রামগড়ে শান্তিবাহিনীর গণহত্যার শিকার বাঙালিদের গণকবর সংরক্ষণের দাবি
১৯৮৬ সালে খাগড়াছড়ির রামগড়ে তৎকালীন শান্তিবাহিনীর নির্মম ও নৃশংস গণহত্যার শিকার নিরীহ বাঙ্গালীদের তালিকা প্রণয়ন, গণকবরগুলো সংরক্ষণ, নিহতের পরিবারদের ক্ষতিপূরণ এবং নিজস্ব বাস্তুভিটায় পুনর্বাসনের দাবি উঠেছে। দীর্ঘ প্রায় ৩৪ বছর ধরে সেদিনের বিভীষিকাময় স্মৃতি বুকে লালন করছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। স্বজনহারা পরিবারগুলো সেই বিভৎসতার কথা মনে হলে এখনও ভয়ে আঁতকে ওঠেন।
রামগড় উপজেলা সদর ছাড়াও চিনছড়ি পাড়া, খাগড়াবিল, পাতাছড়া, হাফছড়ি(বর্তমান গুইমারা উপজেলাধীন)সহ বিভিন্ন স্থানেই গণহত্যার শিকার হন অসংখ্য নিরীহ বাঙ্গালী।
১৯৮৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর শান্তিবাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কথা মনে পড়লে আজও ভয়ে আঁতকে ওঠেন পাতাছড়ার ডাকবাংলা পাড়ার বাসিন্দারা। শান্তিবাহিনীর একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসীর এলোপাতাড়ি গুলি ও অগ্নিসংযোগে সেদিন নিহত হয়েছিল ৫ শিশুসহ ৭ জন। কয়েকদিন পর ঘটনাস্থলের খুব কাছ থেকে আরও একজনের মরদেহ উদ্ধার করেছিল স্থানীয়রা। একই বছরের ১৩ আগস্ট আরও এক নিরীহ গ্রামবাসীকে গুম করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। প্রথমদিনের ঘটনায় নিহতদের গণকবরে ঠাঁই হলেও পরবর্তীতে নিহতদের কপালে তাও জুটেনি।
নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর পরপর এমন হামলায় ভয়ে পালিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল ২ শতাধিক পরিবার। কয়েক বছর পর নিজেদের বাস্তুভিটায় ফেরার চেষ্টা করলেও তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রশাসন ফিরতে দেয়নি। আর ৩৪ বছরেও ফেরা হয়নি। ১৭ ডিসেম্বর ১নং রামগড় ইউনিয়নের চিনছড়িপাড়া গ্রামে মা, বাবা ও দুই ভাই বোনকে জবাই করে হত্যার রোমহষর্ক স্মৃতি বুকে ধারণ করে আছেন আব্দুল মালেক। তিনি এবং তার এক বোন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন সেদিন। নিহতদের গণকবর দেয়া হয় ঐ এলাকার একটি কবরস্থানে।
একই বছর ২২ ডিসেম্বর রাতে রামগড় বাজার, সিনেমা হল , দারোগাপাড়া, মহামুনি, ফেনীরকুল, সোনাইপুল এলাকায় হত্যা, অগ্নিসংযোগের ভয়াবহ ঘটনার কথা ভুলতে পারেনি কেউ। শান্তিবাহিনীর সেদিনের নারকীয় হামলায় সরকারি হিসেবে ২২জন নিরীহ বাঙ্গালী মারা যায়। অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়া হয় অসংখ্য ঘরবাড়ি, দোকানপাট।
১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর আরেক নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় রামগড় ইউনিয়নের খাগড়াবিল বাজারে। সশস্ত্র শান্তিবাহিনী ঐদিন রাতে খাগড়াবিল বাজার ঘেরাও করে দোকানে ঘুমন্ত ব্যবসায়িদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। বিভৎস সে ঘটনায় ৮ জন বাঙ্গালী মারা যায়।
