মোটা অঙ্কের টাকায় ভারতে আশ্রয় নিচ্ছেন বাংলাদেশের ‘প্রভাবশালীরা’
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গ্রেফতারের আতঙ্কে ভুগছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী অনেক এমপি ও রাজনীতিকরা। অনেকেই ইতোমধ্যে বিভিন্ন মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হয়েছেন। এমন অবস্থায় আত্মগোপনে থাকা প্রভাবশালী এমপি ও রাজনীতিকরা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের দুই পাশের সক্রিয় সিন্ডিকেট চক্রের সহায়তায় ভারতে পাড়ি জমাচ্ছেন।
দৈনিক আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মেহেরপুরের উপজেলার এক সংসদ সদস্যের ফোন গিয়েছিল ভারতের কাথুলিবাজার এলাকায় একটি বাড়িতে। দেশের পরিস্থিতি অশান্ত থাকার কারণে স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে কিছু দিনের জন্য ভারতে ‘নিরাপদ আশ্রয়’ চান তিনি।
ওই ফোনের কিছুক্ষণ পরে কাথুলিবাজার থেকে ফোন যায় নদিয়ার করিমপুর-২ ব্লকের রাউতবাটি গ্রামে। কথোপকথন চলে মিনিট পাঁচেক। যিনি আশ্রয় চাইছেন, তার ‘প্রোফাইল’, রাজনৈতিক ঝুঁকি, আর্থিক সঙ্গতি ইত্যাদি সংক্ষেপে জেনে নিয়ে চূড়ান্ত হয় রফা।
বাংলাদেশের ওই সংসদ সদস্যকে জানিয়ে দেয়া হয়, ভারতে প্রবেশ করতে তাকে পরিবারের সদস্যদের মাথাপিছু খরচ পড়বে এক লাখ রুপি করে। তা ছাড়া যতদিন ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ থাকবেন, ততদিন সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের নজর এড়িয়ে থাকার জন্য দিতে হবে মাসিক ১০ লাখ রুপি। খানিক দর কষাকষির পরে ঠিক হয় সীমান্ত পার করাতে দিতে হবে মাথাপিছু ৭০ হাজার রুপি। আর আশ্রয়ের জন্য মাসিক ৫ লাখ রুপি। এতে রাজি হয়ে যান ওই সংসদ সদস্য। গত সোমবার রাতে মেহেরপুর সদর থেকে পরিবারকে নিয়ে রওনা দেন তিনি।
বাংলাদেশের গ্রামে এক দিন অপেক্ষার পর কাথুলি এবং কুলবেড়িয়া হয়ে ‘ফেন্সিংহীন’ পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামে পৌঁছে গিয়েছেন ওই সংসদ সদস্য ও তার পরিবার। বাংলাদেশের মইনুদ্দিন (নাম পরিবর্তিত) এবং পশ্চিমবঙ্গের দেবাংশু (নাম পরিবর্তিত) মিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ‘অপারেশন’ সফল করেছেন।
বাংলাদেশের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এমন অবৈধভাবেই নাকি ভারতে যাচ্ছেন দেশের ‘প্রভাবশালীরা’। তাদের নিরাপদে পৌঁছে দিতে কাজ করছে একাধিক চক্র। কেউ নিচ্ছে মাথাপিছু লাখ রুপি, কেউ ৫০ হাজার। বস্তুত, এই চক্র নিয়ে অবহিত বিএসএফ-ও। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতারও করেছে তারা। চলছে আরও অনুসন্ধান।
বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তৈরি হয়েছে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরোনোর নতুন ‘সিন্ডিকেট’। পারাপার এবং আশ্রয়ের জন্য কেউ খরচ করছেন ২ হাজার রুপি (তারা বেশিদিন থাকছেন না), কাউকে দিতে হচ্ছে ২ লাখ রুপি (বেশিদিন থাকার জন্য)। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আর্থিক সঙ্গতি এবং সামাজিক পরিচিতি বুঝেই টাকা চাওয়া এবং নেয়া হচ্ছে।
কাথুলিবাজার এলাকায় ব্যবসা করেন শেখ নাজিম (নাম পরিবর্তিত)। তার কথায়, আমরা এ সব এলাকা হাতের তালুর মতো চিনি। কোথায় কাঁটাতার আছে, কোথায় নেই, সব মুখস্থ। কোথায় পাচারকারী কাঁটাতার কেটে রেখেছে, সেটাও জানি।
তার কথায়, এই বর্ষায় ভৈরব নদী টইটম্বুর। নদী পুরো খোলা। এ দেশ থেকে যারা ও দেশে (ভারতে) যেতে চাইছে, পরিচিত আর আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে শুধু সীমান্ত পার করিয়ে দিচ্ছি আমরা। বাকি দায়িত্ব ওদের।
পারাপার করাতে কে কত নিচ্ছেন? ব্যবসায়ীর স্বীকারোক্তি, ‘ঝুঁকি দু’পক্ষেরই রয়েছে। তাই টাকার ভাগাভাগিও সমান সমান।
এ পারের দেবাংশু বললেন, কাঁটাতার পার হয়ে আমাদের চাষের জমি আছে। রোজ যাতায়াত করি। ওদিক থেকে বেশ কয়েক জন পরিচিত, আত্মীয়-স্বজনেরা ভারতে আসার জন্য মোটা টাকা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। আমরা শুধু পার করে এখানে নিয়ে এসেছি। রাখার দায়িত্ব আমাদের নয়। সেটা দেখে অন্য লোক।
বিএসএফ, পুলিশের নজর এড়াচ্ছেন কীভাবে?
দেবাংশুর জবাব, বিএসএফ এখন খুব সজাগ। সেটা ঠিক। তবে গ্রামে আমাদের সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক। তাই কাউকে আশ্রয় দিয়েছি জানলে কেউ মুখ খুলবে না।
কিন্তু কাজটা তো অনৈতিক?
যুবক এবার দার্শনিক, ‘ও দেশ থেকে যারা আসছে, তারা তো সত্যিই বিপদে পড়েছে। বিপদে মানুষকে আশ্রয় দেয়া তো মানুষেরই কর্তব্য!
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের ‘ঘনিষ্ঠ’ বা সমর্থকরা এখন বাংলাদেশের আন্দোলনকারীদের নজরে। হাসিনার আমলের অনেক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। তাই যেকোনোভাবে দেশ ছেড়ে আপাতত ওই পারে ঠাঁই নিতে চাইছেন। সেখান থেকেই এই ‘দালাল নির্ভরতা।