ম্রো জনগোষ্ঠীর রেংমিৎচা ভাষা অস্তিত্ব সংকটে
প্রতিনিয়ত ভাষা ও ভাষায় শব্দের ব্যবহার পাল্টে যাচ্ছে। অনেক ভাষা অস্তিত্ব রক্ষায় অন্য ভাষার সাথে মিশে যাচ্ছে। এতে খর্ব হচ্ছে ভাষার স্বাতন্ত্রতা। তেমনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের ম্রো জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র একটি অংশের মাঝে এখনো প্রচলিত ‘রেংমিৎচা’ নামের ভাষাটিও এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ষাটের দশকে রেংমিৎচা ভাষাভাষীদের প্রথম খুঁজে বের করেন জার্মান ভাষাবিদ লরেন্স জি লোফলার। তারপর এ ভাষা নিয়ে আর খুব একটা কাজ হয়নি। মার্কিন গবেষক ডেভিড এ পিটারসন দেড়দশকের অনুসন্ধান শেষে ২০১৫ সালে এ ভাষাভাষির খোঁজ পান বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার তৈনফা মৌজায়।
অনুসন্ধানে প্রকাশ, পুরো বাংলাদেশে ‘রেংমিৎচা’ নামের এ ভাষায় কথা বলেন মাত্র ৬০/৬৫ জন মানুষ। এ ভাষায় কথা বলতে জানেন রেংপুং ম্রো হেডম্যান। তার বয়স এখন সত্তর। তিনি আলীকদম উপজেলার ২৯১নং তৈনফা মৌজার হেডম্যান।
সম্প্রতি ‘রেংমিৎচা’ ভাষার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি পার্বত্যনিউজকে বলেন, তাঁদের মধ্যে বয়োজেষ্ঠ্য মাত্র ৬০/৬৫ জন লোক বর্তমানে পুরোপুরি রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলতে পারেন। তাদের সবার বয়স ষাট কিংবা সত্তরের উর্ধ্বে। তার আশা নতুন প্রজন্মের তরুণরা রেংমিৎচা ভাষাকে আগলে রাখবে, হারিয়ে যেতে দেবে না!
রেংপুং ম্রো হেডম্যান জানান, ১৯৪০ সালের দিকে পার্বত্য আলীকদম এলাকার তৈনখাল তীরবর্তী স্থানে মুরুং বসতি ছিলো। সে সময় ৬/৭ হাজার মুরুং জনগোষ্ঠীর লোকজন রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু কালের গর্ভে এ ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে এ সংখ্যা ৬০/৬৫ জনের বেশি নয়। রেংমিৎচা ভাষা তরুণ প্রজন্মরা শিখবে বলে তিনি আশাবাদী হলেও একই সাথে শঙ্কাও রয়েছে তাঁর। তিনি বলেন, নতুনরা রেংমিৎচা ভাষা না শিখলে তাদের মৃত্যুর পর কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে এই ভাষা!
আলীকদম উপজেলা সদরের একটি বাসায় রেংপুং হেডম্যানের সাথে সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বান্দরবান প্রেসক্লাবের সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম। তাঁর মতে, ‘রেংমিৎচা’ স্বতন্ত্র কোনো ভাষা নাকি ম্রো ভাষার একটি উপভাষা, তা নিয়ে বিশদভাবে কোনো গবেষণা হয়নি। একযুগ আগে একজন ব্রিটিশ গবেষক আলীকদমের তৈনখাল এলাকা ঘুরে এ ভাষা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। পরে বান্দরবান প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি গবেষণার বিষয় তুলে ধরেছিলেন।
সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম মনু আরো জানান, রেংমিৎচা ভাষা নিয়ে গবেষণা বলতে এটিই একমাত্র উদ্যোগ। এর বাইরে রেংমিৎচা ভাষা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাজ শুরু হয়েছে বা চলছে, এমন তথ্যও কেউ জানাতে পারেননি।’
সাক্ষাৎকারে রেংপুং হেডম্যান জানান, রেংমিৎচা ভাষাভাষি লোকজন এতই কম যে, ইচ্ছে করলেও তিনি কিংবা অন্য যাঁরা এ ভাষা জানেন তারা কথা বলতে পারেন না। এ ভাষা জানা লোক এখন হাতে গোনা। তাই নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হলেই কেবল রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলেন তারা। অন্যসময় সকলেই ম্রো ভাষায় কথা বলে থাকেন।
