parbattanews

‘যে সংস্কৃতি বেশি মানুষের কাছে পৌঁছবে সে সংস্কৃতি তত শক্তিশালী হবে’

যে সংস্কৃতি বেশি মানুষের কাছে পৌঁছবে সে সংস্কৃতি তত শক্তিশালী হবে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। শুক্রবার (১৭ জুন) পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়ুয়া জুম্ম শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ’আয়োজিত ঢাবির টিএসসি প্রাঙ্গনে জুম ম্যাগাজিন প্রকাশনা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উৎসবে প্রধান অথিতির বক্তৃায় তিনি এ কথা বলেন।

তিনি আরো বলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মূল্যবোধে যখন কোন কিছুকে আবদ্ধ করা হয় তখন সেটা স্থায়িত্ব অনেক বেশি হয়। সে জন্য আমরা বলি, আবহমানকালের সংস্কৃতি, যার অর্থ দাঁড়ায় অনেক সময় হতে চলে আসছে, নতুন কোনো বিষয় নয়। যা বহু মানুষ গ্রহণ করে উপকৃত হয়েছে। উপকৃত না হলে সেটাকে তারা বর্জন করতো।

এ সময় অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে ছিলেন, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সমন্বয়ক এবং ঢাবির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাবির জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা, অধ্যাপক বাঞ্ছিতা চাকমা
সাবেক সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি আরো বলেন, মুসলিম বা হিন্দু যেই হোন না কেন কারো মাঝে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাম্প থাকলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সেটাকে প্রতিরোধ করতেন। কারাগারের রোজনামচাসহ বঙ্গবন্ধুর অনেক লেখা ও বক্তৃতায় আমরা দেখি, যেখানে সামান্য সাম্প্রদায়িকতার বিষবাম্প ছিল সেখানেই তিনি বেঁকে বসেছেন, ছাত্রজীবন থেকেই প্রতিবাদী ছিলেন। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধেও সেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাম্প দেখে প্রতিবাদী হন এবং দেশ স্বাধীনের কাজ ত্বরান্বিত করেন। সেই বাংলাদেশে আমরা অসাম্প্রদায়িক অবস্থা দেখতে চাই। সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার সম্বয়ে পাহাড়ে যাতে সকলে মিলেমিশে বসবাস করতে পারে সে জন্য ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তি করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূল উদ্দেশ্য একটাই, পাহাড়ে বা সমতলে সবখানে প্রতিটি মানুষ যেন তার নিজ নিজ ধর্ম, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করে বসবাস করতে পারে।

তিনি আরো বলেন, আমরা ক্লাসে আলোচনা করি যে, আমাদের সবচেয়ে বেশি অসাম্প্রদায়িক হতে হবে। ঢাবি স্বাধীন মত প্রকাশের পাশাপাশি সকল জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত আঙ্গিনা। টিএসসিতে প্রায় ৫৬টি সংগঠন আছে, যেখানে সকল শ্রেণিপেশা, জাতি, ধর্ম ও মতের শিক্ষার্থীরা রয়েছে। পাহাড়িদের সাথে আমাদের সম্পর্ক কীভাবে জোরদার করা যায় সেটা নিয়েও ভাবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদের সদস্যদের সরল হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরলতার দাম অনেক, সরলতা বড় সম্পদ। যার মাধ্যমে সৃজনশীলতা বের হয়ে আসে, যে কোন অর্জনে তারা তীক্ষ্ন নজর দেয়। কবিতা আবৃত্তি, গান ইত্যাদি সৃজনশীল কাজের অন্যতম। দুষ্ট বুদ্ধি বা কূট বুদ্ধির লোকের মাধ্যমে কোন উন্নয়ন হয় না। তাদের সরলতাকে আমি সাধুবাদ জানাই।

সম্মানিত অতিথি মেজবাহ কামাল বলেন, ঐতিহ্যগত জুম শব্দটি ধারণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পার্বত্য অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা যে জুম সাহিত্য ও প্রকাশনা সংসদের কাজ করছে, এটা ভালো উদ্যোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে বৈচিত্র্য, যে বহুত্ব ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালনের প্রাণকেন্দ্র। মুক্ত চিন্তা লালিত হয়, ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিপুষ্ট হয় সাংস্কৃতিক ও রাজনীতির মধ্য দিয়ে। মুক্তির সাথে বহুত্বের সম্পর্ক আছে। পুরো বিশ্বের সকল দেশই বহু ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সংস্কৃতি ও ভাষার দেশ। সেই বাস্তবতার স্বীকৃতি যত দ্রুত দেয়া সম্ভব হবে ততই পৃথিবী গণতান্ত্রিক হবে। বাঙ্গালি হচ্ছে মিশ্র জাতি, ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষাভাষীর দেশ। আমাদের লক্ষ হচ্ছে সবাইকে ধারণ করা। দেশের সাগগ্রিক এগিয়ে যাওয়াতে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীসহ সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতির অবদান রয়েছে।

