স্টাফ রিপোর্টার:
রাঙামাটির নানিয়ারচরের আনারস বাগান ও সেগুন বাগান ধ্বংস করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় উপজাতি-বাঙালীদের মধ্যে সহিংসতা ও উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এ সময় দুর্বৃত্তদের অগ্নিসংযোগে দোকানসহ ১৩টি ঘর পুড়ে যায়। এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতংক, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এ ঘটনায় স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালি উভয়ের মাঝে বিরাজ করছে চাপা উত্তেজনা। তবে জেলা, উপজেলা, পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনীর তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলেও এলাকায় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এ ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার থেকেই রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণা করেছে ইউপিডিএফ সমর্থিত সংগঠন ভুমি রক্ষা কমিটি। মঙ্গলবার নানিয়াচর ভূমি রক্ষা কমিটিা সদস্য সচিব সেন্টু চাকমা স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমকে দেওয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
পুলিশ, প্রশাসন ও স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, সোমবার মধ্যরাতে ওই এলাকার বগাছড়ির তরুনীপাড়া এলাকায় বাঙালিদের প্রায় পনের একর আনারস বাগানের সাড়ে ৪ লাখ ফলন্ত আনারসের গাছ এবং একটি নতুন সেগুন বাগানের কয়েক হাজার সেগুন চারা কেটে ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। ভোরে আনারস বাগানের মালিক নুরুল ইসলাম, মো. আসাদ, কামাল হোসেন, জামাল হোসেন এবং সেগুন বাগানের মালিক আবছার মাস্টার বাগানে গিয়ে দেখতে পান নিজেদের বাগানের ধ্বংসাবশেষ। তাদের অভিযোগ পাশের গ্রামের পাহাড়িরাই রাতের আঁধারে তাদের বাগানের গাছগুলো কেটে ফেলে ধ্বংস করে দিয়েছে। ওই আনারস ও সেগুন বাগান কেটে ফেলার ঘটনাকে ঘিরে কুতুকছড়ি ইউনিয়নের বগাছড়ি এলাকার বাঙালিদের মাঝে ব্যাপক আকারে চরম ক্ষোভ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এর এক পর্যায়ে মঙ্গলবার সকাল পৌণে আটটার দিকে দলবদ্ধভাবে ক্ষুব্ধ বাঙালিরা বিক্ষোভ শুরু করে। অন্যদিকে দুর্বৃত্তরা পাশের তিনটি পাহাড়ি গ্রাম বগাছড়ি, ছড়িদাশ পাড়া ও নবীন তালুকদার পাড়ায় দোকানপাট ও বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। অগ্নিসংযোগে পাহাড়িদের বাড়িঘর ও দোকানপাট পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এসময় বাঙালীদেরও কয়েকটি ঘর পুড়তে দেখা গেছে। পাহাড়ীদের অভিযোগ এ সময় বুড়িঘাট ইউনিয়নের সুরিদাসপাড়া এলাকার “করুণা বিহার” নামের একটি বৌদ্ধ বিহারে ব্যাপক হামলা চালায় হামলাকারীরা। তবে কে বা কারা এ অগ্নিসংযোগ করেছে তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থল ছুটে যান রাঙ্গামাটির এডিশনাল এসপি গোয়েন্দা) আবুল কালাম আজাদ। তিনি জানান, ঘটনাস্থল পৌঁছেই পাহাড়ি-বাঙালি উভয়কে শান্ত করার চেষ্টা করেন। ফায়ার সার্ভিসের লোকজনকে খবর দিয়ে নিয়ে গিয়ে আগুন নেভানো হয়। এসময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষে বেশকয়েকজন বাঙালী আহত হন বলে জানা গেছে। এর পরপরই ছুটে যান জেলা প্রশাসক মো. মোস্তফা কামাল, পুলিম সুপার আমেনা বেগম, নানিয়ারচর জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সোহেল, নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান, নানিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবদুর রশীদসহ বিভিন্ন স্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। ওই সময় বুড়িঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রমোদ বিকাশ খীসা, ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অমর জীবন চাকমা, নানিয়ারচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ত্রিদিব কান্তি দাশ, উপজেলা বিএনপির সভাপতি এজাজ নবী রেজাসহ স্থানীয় নেতারা।