parbattanews

রামগড়ে ৫ কোটি টাকার সরকারি প্রকল্প চালু হয়নি ১৪ বছরেও: আবাসিক অনাথ স্কুলটি এখন ভুতেরবাড়ি!

নির্জন উচু পাহাড়। চারিদিকে বন-জঙ্গল। দালান-কোটাগুলোও জঙ্গলী গাছ-গাছালি, লতা-পাতায় ঢেকে গেছে। টিন সেডের আধা পাকা ঘরগুলোর টিনের ছাউনী নেই। নেই দরজা-জানালা। ছাদ করা বিশালায়তনের দুটি ভবনেরও একই অবস্থা। কাঠের দরজা, জানালা ঘুনে খেয়ে ধ্বসে গেছে। কলাপসিবল গেটের তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেই গা শিউরে উঠে। যেন গা ছম ছমে ভুতুরে ভয়।

ভবনের ভিতরের বিভিন্ন কক্ষের কোনটিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে স্কুল বেঞ্চ। কোন কক্ষে পড়ার বক্স টেবিল ও চেয়ার আবার কোনটাতে স্টিলের তৈরি ঘুমানোর দোতলা খাট। মাকরশা আর নানান পোকা-মাকড়ের বাসা বেঁধেছে প্রতিটি কক্ষ। দেয়ালগুলো জঙ্গলী লতায় ঢাকা। পলেস্তরাল খসে খসে পড়ছে। দিনের বেলায়ও অন্ধকারচ্ছন্ন পরিবেশ। সবকিছু মিলিয়ে বলাা যায় এই যেন এক ভুতের আস্তানা। ভুতের বাড়ি। কিন্তু বাস্তবে এটি এতিম-অনাথদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা পরিত্যক্ত আবাসিক স্কুল।খাগড়াছড়ির রামগড়ের তৈছালাপাড়া এলাকায় এর অবস্থান।

স্থানীয় এতিম ও অনাথ বালক বালিকাদের ফ্রি লেখাপড়ার সুযোগ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই দীর্ঘ প্রায় ১৩-১৪ বছর আগে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এতিম-অনাথ আবাসিক স্কুলটি। ক্লাশ রুম, বেঞ্চ ব্লাকবোর্ড ছাড়াও বালক ও বালিকাদের জন্য আলাদা আলাদা দুইটি বিশাল সুদৃশ্য হোস্টেল ভবন, যেখানে রয়েছে ৫টি করে হল রুম, একটি ডাইনিং রুম, অফিস রুম, কেয়ারটেকার রুম ও আধুনিক মানের ওয়াশ রুম। থাকার হল রুমে রয়েছে স্টিলের তৈরি দোতলা খাট, লেপ, তোষক, বেড সীট, বালিশ, মশারি, রিডিং বক্স টেবিল, চেয়ার। ডাইনিং রুমের যাবতীয় ফার্ণিচার, ক্রোকারিজ সামগ্রী, কিচেনের হাঁড়ি পাতিল প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রই রয়েছে।

প্রধান শিক্ষক, সহকারি প্রধান শিক্ষক, সহকারি শিক্ষক ও কর্মচারির জন্য পৃথক পৃথক ডরমেটরিও আছে। আছে নিজস্ব বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ও ওয়াটার সাপ্লাই। ১২ একরের জায়গায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি পাকা সীমানা প্রাচীরে সংরক্ষিত । শিক্ষক-কর্মচারি নিয়োগ, ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির সব আয়োজনও সম্পন্ন করা হয়েছিল। কিন্তু তীরে এসে তরী ডুবার মতই ভাগ্যবরণ করতে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না পাওয়ায় সব প্রস্তুতি থাকার পরও চালু হয়নি প্রতিষ্ঠানটি।

২০০৬-০৭ সালে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠালগ্ন হতেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা ও গাফিলতিতে সরকারের কোটি কোটি টাকার এ সম্পদ অনাদরে-অবহেলায় পরিত্যক্ত থেকে এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যবহারের জন্য ক্রয় করা লেপ, তোষক, বালিশ, বিছানার চাদর, মশারি, ডাইনিং ও কিনেচের তৈজসপত্র, বিভিন্ন ভবনের বৈদ্যুতিক পাখা, লাইট, পানির ট্যাংকসহ মূল্যবান বিভিন্ন সামগ্রী রুমে-রুমে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। এসব মূল্যবান জিনিসপত্র নস্ট হয়ে যাচ্ছে। একজন কেয়ারটেকার নিয়োজিত থাকলেও তিনি নিধিরাম সর্দারের মত। তিনি পান না নিয়মিত বেতন।

পার্বত্য এলাকার এতিম, অনাথ বালক বালিকাদের শিক্ষা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড তিন পার্বত্য জেলায় তিনটি আবাসিক স্কুল নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়। এ তিনটি আবাসিক স্কুল প্রকল্পের জন্য পাঁচ কোটি টাকা করে মোট ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। ২০০৫ সালে নির্মাণের পর রাঙ্গামাটির রাজস্থলী ও বান্দরবানের রুমা উপজেলায় এ আবাসিক স্কুল চালু করা হলেও রামগড়ের স্কুলটি চালু হলো না।

২০০৭ সালে রামগড়ের স্কুলের জন্য মাস্টারোলে ৪ জন গার্ড, ২জন টেবিল বয়, ২ জন আয়া, পিয়ন ও একজন ঝাড়দার নিয়োগ এবং ২০০৮ সালে ৬০ জন এতিম, অনাথ বালক ও ৬০ জন বালিকা ভর্তির জন্য দরখাস্ত আহবান করে জমা নেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্কুলটি আর চালু করা হয়নি।

নিয়োগের এক বছর পর কর্মচারিদের মধ্যে চার জনের নিয়োগ বাতিল, তিনজনকে অন্য প্রকল্পের অধীনে বদলী এবং অপর দুইজনকে খাগড়াছড়ি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়ে নিয়ে যায় সংশ্লিষ্ট বিভাগ। গত বিএনপি সরকারের সময় উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালিন চেয়ারম্যান ওয়াদুদ ভূঞা এমপি রামগড়ের এতিম-অনাথ বালক বালিকাদের জন্য আবাসিক স্কুলটি প্রকল্পভুক্ত করেন। সে অনুযায়ী অবকাঠামো নির্মাণসহ অন্যান্য সব প্রস্ততি সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি আর আলোর মুখ দেখেনি।

Exit mobile version