তিনি বহুত্ববাদিতার উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন। এই যে মাকে মা বলে ডাকি, এই মা শব্দ কিন্তু এসেছে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মুন্ডা জাতি থেকে। তেমনিভাবে আমাদের সংস্কৃতি নানান উত্তরাধিকারী থেকে এসে শক্তিশালী হয়েছে। আপনারা আপনাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ধারণ করবার, বিকশিত করবার ও সমন্বয় করবার উদ্যোগ ও আয়োজন খুব চমৎকার। আপনারা যে মাদল কনসার্ট করতে যাচ্ছেন সেটা কিন্তু সমতল লোকেরাই শুরু করেছিল, সেটা গ্রহণের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতার প্রমাণ মিলে। এটা পাহাড়ি এবং সমতলের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন রচনা করছে, যার ফলে দেশটাকে গণতান্ত্রিকরূপে গড়ে তুলবে।

জুম ম্যাগাজিন বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রছাত্রীদের একটা চমৎকার উদ্যোগ এ ম্যাগাজিন। এর মধ্যে সৃষ্টি আছে, ক্ষোভ আছে, বিকলাঙ্গ চিন্তা আছে এবং এসবের মাধ্যমেই কিন্তু আমরা আমাদের দেশটাকে সমৃদ্ধ করি। টিএসসি মিলনায়তে এমন দারুণ অনুষ্ঠান হওয়ায় আমরা অনুপ্রাণিত । আমি আশা করব, আপনাদের উদ্যোগের মাধ্যমে আপনাদের নিজ নিজ ভাষা পরিশিলিত হবে, বিকশিত হবে এবং সংস্কৃতি লালিত হবে। এই সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নেতৃত্ব এবং আগামী দিনে পাহাড়ি নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বিষয়ে স্বীয় গবেষণা নিয়ে তিনি বলেন, প্রায় ৪৩টি ভাষায় প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ভাষাগত বিভিন্নতা এখানে অনেক। আমরা ৭৮টি জাতিকে আমরা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছি। সেখান থেকে ৫০টি জাতিকে ২০১৯ সালের শেষের দিকে সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে।

জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. মিহির লাল সাহা বলেন, আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে যে পরিবর্তন আসছে, জুম সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ যে বইটি বের করেছে, তার মধ্যেই শান্তির প্রতীক নিহিত আছে। এর মাধ্যমে আমরা বুঝাতে চাই যে আমরা যুদ্ধ-হানাহানি চাই না, শান্তি চাই। একটা দেশে নানান ধর্ম, বর্ণ ও জাতি থাকবে এটাই দেশের ঐতিহ্য। জাপানের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একটা দেশে যত বেশি ধরনের সংস্কৃতি থাকবে, সেই দেশ তত উন্নত। কে পাহাড়ে আছে , কে সমতলে আছে, কার ভাষা কী এগুলো বড় বিষয় নয়, সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা বাংলাদেশকে সামনের দিকের এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। আলোকিত মানুষ তৈরি করতে চাই। অনুষ্ঠান করার জন্য এখানে যত ধরনের সুযোগ দরকার সব ধরনের সুবিধা তোমাদের প্রদান করা হবে।

রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ বাঞ্চিতা চাকমা বলেন, আমি যখন কলেজের শিক্ষক ছিলাম তখন এ ধরনের ম্যাগাজিন পেতাম এবং নিয়মিত খোঁজ রাখতাম, তারা নিয়মিত প্রকাশ করে কি না। তোমরা যে জুম ম্যাগাজিন প্রকাশনা করছো, এটা বিশাল একটা কাজ। সুখ, দুঃখের প্লাটফরম করেছ, যেখানে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের কী হচ্ছে, কেমন আছে তা তুলে ধরা যাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, আজ জানলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৩-৪ শ’র মতো। পার্বত্য অঞ্চল থেকে যারা এখানে এসে পড়ে তারা কঠিন বিষয়ে পড়েও টিউশনি করানোসহ খুবই সংগ্রামের মাধ্যমে পড়াশোনা করে। আজকের তরুণরা সচেতন বলেই সাহিত্য চর্চা করছে, ম্যাগাজিন প্রকাশ করছে , অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তারা লিখছে। অনেকসময় শীতকালে শীতবস্ত্র বিতরণ, পানির তীব্র সংকট দূরীকরণসহ নানামুখী উদ্যোগের প্রশংসা করে তিনি বলেন, তারা আসলেই সচেতন । আমি জানি না, বাঙ্গালি ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের মাঝে কতখানি বোঝাপড়া আছে, সুসম্পর্ক আছে। তবে সবাই মিলে বৈচিত্র্যতায় বসবাস করাটাই আমাদের চাওয়া।

আরো উপস্থিত ছিলেন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বিষয়ক গবেষক হানা শামস, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ ও অভ্যুদয়ের ইতিহাস বিষয়ক অধ্যাপক সুস্মিতা বৃষ্টি, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের শিক্ষক এবং জুম সাহিত্য ও ম্যাগাজিন পরিবারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ও সদস্যরা।

Exit mobile version