পাতাছড়ার মো. নাসির উদ্দিন নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ১৯৮৬ সালের ১৩ জুলাই ঘটনার দিন মাগরিবের কিছু সময় আগে হঠাৎ করে একদল অস্ত্রধারী শান্তিবাহিনীর সদস্য বাড়িতে ঢুকে পড়ে। কিছু বুঝে উঠার আগে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ে। এ সময় গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় কেউ কাউকে উদ্ধারে এগিয়ে আসতে পারেনি। সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। আমার (নাসির) ছোট ভাই আবুল কাশেমকে আগুনে নিক্ষেপ করে। এ সময় আমাকেসহ নিয়ে মা বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করে। মায়ের কোলে একবছর বয়সী ছোট বোন আনোয়ারা থাকলেও ভুলে আরেক বোন মনোয়ারাকে বাড়ির ভেতর রেখে আসেন। মনোয়ারাকে আনতে মা বাড়ির ভেতর গেলে সন্ত্রাসীরা মাকে গুলি করে এবং ছোট বোন আনোয়ারাকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে আগুনে নিক্ষেপ করে। আর মনোয়ারাকে মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে খুন করে। পরের দিন আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসহ গিয়ে মরদেহগুলো উদ্ধার করে রাস্তার পাশে গণকবরে দাফন করি।
ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী নজরুল ইসলাম জানান, ১৩ জুলাই সকালে পাতাছড়ার ডাকবাংলা গ্রামে বাইরে থেকে কিছু অপরিচিত লোকজন আসে। স্থানীয় এক পাহাড়ীর বাড়িতে তারা কাজে এসেছেন বলে জানান। আসরের পরপর যখন হামলা শুরু হয় তখন তাদেরকেও সন্ত্রাসীদের সাথে দেখার কথা জানান নজরুল। বাড়িতে ঢুকে মা ছবুরী খাতুনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে এবং বোন রেহানা আক্তারকে আগুনে নিক্ষেপ করে হত্যার কথা ভুলতে পারেনি এখনও।
রামগড় পাতাছড়ার বাসিন্দা ও তৎকালীন আনসার সদস্য মো. মমতাজ মিয়া জানান, ৩৪ বছর অতিবাহিত হলেও নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত গণহত্যার কোন নথিতে উল্লেখ নেই। স্বজন হারানোর কষ্ট বুকে চেপে জীবন রক্ষায় সেদিন কোন মতে একটি কবরে স্বজনদের রেখে চলে যেতে হয়েছিল নিরীহ গ্রামবাসীদের।
রামগড়ের পাতাছড়া ডাকবাংলা পাড়া গণহত্যায় নিহতদের নামের তালিকা সম্বলিত সাইনবোর্ড স্থাপন করেছে তাদের স্বজনরা। এ সাইনবোর্ডে লেখা নিহতদের নামের তালিকায় রয়েছে, আবুল খায়েরের স্ত্রী হালিমা বেগম(৫৫), মেয়ে মনোয়ারা বেগম(৬), ছেলে আবুল কাশেম(৫), আনোয়ারা বেগম(১), ছায়েদুল হকের স্ত্রী ছবুরী খাতুন ও মেয়ে রেহানা রেহানা আক্তার। লাল মিয়ার মেয়ে মফিজা খাতুন।
১৯৮৬ সালের ১৩ জুলাই এ নিহতদের সবাইকে পাতাছড়া এলাকায় গণকবর দেওয়া হয়। পরেরদিন ১৪ জুলাই মো. সাত্তার নামে একজনের গলাকেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। একই বছরের ১৩ আগস্ট মো. আদম ছফি উল্লাহ নামে একজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুম করা হয়।
পাতাছড়া ছাড়াও হাফছড়ি ইউনিয়নের মধ্য হাফছড়ি এলাকায় সড়কের পাশেও গণ কবরের একটি সাইনবোর্ড রয়েছে।