parbattanews

মুসলিম সমাজে হোলি উৎসব মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বলন এসব কিসের আলামত?


মেহেদী হাসান পলাশ
গতকাল ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হোলি উৎসব। কোথাও কোথাও এই উৎসবকে দোল পূর্ণিমাও বলা হয়ে থাকে। চৈত্র মাসের শেষ পূর্ণিমাতে এই উৎসব পালিত হয় বলে এমন নাম। গতকাল আমি দেখলাম কয়েকটা মেয়ে (মহিলাসহ) যারা সবাই মুসলমান রঙ মেখে হিন্দুদের মতো হোলি খেলছে। মেয়েগুলো সবাই আমার বসবাসকারী ভবনের ও তার আশেপাশের কয়েকটি ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটের হওয়ায় আমি তাদের বেশির ভাগকেই জানি। আমি বিস্মিত হয়ে ভাবছিলাম, বাংলাদেশী মুসলমানদের সংস্কৃতি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে?

অফিসের এক সহকর্মী বললেন, এ আর কি, আমাকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি স্থান থেকে হোলি খেলার উৎসবে অংশ নেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সহকর্মীর কথা শুনে বিস্ময়ের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। কারণ, ইতিহাস ও উৎপত্তি বিচারে হোলি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসব।

হোলি উৎসবের উৎপত্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, অবতার শ্রীকৃষ্ণ একদা বৃন্দাবনে রাধা ও তার সখীদের সঙ্গে লীলারত ছিলেন। সে সময় হঠাৎ শ্রী রাধার রজঃশ্রাব শুরু হয় এবং তাতে তার বসন রঞ্জিত হয়। এতে করে শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণ লজ্জিত ও বিব্রত হয়ে পড়েন। এ সময় শ্রীকৃষ্ণ রাধার লজ্জা ঢাকতে এবং বিষয়টি তার সখীদের নিকট গোপন করতে শ্রী রাধা ও তার সখীদের সাথে আবীর খেলা শুরু করেন এবং তাদের আবীর দিয়ে রাঙিয়ে দেন। শ্রীকৃষ্ণ, রাধা ও তার সখীদের এই আবীর খেলার স্মরণে হিন্দু সমাজে হোলি উৎসবের প্রচলন হয়েছে। উৎপত্তি যে প্রকারেই হোক, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই উৎসব হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পালন নিয়ে কোনো আপত্তি ওঠেনি কোথাও। কিন্তু মুসলিম সমাজে যখন এই উৎসব পালিত হতে শুরু করে তখন তা নিয়ে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না।

এদিকে গত ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস যেভাবে পালন করা হলো তা নিয়েও এদেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে শাহবাগীরা মোমবাতিতে আগুন জ্বালিয়ে অগ্নিমিছিল সহকারে শহীদ মিনারে এসে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাথে একাত্ম হন। এরপর মোমবাতির আগুনে সাজানো হয় শহীদ মিনার। গণজাগরণ মঞ্চের লোকেরা সেখান থেকে অগ্নিমিছিল সহকারে জগন্নাথ হলে যায়। জগন্নাথ হলের গণকবরের স্মৃতিসৌধেও অগ্নি প্রজ্বলন করে তারা এবং কয়েক মিনিটের জন্য সে অগ্নি নিভিয়ে ব্লাক আউট কর্মসূচী পালন করে। অন্যদিকে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম শিখা চিরন্তনে মোমাবতি দ্বারা অগ্নি প্রজ্বলন করে। আরো একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী রাজারবাগের স্মৃতি সৌধে মোমবাতি দ্বারা অগ্নি প্রজ্বলন করে।

