parbattanews

মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড: পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বললেন, রোহিঙ্গা নেতার হত্যাকারীদের ‘কাউকে ছাড় দেয়া হবে না’, আরো দুজন আটক

কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ‘সরকার কঠোর ব্যবস্থা’ গ্রহণ করবে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বার্তায় মি. মোমেন উল্লেখ করেছেন যে; “মুহিবুল্লাহ নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত যেতে চেয়েছিলেন, সেকারণে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল তাকে হত্যা করেছে।”

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয় যে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ‘কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’

রোহিঙ্গা নেতা মি. মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বিবৃতি এমন সময় এলো, যখন এই হত্যাকাণ্ডের বিচারকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর চাপের মুখে পড়ছে বাংলাদেশ সরকার।

ব্লিঙ্কেনের বিবৃতি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

মি. মুহিবুল্লাহ হত্যার পর হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে এবং তার হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট শুক্রবার এক বিবৃতিতে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের দ্রুত, সুষ্ঠু ও কার্যকর তদন্ত পরিচালনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানান।

শরণার্থী শিবিরে মি. মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের অনিরাপত্তার বিষয়টি উঠে এসেছে বলে মন্তব্য করেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধান।

তিনি বলেন, “মুহিবুল্লাহর হত্যার জন্য যেই দায়ী হোক না কেন, তার মৃত্যুতে ক্যাম্পের ভেতরের অনিরাপদ পরিবেশ ও সেখানে মধ্যমপন্থী নাগরিক সমাজের কন্ঠরোধ করার প্রবণতার স্পষ্ট উদাহরণ।”

মিজ ব্যাচেলেট বলেন শুধু হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার জন্যই নয়, শরণার্থী শিবিরগুলোয় ঝুঁকিতে থাকা নেতাদের সুরক্ষা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেই লক্ষ্যেও মি. মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্ত করা প্রয়োজন।

মি. মুহিবুল্লাহর হত্যার ঘটনা মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ বাড়ায়, বক্তব্য সেই আহ্বানও জানান মিজ ব্যাচেলেট।

অন্যদিকে রোহিঙ্গা নেতার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে. ব্লিঙ্কেন এক বিবৃতিতে হত্যাকাণ্ডের ‘পূর্ণ ও স্বচ্ছ’ তদন্ত পরিচালনার আহ্বান জানান।

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মি. মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে এবং ঘটনার বিচার দাবি করে বিবৃতি প্রকাশ করে।

হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আরো দু’জন আটক

মি. মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে শুক্রবার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প থেকে একজনকে আটক করে উখিয়া থানায় হস্তান্তর করেছিল আর্মড পুলিশ ব্যাটলিয়ন, এপিবিএন। এরপর শনিবার ভোররাতে আরো দু’জনকে আটক করা হয়।

এপিবিএন-১৪’র কমান্ডিং অফিসার পুলিশ সুপার নাইমুল হক জানান, “মুহিবুল্লাহ হত্যার পর দু’জন আত্মগোপনে ছিলেন। ভোররাতে তাদের আটকের পর উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এই দুই জনই রোহিঙ্গা এবং তারা শরণার্থী শিবিরে থাকতেন।”

এ নিয়ে মি. মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে মোট তিনজনকে আটক করলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

যেভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নেতা হয়ে উঠেছিলেন মুহিবুল্লাহ

২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়, মি. মুহিবুল্লাহও সেসময়ই বাংলাদেশে এসেছিলেন।

মি. মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারের রাখাইনের প্রদেশের মংডু টাউনশিপের বাসিন্দা।

২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ঐ এলাকায় অভিযান শুরু করার পর প্রাণ রক্ষার্থে তিনি পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন এবং সীমান্ত অতিক্রমের পর আশ্রয় নেন কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্পে।

কক্সবাজারের সাংবাদিক তোফায়েল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, বাস্তুচ্যুত এই রোহিঙ্গাদের জন্য সেসময় একজন গ্রহণযোগ্য নেতার অভাব ছিল। গত কয়েক বছর ধরে সে অভাব পূরণ করেছিলেন মি. মুহিবুল্লাহ।

“তিনি মানুষের সাথে কথা বলতেন খুব গুছিয়ে, মানুষকে বোঝানোর শক্তিটা তার খুব প্রবল ছিল। আরাকানের মূল সমস্যা, রোহ্ঙ্গিাদের জাতিগত সমস্যা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়গুলো সবই তিনি রোহিঙ্গাদের মাঝে বুঝিয়ে বলতে পারতেন।”

রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল যখন বাংলাদেশে আসে, তখন আন্তর্জাতিক সংস্থার যেসব প্রতিনিধি ও কর্মকর্তা রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে গিয়েছিলেন, তখন “তাদের সাথে কথা বলার মত একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন তিনি, এবং তিনি ছিলেন একজন সুবক্তা।”

২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের ফুটবল মাঠে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার গণহত্যাবিরোধী যে মহা সমাবেশ হয়েছিল, তা সংগঠিত করেছিলেন মুহিবুল্লাহ। তার ডাকেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই বিশাল সমাবেশ।

গণহত্যাবিরোধী ওই সমাবেশ বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছিল। ওই সমাবেশের লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয় এবং তাদের মিয়ানমারে ফেরত যাবার ক্ষেত্রে শর্তগুলো বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বক্তব্য রাখার জন্য ২০১৯ সালে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন মি. মুহিবুল্লাহ। সেসময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতের জন্য হোয়াইট হাউসেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাকে।

সূত্র: বিবিসি

Exit mobile version