parbattanews

রাতে আতঙ্কের জনপদ হয়ে ওঠে রোহিঙ্গা ক্যাম্প

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেশ কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনার জের ধরে স্থানীয় সচেতন মহল সহ দেশি-বিদেশি লোকজনকে ভাবিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে রাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যান্তরে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় হওয়ায় ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে নানান মন্তব্য স্থানীয়দের। তাদের দাবি এসব নিয়ন্ত্রণ করা না হলে বিদেশি দাতা সংস্থা রোহিঙ্গাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন সুশীল সমাজের লোকজন।

জানা গেছে, প্রতিদিন বিকেল ৫টার পর থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যান্তরে বহিরাগত লোকজন প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছে প্রশাসন। কিন্তু ওই সময় ক্যাম্পের পুরো নিয়ন্ত্রণে থাকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কতিপয় সন্ত্রাসী গ্রুপ। পুলিশ উখিয়ার রোহিঙ্গা বিভিন্ন ক্যাম্পে ৫টি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করলেও রাতের বেলায় তারাও অসহায় হয়ে পড়ে। যার ফলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ রেপরোয়া ভাবে রাতে চলাচল করে থাকে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

রোহিঙ্গাদের নেতা ছিলেন আরিফ উল্লাহ (৩৮)। সে উখিয়ার বালুখালী-২ ক্যাম্পের হেড মাঝি ছিল। গত ২০১৮সালের ১৮ জুন রাতের আঁধারে তাকে গলা কেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তার পরিবারের সদস্যরা ভয়ে পালিয়ে গেছে টেকনাফের লেদায়। উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের আরেক শীর্ষ মাঝি আবু ছিদ্দিক। ক্যাম্পের ভেতরেই তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মৃতভেবে বীরদর্পে চলে যায় সন্ত্রাসী বাহিনী। পরে তাকে উদ্ধার করে নেওয়া হয় হাসপাতালে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা দিয়ে তাকে বাঁচানো যায়নি জুন মাসে তার মৃত্যু হয় কুতুপালং ঝুপড়িতে।

বালুখালী ক্যাম্পের ডি ব্লকের নুর আলম (৪৫), মো. খালেক (২২) ও কুতুপালং ই-ব্লকের মো. আনোয়ারকে (৩৩) ধরে নিয়ে যায় সন্ত্রাসী বাহিনী। পরের দিন হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পারিয়াপাড়ার পাহাড়ি এলাকা থেকে গলাকাটা অবস্থায় উদ্ধার করা হয় এই তিন রোহিঙ্গাকে। উখিয়ার এমএসএফ ফিল্ড হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে দুইজন সুস্থ হয়ে উঠলেও মারা গেছেন আনোয়ার। যে দুইজন বেঁচে আছেন আতঙ্কে তারাও ক্যাম্প ছেড়ে অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে গেছেন।

২০১৭ সালের ২৯ অক্টোবর বালুখালী ১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যশোর থেকে আসা নলকূপ মিস্ত্রিদের উপর হামলা চালিয়ে চারজনকে রক্তাক্ত জখম করেন। তাদেরকে ছেলে ধরার গুজব ছড়িয়ে রোহিঙ্গারা হামলা চালায়। পরে পুলিশ তাদেরকে মুমূর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করেন।

সর্বশেষ গত ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি বালুখালী ক্যাম্পের মো. রফিক ও মো. আলমের লাশ উদ্ধার করে তার স্বজনরা। তৎমধ্যে মো. রফিকের লাশ উদ্ধার করা হয় টেকনাফের চাকমারকূল রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অদুরে গভীর জঙ্গল থেকে। আর মো. আলমের লাশ উদ্ধার করা হয় বালুখালী থেকে।

স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করে জানান, লম্বাশিয়া ও মধুরছড়া ক্যাম্পের হেড মাঝি জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে কয়েক’শ রোহিঙ্গা যেকোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়ে ক্যাম্পের পরিবেশ অস্থিতিশীল করে তুলার চেষ্টা লিপ্ত থাকে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মধুরছড়া ক্যাম্পের পাশে স্থানীয় দিলদার আলম ও আনোয়ারের বাড়িতে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হামলা চালিয়ে তাকে গুরুতর আহত করে। এভাবে প্রতিনিয়ত ছোট-খাটো ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন ক্যাম্পে।

এছাড়াও গুজব ছড়িয়ে রোহিঙ্গারা ৩জন জার্মান সাংবাদিকদের উপর হামলা চালিয়ে গুরুতর আহত করেন। এরা হলেন- ইয়োরিকো লিওবি (৪৪), এস্টিপেইন্স এ্যাপল (৪৯) ও গ্রার্ডার স্টেইনার (৬১)।

এসময় আরো আহত হন তাদের দোভাষী মোঃ সিহাবউদ্দিন (৪১) গাড়ী চালক নবীউল আলম (৩০)। এবং একজন পুলিশ সসদ্য জাকির হোসেন (৩৩)। এরপর থেকে অনেকে মন্তব্য করতে দেখা গেছে, এমন পরিস্থিতির শিকার হলে হয়তো আগামী বিদেশি ভিআইপিরা ক্যাম্প পরিদর্শনের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়তে পারে। এর ফলে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় মারাত্মক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

কুতুপালং ক্যাম্পের অদূরে নৌকার মাঠ এলাকায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের বেশ কিছু ছবি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেলে আরো আতঙ্ক সৃষ্টি হয় সাধারণ রোহিঙ্গা ও রোহিঙ্গা সেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন এনজিও সংস্থা এবং স্থানীয়দের মাঝে।

উখিয়া ও টেকনাফে ৩০টি ক্যাম্পে এখন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। সূত্র মতে, প্রতি ক্যাম্পে একজন করে হেড মাঝির অধীনে ৪ শতাধিক মাঝির মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা চলছে। ত্রাণ তৎপরতাও চালানো হচ্ছে তাদের সহযোগিতায়। তবে বিশাল এই ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ মাঝি ও হেড মাঝিদের হাতে যেমন নেই, তেমনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও এখানে অসহায়।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝিদের সন্ত্রাসী গ্রুপের নির্দেশ মতো চলতে হয়। নিয়মিতভাবে তাদের দিতে হয় চাঁদা। তাদের কথার হেরফের হলেই গলায় ছুরি চালানো হয়। কুপিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে দেওয়া হয়। সূত্র জানায়, সন্ত্রাসী গ্রপগুলোর অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অনেক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। ক্যাম্পে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক রোহিঙ্গা জানান, সন্ত্রাসী গ্রুপের চাহিদা মতো চাঁদার টাকা না দিলে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও তাদের কাছে অসহায়। এই পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা অন্যান্য রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর হাতে খুন, ঘুম হয়েছে বলে রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গারা নানা অপরাধ করলেও তাদের পুলিশে দেওয়া যায় না। বিশাল ক্যাম্পে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘দিনের বেলায় যেমন তেমন, রাত নামলেই রোহিঙ্গা ক্যাম্প যেন এক আতঙ্কের জনপদ।’তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এমন পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলে ভবিষ্যতে চরম মাশুল দিতে হবে সরকার এবং স্থানীয়দের।

উখিয়ার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল খায়ের জানান, রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পে অভ্যান্তরে ৫টি পুলিশ ক্যাম্প এবং ৩শতাধিক পুলিশ সদস্য নিয়োজিত থাকলেও অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তাদেরকেও হিমশিম খেতে হয়। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

Exit mobile version