বিগত ৪২ বছর ধরে আমরা স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস পালন করে আসছি। কিন্তু এবারের মতো কোনো বছর এত ব্যাপকভাবে বহ্নিউৎসব বা অগ্নি প্রজ্বলন করা হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে। যারা ইসলামের অনুসৃত পথে ও ইসলামের জন্য মৃত্যুবরণ করেন তাদেরকে ‘শহীদ’ বলে আল কুরআনে উচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। অবতার কৃষ্ণের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে, রামের লঙ্কা জয়ের যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছিলেন মহাভারত ও রামায়ণে তাদের ‘শহীদ’ বলা হয় নি। এমনকি ক্রুসেডে যারা নিহত হয়েছে তাদেরকেও কোথায়ও ‘শহীদ’ বলা হয় নি। ‘শহীদ’ শব্দটি একান্তভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ও প্রযোজ্য। ইসলামে দেশপ্রেমকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। সেকারণেই দেশকে স্বাধীন করতে দলে দলে লোক মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে শহীদ অথবা গাজীর মর্যাদা পেতে।

স্বাধীনতা যোদ্ধারা লড়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। আর তাদের মা, বাবা, স্ত্রী, কন্যা, ভাইবোনসহ আত্মীয় স্বজনেরা সারা দিনমান জায়নামাজে বসে নামাজ রোজা, মানত করে আল্লাহর কাছে তাদের বিজয় কামনা করে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধেও প্রায় সকল অগ্রনায়ক আজ প্রকাশ্যে স্বীকার করেন, মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম একে অন্যের পরিপূরক ও সম্পূরক ছিল। তাই দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় ’৭১’র স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন তাদেরকে আমরা শহীদ বলি।(গণ জাগরণ মঞ্চ খোদাদ্রোহী নাস্তিক রাজিব হায়দারকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ হিসাবে আখ্যা দিয়েছে)। সেই শহীদদের স্মরণে অগ্নি প্রজ্বলন করা হলো। কিন্তু উল্লিখিত গোষ্ঠীর কেউ কোথাও অগ্নি প্রজ্বলনের আগে পরে শহীদ আত্মার রুহের মাগফেরাত কামনা করে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে মুনাজাত করেনি। কাজেই প্রশ্ন উঠতে পারে শহীদদের স্মরণ করার একমাত্র রাস্তা কি বহ্নি উৎসব?

গণজাগরণ মঞ্চের শুরু থেকে এই অগ্নি প্রজ্বলন কর্মসূচী নেয়া হয়েছে কয়েকবার। ২৫ মার্চ দিনগত রাতেও সেক্টর কমা-ার্স ফোরাম গণজাগরণ মঞ্চে গিয়ে আয়োজকদের কাছে জাতীয় পতাকা তুলে দিলে গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে ফোরামের নেতৃবৃন্দের হাতে তুলে দেয়া হয় মঙ্গল প্রদীপ। প্রশ্ন উঠতে পারে, কি এই মঙ্গল প্রদীপ, কেন এই অগ্নি প্রজ্বলন? এসবের উৎস বা উৎপত্তি কোথায়?

মহাভারত, বিষ্ণু পুরাণ, হরিবংশ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থে ‘অঙ্গীরার পুত্র’, সন্ধিলার প্রপৌত্র, ব্রহ্মার জ্যেষ্ঠ পুত্র, দক্ষকন্যা স্বাহার স্বামী (অগ্নীপুরাণ), ধর্মের ঔরসে ও বসুভার্যার গর্ভে অগ্নির জন্ম (মহাভারত অনুশাসন)। উপমহাদেশের সনাতনী সম্প্রদায়ের কাছে অগ্নি প্রত্যক্ষ দেবতারূপী ভগবান। ঋগে¦দে অগ্নিকে পার্থিব দেবতাদের মধ্যে প্রধান বলে দাবী করা হয়েছে। অগ্নি দেবতা ও মানবের মধ্যস্থতাকারী- যজ্ঞ সারথী। অগ্নি নিজের রথে দেবতাদের বহন করে যজ্ঞস্থলে বা মঙ্গলকাজে নিয়ে আসেন। সেকারণে অগ্নির অপর নাম যজ্ঞ পুরোহিত। ঋগ্বেদে সংহিতায় ২০০ সুক্তে অগ্নির স্তব করা হয়েছে, যা দেবরাজ ইন্দ্র ভিন্ন অন্য কোনো দেবতার বেলায় করা হয়নি। ঋগ্বেদে শুরু হয়েছে অগ্নি বন্দনা দিয়ে এবং শেষও হয়েছে অগ্নিবন্দনা দিয়েই। মহামুণি বশিষ্ঠকে ব্রহ্মজ্ঞান শিক্ষা দেয়ার জন্য অগ্নি দেবতার মুখ থেকে যে ১৫৪০০টি শ্লোক নির্গত হয় তাই অগ্নিপুরাণ নামে খ্যাত। দেবতাগণ অগ্নি ব্যতিত যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হন না। সেকারণেই হিন্দুরা জন্ম, মৃত্যু, বিয়েসহ সকল মঙ্গলকাজে অগ্নিকে সাক্ষী রাখে, সম্মুখে রাখে।

শুধু মানুষ নয় রামায়ণে, দেবতা রামকেও দেখা যায় তার স্ত্রী সীতার পবিত্রতা প্রমাণে অগ্নিস্নানের নির্দেশ দিতে। সে কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, নতুন প্রজন্মের নাম করে গণজাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে কোন সংস্কৃতি আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে? এ বিষয়ে দেশবাসী সচেতন না হলে নতুন প্রজন্মের নামে যে পৌত্তলিক সংস্কৃতি আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তা প্রতিরোধ করার কোনো উপায় থাকবে না।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে এই পৌত্তলিক সংস্কৃতি ছড়িয়ে যাবার মূল কারণ নিয়ন্ত্রণহীণভাবে বলিউডি সিনেমা ও ভারতীয় স্যাটেলাইট টিভির অনুপ্রবেশ। এখানকার বিয়ের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের পুরোটাই এখন দখল করে নিয়েছে বলিউডি অনুকরণে নাচগান, ডিজে ও পানাহার। আমরা বাংলাদেশী মুসলমানদের, বাংলাদেশী হিন্দুদের সংস্কৃতির রূপরেখা, সীমা, পরিসীমা কি হবে তা স্বাধীনতার ৪২ বছর ধরেও নির্ধারণ করতে পারিনি। এরই মধ্যে বানের মতো ঢুকে পড়েছে বলিউডি সংস্কৃতি।

অন্ধভাবে মনু ও বাৎসায়নের সংস্কৃতি অনুসরণ করতে গিয়ে ভারত নিজেই এখন মহা বেকায়দায়। বলিউড আর বাৎসায়নের প্রভাবে ভারতের নারীরা আজ ঘরে বাইরে বিশ্বের মধ্যে সবচাইতে বেশী অনিরাপত্তায় ভুগছে। বিশ্ব যখন ভারত ভ্রমণকারী নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তখন আমাদের উপর নানা কৌশলে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে সেই দ্রৌপদী সংস্কৃতি। নাটক, চলচ্চিত্র, সিরিয়ালে সুগার কোটেড করে পৌত্তলিক সংস্কৃতি প্রতিদিন আমাদের সামনে পরিবেশন করা হচ্ছে, আর আমরা বুঝে ও না বুঝে তা গোগ্রাসে গিলছি।

বুঝে বলা হলো এ কারণে যে, আমাদের ঘরে টিভিও আছে, কুরআন ও হাদিসগ্রন্থ আছে। আমরা যদি কুরআন, হাদিস বাদ দিয়ে উপনিষদেও সংস্কৃতি প্রচারকারী স্টার প্লাস, সনি, জিটিভি গ্রহণ করি সে দায় কিছুটা আমাদেরও? আজান শুনে কেউ যদি নামাজে না গিয়ে সিরিয়াল দেখে তার জন্য এককভাবে সিরিয়ালের দোষ দেয়া যায় না। এখানে আমাদের অসচেতনতাও অনেকটা দায়ী। হাদীসে বলা হয়েছে, “মান তাসাব্বাহা বে কাওমিন ফাহুয়া মিনহুম- অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের হুবহু অনুকরণে অভ্যস্ত হয়ে যাবে, সে পরকালে সে সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে উত্থিত হবে।”- বুখারী ও মুসলিম। কাজেই বাংলাদেশী মুসলিম সমাজে পৌত্তলিক সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এখনই আমাদের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

palash74@gmail.com

Exit mobile version