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ছড়িদাশ পাড়ায় অনুষ্ঠিত এক সংক্ষিপ্ত শান্তি সমাবেশে জেলা প্রশাসক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, পাহাড়ি বাঙালি উভয়ে শান্তি-সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করে পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক রাখতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সবার সহনশীল ও ধৈর্যশীল মনোভাব। পাহাড়ি বাঙালি বলে কেউ উত্তেজনাকর কথা ছড়াবেন না। ক্ষতি যাই হয়েছে আর যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে সবার সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
তিনি নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমার নেতৃত্বে ১১ সদসস্যের একটি সম্প্রীতি কমিটি ঘোষণা করেন। ওই কমিটিকে সামাজিকভাবে সৌহার্দ্য পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আহবান জানান।
জেলা প্রশাসক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেবে সরকার। জেলা প্রশাসক প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে এক লাখ টাকা নগদ, পরিবার প্রতি ২টি করে কম্বল ও এক বান্ডিল করে ঢেউটিন বিতরণ করেন। অপরদিকে ক্ষতিগ্রস্ত আনারস ও সেগুন বাগানের মালিকদের কৃষি প্রকল্পে পুনর্বাসন করা হবে বলে ঘোষণা দেন তিনি।
পুলিশ সুপার আমেনা বেগম বলেন, উভয় ঘটনায় মামলা রুজু করা হবে। গোয়েন্দা তদন্তের মাধ্যমে ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। যেভাবেই হোক দুস্কৃতিকারীদের প্রতিহত করা হবে।
উল্লেখ্য, নানিয়ারচর উপজেলা থেকে বাঙালী উচ্ছেদের দাবীতে ২০০৮ ও ২০০৯ সালসহ বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকবার স্থানীয় বাঙ্গালীদের চাষকৃত কয়েকশ একর আনারস বাগান বিস্ফোরক পাউডার ছিটিয়ে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে এবং চারা তুলে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল স্থানীয় পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা।
এদিকে নানিয়ার চরে বাঙালীদের আনারস ও সেগুনবাগান কর্তন, বাড়ী ঘরে অগ্নি সংযোগের ঘটনার পার্বত্য নাগরিক পরিষদের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আলকাস আল মামুন ভুইয়া টেলিফোনে পার্বত্যনিউজকে জানান, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পাহাড়ী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো ১৯৭১ সালের মতো এখনো বাঙালীদের স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস মেনে নিতে পারেনি। তাই বিজয় দিবসের প্রাক্কালে জাতির দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে, বিজয় দিবসকে কলঙ্কিত করতে পরিকল্পিতভাবেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
সমঅধিকার আন্দোলনের মহাসচিব মনিরুজ্জামান মনির পার্বত্যনিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা নানিয়ারচর থেকে বাঙালী উচ্ছেদে পরিকল্পিতভাবে নানা অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। অতীতের একাধিকবার এখানে বাঙালী ফসল, সম্পদের উপর আঘাত হেনেছে পাহাড়ীরা। এ ঘটনা তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। এবারে তারা এরসাথে বিজয় দিবসের গৌরব মলিন করতে চেয়েছে। তারা নিজেরা কোথাও বিজয় দিবস পালন করে না। তাই বাঙালীর বিজয় দিবসকে বিতর্কিত করতে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। নেতৃবৃন্দ এ ঘটনায় জড়িতদের অবিলম্বে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালীদের চিকিৎসাসহ পুনর্বাসন সহায়তা দেয়ার দাবী জানিয়েছে।