parbattanews

মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিকা

ভারত বিভাগের সময় পার্বত্য নেতৃত্ব পাকিস্তানের বিপক্ষে অবস্থান করলেও বাংলাদেশের অস্তিত্বের সংগ্রামের সময় ওই নেতৃত্বই আবার পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে, তবে সবাই না। মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য জনগণের এই পরিবর্তিত অবস্থান অনুভব করতে হলে, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক বিবর্তন সম্পর্কিত ধারণা থাকা প্রয়োজন।

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে মানবেন্দ্র নারায়ণ লার্মা এবং এ এস প্রু চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন এবং চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জাতীয় অ্যাসেম্বলীতে নির্বাচিত হন। নিজেদের কাছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকা সত্ত্বেও উপজাতীয়রা স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেদের অবস্থান নির্ণয়ে দ্রুত ও সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ ও রাজারা বিভিন্নমুখী অবস্থান গ্রহণ করেন। নেতৃবৃন্দের বিভিন্নমুখী অবস্থানের কারণে সাধারণ উপজাতীয় জনগণ মুক্তিযুদ্ধের সময় দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অপরদিকে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগেরও রয়েছে এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। উপজাতীয় জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উৎসাহ দেখায়নি আওয়ামী নেতৃত্ব। এমনকি যুদ্ধের প্রথমদিকে অতি উৎসাহী কিছু উপজাতীয় যুবক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাইলে আওয়ামী নেতৃত্ব তাদেরকে বিফল মনোরথ করেন।

উপজাতীয় যুবকদের কিছু সংখ্যক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও অধিকাংশই পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত ‘সিভিল আমর্ড ফোর্স’ বা ‘সিএএফ’ (রাজাকার বাহিনী হিসেবে পরিচিত) এ যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় অংশ নেয়। তৎকালীন রাজাকার বাহিনীতে তুলনামূলকভাবে চাকমাদের সংখ্যাই ছিল বেশি। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন চাকমা সার্কেলের রাজা ত্রিদিব রায়। রাজার নির্দেশে হেডম্যান, কার্বারীরা গ্রামের লোকদেরকে জোরপূর্বক রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করে। অনেকেই বেতন এবং অস্ত্রেও লোভে ‘সিএএফ’ এ যোগ দেয়। রাজা ত্রিদিব রায় তার সার্কেলের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গিয়ে জনগণকে পাকিস্তানী বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য প্রচারণা চালাতে থাকেন। চাকমা যুবকেরা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, পানছড়ি প্রভৃতি এলাকায় স্থাপিত পাকিস্তানি ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। উপজাতীয়দের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন রাজশাহী বিভাগ থেকে পালিয়ে আসা ইপিআর এর হাবিলদার মি. নলিনী রঞ্জন চাকমা এবং হাবিলদার মি. অমৃতলাল চাকমা। এরা প্রশিক্ষকের পাশাপাশি দোভাষীর কাজ করতেন। স্বাধীনতার পরপর এ দু’জন ইপিআর হাবিলদার তাদের চাকুরী ফেরত না পেয়ে ১৯৭৩ সালে শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। উপজাতীয় যুবকেরা ট্রেনিং ক্যাম্পে ৩০৩ রাইফেল, কারবাইন, স্টেনগান, এলএমজি, দুই ইঞ্চি মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড, ওয়ারলেস প্রভৃতি চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।

অপর প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও মন্ত্রী অং শৈ প্রু চৌধুরীও পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেন এবং হানাদার বাহিনীর সক্রিয় সহযোগী ছিলেন। (চাকমা, সিদ্ধার্থ পৃ: ৩৩)।

পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা মুক্তিযুদ্ধে উপজাতীয়দের ভূমিকা কী হবে বা কী হওয়া বাঞ্ছনীয় এ প্রসঙ্গে পরিষ্কার বক্তব্য রাখতে ব্যর্থ হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকেন। বরং, তিনি এ সময় নিজের সংগঠন মজবুত করতে এবং উপজাতীয় জনগণের মাঝে সংগঠন বিস্তৃত করতেই ব্যস্ত ছিলেন (সিদ্ধার্থ, পৃ. ৩৮)।

প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কুমার কোকনাদক্ষ রায় (বিজয়ী হননি) মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার পথে রামগড়ের সীমান্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। গ্রেফতার করার পর মুক্তি বাহিনী তাকে ভারতের জেলে পাঠিয়ে দেয়। পরে অবশ্য তিনি মুক্তিলাভ করেন। গ্রেফতার হওয়ার কারণ তার হাতে একটি সিভিল বন্দুক ছিল (সিদ্ধার্থ, পৃ. ৩৬)।

জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে রাজা ত্রিদিব রায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী চারু বিকাশ চাকমা (যিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পূর্বে আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন না, বরং বামপন্থী ছিলেন) উপজাতি ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য উৎসাহিত করলেও মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়কালে অরণ্যাবৃত পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করেছিলেন বলে শোনা যায় (সিদ্ধার্থ, পৃ. ৩৯)।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিন সার্কেলের তিন রাজার মধ্যে একমাত্র মানিকছড়ির রাজা মং প্রু চাঁই চৌধুরী (বা মং প্রু সাইন) মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বোমাং সার্কেলের রাজা মং শৈ প্রু চৌধুরী ’৬৫ সালে মুসলিম লীগের টিকিটে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর পরিবারের লোকজন পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে।

রাজা ত্রিদিব রায় মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আর দেশে ফিরে আসেননি; অং শৈ প্রু চৌধুরী স্বাধীনতার পর জেলে বন্দী হন (সিদ্ধার্থ চাকমা, পৃ. ৪৬)। পরবর্তীতে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে অং শৈ প্রু চৌধুরী বোমাং রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাবেক চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় আমৃত্যু পাকিস্তানে ছিলেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় নিয়ে মাঝে মাঝে লেখালেখি করতেন, যথা করাচি থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ডন (DAWN) পত্রিকায় ৪ অক্টোবর ২০০০ তারিখে তিনি চিটাগাং হিল ট্র্যাক্ট: লেট জাস্টিস বি ডান শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন।

বেশ কিছু উপজাতি নেতা এবং উপজাতীয় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকাণ্ড স্বভাবিকভাবেই স্থানীয় মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের ক্ষেপিয়ে তোলে। ফলশ্রুতিতে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাটিরাঙ্গা গ্রামের কিছু অধিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে, ‘৭১ এর ৫ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কিছু সদস্য পানছড়ি ও দীঘিনালায় নৃশংস ঘটনা ঘটায় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসকল অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপজাতীয় মুক্তিযোদ্ধারা (সীমিত সংখ্যক যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন) এসময় তাদের সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়াতে চাইলে কর্তৃপক্ষের বাধার কারণে তা সম্ভব হয়নি; যদিও কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে বড় ধরনের কোন সংঘর্ষ আর ঘটতে দেয়নি, তবুও এসকল ঘটনা পরবর্তী উপজাতি এবং অ-উপজাতি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। উপজাতীয় রাজাকাররা এসময় গভীর অরণ্যে পালিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তারা সশস্ত্র ও সংগঠিত হয়ে ‘শান্তিবাহিনী’ নামে সংগঠন গড়ে তোলে (সিদ্ধার্থ চাকমা; পৃ ৪৬)।

সূত্র: লেখকের বই ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ-পরিস্থিতির মূল্যায়ন,’ মাওলা ব্রাদার্স , ঢাকা, তৃতীয় মুদ্রণ, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা. ৭৭-৭৮ থেকে সংকলিত।

Exit mobile version