এক প্রশ্নের জবাবে রেংপুং হেডম্যান জানান, তৈনফা মৌজায় বর্তমানে প্রায় ৫০০ ম্রো পরিবার বসবাস করেন। এরমধ্যে সরকারকে খাজনা দেয় ৩০০ পরিবার। ভারতভাগের পূর্বে আলীকদম এলাকাকে ৬টি মৌজায় ভাগ করে ব্রিটিশ সরকার। সে সময় তৈনখালের অববাহিকা ঘিরে গঠিত তৈনফা মৌজার প্রথম হেডম্যান ছিলেন তাঁর নানা তাংলিং ম্রো। তিনি শতভাগ রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলতেন। রেংপুং ম্রোর বাবার নাম উকলিং ম্রো। তিনি পাড়ার কার্বারি (পাড়া প্রধান) ছিলেন। তিনিও রেংমিৎচা ভাষা জানতেন। কথাও বলতো এ ভাষায়। তাংলিং হেডম্যান মারা গেলে নতুন হেডম্যান হন রেংপুং ম্রোর চাচা ইয়াং ইয়ুন ম্রো। তিনিও রেংমিৎচা ভাষাতেই কথা বলতেন।
তিনি জানান, তৈনখাল এলাকার ক্রাংচিপাড়া, পায়া কার্বারিপাড়া ও টিংকু পাড়ায় রেংমিৎচা ভাষাভাষীরা বসবাস করেন। রেংপুং হেডম্যান ছাড়াও মাংপুং ম্রো, তিংওয়াই কার্বারি ও লাউলী ম্রো, রেংমিৎচা ভাষাটি ভালো জানেন। রেংপুং হেডম্যানের বড় মেয়ে কাইতুন ম্রোও এ ভাষায় কথা বলতে পারেন। নতুন প্রজন্মের মধ্যে রেংপুং হেডম্যানের নাতি লাংচিং ম্রো এ ভাষাটি শিখছেন। তিনি বান্দরবান সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত। নবীনরা রেংমিৎচা ভাষা শিখলে এ ভাষা হারিয়ে যাবে না বলে আশাবাদী বয়োবৃদ্ধ রেংপুং হেডম্যান।
রেংপুং হেডম্যান বলেন, রেংমিৎচা এবং ম্রো ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। তবে যারা রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলেন, তারা জাতীতে ম্রো জনগোষ্ঠীর লোক। এরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। ম্রোদের কেউ কেউ বর্তমানে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেও এ পর্যন্ত রেংমিৎচা ভাষাভাষী ম্রোরা বৌদ্ধ ধর্মই পালন করেন। তাদের কেউ ধর্মান্তর হননি।
তিনি আরো বলেন, রেংমিৎচা ভাষার সাথে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী খুমি ও বম জাতিসত্তার কথ্য ভাষার সঙ্গে কিছু কিছু মিল আছে। অনুসন্ধানের জানা গেছে, ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড এ পিটারসন দীর্ঘ ১৬ বছর রেংমিৎচা ভাষাভাষী মানুষ অনুসন্ধান এবং এ ভাষা নিয়ে পুর্ণাঙ্গ গবেষণা আরম্ভ করেন। ২০০৯ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাঁর অনুসন্ধান চলে। এ ধারাবাহিকতায় তিনি বান্দরবান জেলার আলীকদমে রেংমিৎচা ভাষাভাষী ১২ জনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ রেকর্ড করতে সক্ষম হন। ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি বান্দরবান প্রেসক্লাবে রেংমিৎচা ভাষা জানা কয়েকজন ম্রোকে সঙ্গে রেংমিটচা ভাষা পুনরুদ্ধারের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান। সে সময় ওই সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন রেংপুং ম্রো হেডম্যান।
ডেভিড এ পিটারসন সাংবাদিকদের জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের ডকুমেন্টিং এন্ডেনজার্ড ল্যাগুয়েজেস গ্রোগ্রাম ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বান্দরবানের ম্রো জনগোষ্ঠীর পুনরুদ্ধারকৃত রেংমিৎচা ভাষা সংরক্ষণকে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ ভাষার বর্ণমালা, ধারণাপত্র তৈরি ও সর্বক্ষেত্রেই ব্যবহার উপযোগী করার লক্ষ্যে তার গবেষণাকর্ম অব্যাহত থাকার বিষয়ে তিনি বলেছিলেন।