রাখাইন হয়ে ভারত কি সেভেন সিস্টারসে পণ্য বহন করতে পারবে?

fec-image

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সিত্তে বন্দরটি, ভারতের কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের (কেএমটিটিপি) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই অঞ্চলে চলমান সংঘাত ও অস্থিরতার কারণে প্রকল্পটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।

এর মধ্যেই ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের সমুদ্রপথ এড়িয়ে সিত্তে বন্দর ও কেএমটিটিপি প্রকল্পের অধীন সড়ক ব্যবহার করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাতে জানা যাচ্ছে, কেন্দ্র সরকার সম্প্রতি মেঘালয়ের শিলংকে আসামের শিলচরের সঙ্গে সংযোগকারী ১৬৬ দশমিক ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নতুন উচ্চ-গতির করিডরের অনুমোদন দিয়েছে।

এই প্রকল্পটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দুটি রাজ্যের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে গতি সঞ্চারই শুধু করবে না, এটি মিয়ানমারে মাল্টি-মোডাল পরিবহন প্রকল্পের সম্প্রসারণ হিসেবেও কাজ করবে।

কালাদান মাল্টি মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টটি ভারত ও মিয়ানমারের যৌথ উদ্যোগ। এটি কলকাতা সমুদ্রবন্দরকে রাখাইন রাজ্যের কালাদান নদীর সিত্তে বন্দরের সঙ্গে যুক্ত করে। সিত্তে বন্দরটি একটি অভ্যন্তরীণ জলপথের মাধ্যমে মিয়ানমারের পালেতোয়ার সঙ্গে এবং একটি সড়ক পথের মাধ্যমে মিজোরামের জোরিনপুইয়ের সঙ্গে যুক্ত।

ভারতের প্রস্তাবিত চার লেনের শিলং-শিলচর মহাসড়কটি এনএইচ-৬ (মেঘালয়, আসাম ও মিজোরামকে সংযোগকারী মহাসড়ক) ধরে মওলিনখুং (মেঘালয়) থেকে পঞ্চগ্রাম (আসাম) পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।

এটিই এই অঞ্চলের প্রথম উচ্চ-গতির করিডর প্রকল্প। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুসারে, শিলং-শিলচর মহাসড়কটি মিয়ানমারের কালাদান প্রকল্পের সম্প্রসারণ। ফলস্বরূপ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে কলকাতার সঙ্গে সংযোগকারী একটি বিকল্প সমুদ্র পথ তৈরি হবে।

রাখাইনে সিত্তে বন্দরটি চালু হয় ২০২৩ সালের মে মাসে। বন্দরটিতে এরই মধ্যে খাদ্য, কৃষি পণ্য, ওষুধ, জ্বালানি, যানবাহন এবং নির্মাণ সামগ্রীসহ ১ লাখ ৯ হাজার টনেরও বেশি পণ্য খালাস হয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত, এখানে ১৫০ টিরও বেশি জাহাজ যাতায়াত করেছে। এটিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের অন্যতম সংযোগ হিসেবে দেখছে ভারত।

২০২২ সালের জুনে সিত্তে বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর সরাসরি পণ্য পরিবহনের একটি উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের অনাগ্রহেই সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীতে অবশ্য পুরো মিয়ানমারই অস্থির হয়ে উঠেছে।

ভারত পোর্টস গ্লোবাল লিমিটেড (আইপিজিএল)-এর মাধ্যমে ২০২৪ সালের এপ্রিলে সিত্তে বন্দর পরিচালনার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পায় ভারত সরকার। ইরানের চাবাহার বন্দরের পর ভারতের দ্বিতীয় বৈদেশিক বন্দর এটি।

এ ছাড়া বন্দরটি ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নীতির প্রধান লক্ষ্য আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধি করা এবং চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর মোকাবিলা।

এই যোগাযোগ প্রকল্প দ্রুত এবং সাশ্রয়ী বাণিজ্য পথ তৈরি করতে পারে। কলকাতা থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বে (যেমন, আগরতলা) সড়কপথে চার দিনের ভ্রমণ সময় মাল্টিমোডাল পরিবহনের মাধ্যমে দুই দিনে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

তবে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের কারণে সিত্তে বন্দরের কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়েছে। আরাকান আর্মি সিত্তেসহ রাখাইনের বেশির ভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। বন্দরের দিকে যাওয়া প্রধান সড়ক ও জলপথের সংযোগ তারা এরই মধ্যে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারা সিত্তেকে এই অঞ্চলের শেষ সামরিক ঘাঁটিগুলোর মধ্যে একটিতে পরিণত করেছে।

