।
হামলায় অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে ছিলো পালাউং তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), কোকাং এলাকার জাতিগত চায়নিজ মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমক্রেটিক এলায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও রাখাইনের আরাকান আর্মি (এএ)। রাখাইন রাজ্যের যুদ্ধক্ষেত্রে মূল মনযোগ থাকলেও উত্তরাঞ্চলেও মনযোগ দিয়েছে এএ।
নাউং খিও’র সবচেয়ে গুরুতর হামলাটি চালানো হয় গোকে টুইন ব্রিজের পুলিশ ও সেনা পোস্টের উপর। এতে ১০ নিরাপত্তা সদস্য নিহত হয় বলে জানা যায়। অনেকে আহত ও সেতুর ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেতুর টোলগেট ও আরো কয়েকটি ছোট নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ফলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫।
গ্যারিসন শহর পাইন ও লুইনে অবস্থিত ডিফেন্স সার্ভিস টেকনিক্যাল একাডেমি (ডিএসটিএ)’র উপর হামলাও কম বিস্ময়ের ছিলো না। মান্দালের ঘাড়ের উপর শান উপত্যকায় এর অবস্থান। আগে শহরটির নাম ছিলো মাইমিও।
ডিএসটিএ হলো সেনাবাহিনীর সাইবার অপারেশন ও সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যা ডিফেন্স সার্ভিস একাডেমির (ডিএসএ) অংশ।
সরকারি ভাষ্যে বলা হয়, হামলায় একজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত ও একজন সেনা আহত হয়েছে। এই হামলা প্রতীকি অর্থেও অত্যন্ত শক্তিশালী। কারণ হামলা করা হয় সেনাবাহিনীর সবচেয়ে মর্যাদাবান প্রতিষ্ঠানগুলোর একটির উপর। এখানে অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
হামলার কাজে ১০৭ মিলিমিটার সারফেস টু সারফেস রকেট ব্যবহার করা হয়। সম্ভবত এসব অস্ত্র শক্তিশালী জাতিগত গ্রুপ ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মির (ইউডব্লিউএসএ) কাছ থেকে কেনা হয়েছে। ফলে মিয়ানমারে বিদ্রোহের ধরনটিই বদলে গেলো।
আন-গাইডেড ফ্রি লাইট মিসাইলগুলো বালির বস্তার উপর রেখে আট কিলোমিটার দূর থেকে ছোঁড়া যায়। সম্প্রতি এএ রাখাইন রাজ্যের নদীতে মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজে হামলার জন্য আরো কাছ থেকে এই রকেট ছোড়ে। পাইন ও লুইন হামলার পর কাছাকাছি একটি পাহাড়ে অবিস্ফোরিত অবস্থায় এ ধরনের ছয়টি রকেট খুঁজে পাওয়া যায়।
টিএনএলএ কমান্ডার তার ফোনে কিয়াও ইরাবতী ম্যাগাজিনকে বলেন যে, দুটি আলাদা রাজ্যে সেনাবাহিনী যে অভিযান চালাচ্ছে তার পাল্টা জবাব হিসেবে একযোগে হামলাগুলো চালানো হলো।
চলতি বছরের শুরু থেকে রাখাইন রাজ্যে এএ’র বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। লড়াই ক্রমেই মিয়ানমারের কেন্দ্রস্থলের দিকে সরে আসছে।
শান রাজ্যে জোট বাহিনীর উপর হামলা করেছে সেনাবাহিনী। উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকা গত ডিসেম্বরে ঘোষিত যুদ্ধবিরতির আওতায় ছিলো। ৩১ আগস্ট যুদ্ধ বিরতি শেষ হওয়ার আগেই হামলা চালায় সেনাবাহিনী।
টিএনএলএ কমান্ডার বলেন, আমরা সেনাবাহিনীকে রাখাইনে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলেছি কিন্তু তারা তা শোনেনি। আমরা তাদেরকে আমাদের এলাকায় হামলা বন্ধ করতে বলেছি। কিন্তু এরপরও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদেরকে পাল্টা হামলা চালাতে হয়েছে।
মনে হচ্ছে রাখাইন রাজ্য ও চিন রাজ্যের কাছাকাছি অন্তত পাঁচটি এলাকায় সরকারি বাহিনী ব্যাপক সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে বড় ধরনের হামলা শুরু করার প্রেক্ষাপটে উত্তরাঞ্চলে নতুন রণাঙ্গন তৈরি করা হলো।
গত বছর ডিসেম্বরের শেষ দিকে ও জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে এএ’র সঙ্গে সেনাবাহিনীর লড়াইয়ের সূচনা হয়। ওই অঞ্চলের প্রায় ৫০,০০০ বেসামরিক লোকজন বাস্তচ্যুত হয়েছে।
কিছু রিপোর্টে বলা হয়েছে যে সেনাবাহিনী কয়েকটি জায়গায় এএ-কে পিছু হটতে বাধ্য করেছে। এ কারণে রাখাইনের মধ্যাঞ্চলে মায়েবন ও আন টাউনশিপের কাছে নতুন রনাঙ্গণ তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। চীনা অর্থায়নে নির্মিতব্য গভীর সমুদ্রবন্দর কিয়াকফিউর কাছাকাছি এই অঞ্চল।
নভেম্বর নাগাদ শুকনো মওসুম এগিয়ে আসায় আরো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে লড়াই ছড়িয়ে পড়বে বলে আশংকা করা হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে নতুন ফ্রন্ট খোলার কারণে সরকারি বাহিনী এরই মধ্যে চাপে পড়ে গেছে বলে মনে হয়।
তবে আসন্ন মাসগুলোতে লড়াইয়ের গতিবিধি কেমন হবে তা নির্ভর করবে আরেক শক্তিশালী কিন্তু অনিচ্ছুক বিদ্রোহী গ্রুপ কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি (কেআইএ)’র মনোভাবের উপর। বহু দশক ধরে চলে আসা মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের এই সন্ধিক্ষণে কাচিনরা কি যুদ্ধে জড়াবে নাকি পাশে বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
সূত্র: সাউথএশিয়ানমনিটরডটকম