এতে ভারত নিয়ন্ত্রিত বন্দরটির কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে, ভারত ২০২৪ সালের এপ্রিলে সিত্তে থেকে কনস্যুলেট কর্মীদের ইয়াঙ্গুনে সরিয়ে নিয়েছে।

রাখাইনে তীব্র লড়াই সত্ত্বেও, সিত্তে বন্দরটি ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ১০০ তম জাহাজকে স্বাগত জানায়। জাহাজটিতে ২ হাজার ২০০ টন সিমেন্ট ছিল।

তবে, সিত্তেতে আর্টিলারি শেলিং (যেমন, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি একটি বাজারে ১২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন)-সহ চলমান গৃহযুদ্ধ কার্যক্রম ব্যাহত করেছে। হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। কেএমটিটিপির একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল পালেতোয়ার দখলসহ আরাকান আর্মির অগ্রগতি, প্রকল্পের মাল্টিমোডাল সংযোগকে আরও জটিল করে তুলেছে।

এদিকে ইরাবতী জানিয়েছে, মিয়ানমারে বন্দর প্রকল্প থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে জাপানের তিনটি কোম্পানি। ইয়াঙ্গুনের থানলিন টাউনশিপে অবস্থিত থিলাওয়া মাল্টিপারপাস ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল প্রকল্পে তাদের কাজ করার কথা ছিল।

ইরাবতী আরও জানিয়েছে, মান্দালয় অঞ্চলে নাতোগি, তাউং থা, মেইনগ্যান ও নাগাজুন শহরতলিতে চীনের একটি তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের নিরাপত্তা পাহারায় নিয়োজিত জান্তা সেনাদের ওপর হামলা চালায় বেশ কয়েকটি প্রতিরোধ গোষ্ঠী। গত বৃহস্পতিবার আটটি প্রতিরোধ বাহিনী একযোগে হামলার পর জান্তা বাহিনী পালিয়ে গেছে।

এর আগে একাধিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মিকে সম্ভবত চীন পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। বেইজিংয়ের সমর্থনে তারা এই অঞ্চলে ভারতের কৌশলগত স্বার্থ ক্ষুণ্ন করার লক্ষ্যে কাজ করছে। সিত্তে বন্দরের ভবিষ্যৎ এখন মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভর করছে।

রাখাইন রাজ্যে বেইজিংয়ের আগ্রহ মূলত চীন-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডরের (সিএমইসি) ওপর কেন্দ্রীভূত। এটি চীনের বেল অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) মূল অংশ।

এর মধ্যে রয়েছে কিয়াউকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দর এবং রাখাইন থেকে ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত তেল ও গ্যাসের দ্বৈত পাইপলাইন। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে মালাক্কা প্রণালিকে এড়াতে পারবে চীন। চীনের জ্বালানি আমদানির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা এই মালাক্কা প্রণালি।

চীন ও আরাকান আর্মির অম্ল-মধুর সম্পর্ক, কার নিয়ন্ত্রণে রাখাইন রাজ্যচীন ও আরাকান আর্মির অম্ল-মধুর সম্পর্ক, কার নিয়ন্ত্রণে রাখাইন রাজ্য

রাখাইনের স্থিতিশীলতা এই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পগুলোর জন্য অত্যাবশ্যক। এসব প্রকল্প চীনের বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার এবং আঞ্চলিক প্রভাব বাড়াতে সহায়তা করবে।

চলতি বছর আরাকান আর্মি রাখাইনের বেশির ভাগ এলাকা, বিশেষ করে কিয়াউকফিউয়ের কাছাকাছি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ফলে এই অঞ্চলে চীনের স্বার্থগুলো সরাসরি প্রভাবিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মিকে চীনের মিয়ানমার কৌশলে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় করে তুলেছে।

এর মধ্যে গত ২৮ মার্চ ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে মান্দালয় ও নেপিডো ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর সরাসরি প্রভাব সিত্তে বন্দরের ওপর পড়ার কোনো প্রমাণ নেই। তবে, এ ধরনের ঘটনা থেকে আঞ্চলিক অস্থিরতা লজিস্টিকস ও অবকাঠামোকে আরও চাপে ফেলতে পারে।

ফলে সিত্তে বন্দর ভারতের আঞ্চলিক কৌশলের একটি ভিত্তিস্তম্ভ হলেও, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার ওপর আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণের কারণে এর কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত বন্দরের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো কঠিন।

সূত্র : আজকের পত্রিকা

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ভারত, রাখাইন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন