রামুতে ৪৩ মেট্রিক টন চালসহ দু’ট্রাক জব্দ: অভিযুক্ত কর্মকর্তাই মামলার বাদি!

ramu pic 20.08
নিজস্ব প্রতিনিধি:
রামু উপজেলায় খাদ্য গুদামে ৪৩ মেট্রিক টন চাল সহ ২টি ট্রাক জব্দ করার ঘটনা মামলা হলেও বাদী হয়েছেন, দুর্নীতির ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত উপজেলা খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুজিত বিহারী সেন। বৃহস্পতিবার বিকালে রামু থানায় এ মামলা (নং-১৯) দায়ের করা হয়।

এ ঘটনায় রামুর সচেতম মহল ও মিল মালিকদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। কয়েকজন মিল মালিক ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, দুর্নীতির এ অভিযোগ থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যেই তাকে বাদী করা হয়েছে। এর ফলে নিয়মনীতি উপেক্ষা ও কমদামের নিম্নমানের চাল সরবরাহে জড়িত সিন্ডিকেট মোটা অংকের মিশন নিয়ে এ ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার যে অপতৎপরতা চালিয়ে আসছে তা সফল হতে চলেছে।

তারা আরো জানান, ৪৬০ বস্তা (৪৩ টন) চাল ভর্তি ২টি ট্রাক আটকের পর থেকেই স্থানীয় প্রশাসন এতবড় অনিয়মের ঘটনার রহস্য উন্মোচন সহ প্রকৃত দোষিদের আটক করতে চরম অবহেলা করেছে। এমনকি অভিযুক্ত খাদ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা, চাল সরবরাহে জড়িত কালোবাজারি সিন্ডিকেট এর সদস্যদের অভিযুক্ত করা হয়নি। উল্টো জব্দ করা ট্রাক দুটি চালক এবং হেল্পার সহ ৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আবার এদের আটক করার পরও ছেড়ে দেয়ার ঘটনায় তদন্তকাজে নিয়োজিত প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া জব্দকৃত চালের সবকটি বস্তায় খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং অপরপাশে মা মনি অটো রাইচ মিল লেখা রয়েছে। অথচ ওই রাইচ মিলের মালিক আবু তাহেরকেও মামলায় অভিযুক্ত করা হয়নি।

॥ ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা সুজিত বিহারী সেনের যত অনিয়ম ॥
চট্টগ্রামের রাউজান থানার উত্তর গুজরা গ্রামের শিব বিহারী সেনের ছেলে সুজিত বিহারী সেন। রামু খাদ্য গুদামে যোগদানের পর থেকে চালিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক দুর্নীতি। তার অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গুদামে খাদ্যশষ্য সরবরাহে আসা লোকজন এবং রামুর মিল মালিকরাও হয়রানির শিকার হয়ে আসছেন।

জানা গেছে, রামুতে ৮ জন মিল মালিকের কাছ থেকে চলতি বোরো মৌসুমে ৩ হাজার ৭৬ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এতবড় চাল সংগ্রহে কালোবাজারিদের সাথে নিজেই জড়িত হয়ে পড়েন সুজিত বিহারী সেন।

তিনি কালোবাজারি সিন্ডিকেট এবং চারজন মিল মালিকের সাথে আঁতাত করে ২ কিস্তিতে নিয়মনীতি উপেক্ষা ও কমদামের নিম্নমানের ৯৯৬ টন চাল খাদ্য গুদামে সরবরাহ করেছেন। যার সরকারি মূল্য ৩ কোটি ৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। এ কালোবাজারি সিন্ডিকেট এর সদস্যরা হলো উখিয়ার রহিম, কক্সবাজারের রফিক, সাগর ও বুলবুল।

মিলাররা জানান, এভাবে অন্য এলাকার ধান সংগ্রহ করা যাবে না। নিয়ম মতে স্থানীয় মিলারদের স্ব স্ব এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত ধান ক্রয় করে মিলে চাল প্রস্তুত করে গুদামে সরবরাহ করতে হবে। অথচ তা না করে রামুর ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তার নেতৃত্বে এ সিন্ডিকেট হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, বগুড়া, আশুগঞ্জ, চাক্তাই সহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে নিম্নমানের ও কম দামের সরকারি বিনির্দেশ বহির্ভূত চাল খাদ্য গুদামে সরবরাহ করছে। একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সুজিত বিহারী সেন নিজেই সিন্ডিকেট এর সাথে অবৈধ ব্যবসায় লিপ্ত হয়েছেন।

প্রকৃত চাল সরবরাহকারি কয়েকজন মিলার জানান, চাল সরবরার অভিযানের প্রথম থেকেই মিলারদের সাথে কালোবাজারি সিন্ডিকেট এর সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ এবং লেনদেনে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন সুজিত বিহারী সেন।

এছাড়া যে সকল মিলার সিন্ডিকেট এর আওতায় চাল সরবরাহ করেননি সেসব মিলার প্রকৃত কৃষকদের ধান ক্রয় করে মিলে চাল প্রস্তুত করে খাদ্য গুদামে সরবরাহ করেছেন। অথচ এসব প্রকৃত মিলারদের সরকারি নীতিমালার বিনির্দেশ এর কথা বলে নানারকম জটিলতার কথা বলে চরম হয়রানি করেছেন খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুজিত বিহারী সেন। হয়রানির অংশ হিসেবে খাদ্য বিভাগ এবং প্রশাসনের উধতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার কথা বলে এসব মিলারদের কাছে থেকে টনপ্রতি আড়াই হাজার টাকা করে উৎকোচ নিয়েছেন বিতর্কিত খাদ্য কর্মকর্তা সুজিত বিহারী সেন। মিলারদের কাছ থেকে আদায়কৃত উৎকোচ কখনো নিজের নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংকের একাউন্টে এবং বিকাশ এর মাধ্যমে হস্তান্তর করেছেন।

জানা গেছে, কালোবাজারি সিন্ডিকেট এর ব্যবসার সুবিধার জন্য একই তারিখে আবেদনকৃত ৮ মিলারের মধ্যে সিন্ডিকেট নির্ভর ৪ মিলারের নামে আলাদা বরাদ্দে আলাদা স্মারকে সরবরাহপত্র নেন।

অনিয়মে জড়িতরা খাদ্য গুদামে বেশী সেবা পায় বলে জানা গেছে। এরমধ্যে নীতিমালা লঙ্ঘন করে উত্তরাঞ্চল থেকে আনা নিম্নমানের চাল অগ্রাধিকারে গুদামে খালাস করা হয়। এসময় রামুর মিলারদের আনা চাল বহনকারি গাড়ি অপেক্ষমান থাকে। নিরুপায় হয়ে এসব মিলাররা নিজেদের মিলের শ্রমিকদের এনেই গুদামে চাল খালাস করে থাকেন। এরপরও গুদামের স্বঘোষিত মাঝি ছুরুত আলম ওইসব মিলারদের কাছ থেকে এরপর টাকা আদায় করেন।

জানা গেছে, ছুরুত আলম এ গুদামের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী না হলে সব কাজে তিনি খবরদারি করে থাকেন। এমনকি কালোবাজারি সিন্ডিকেট এর গাড়ির ভাড়া সহ অন্যান খরচ তিনি নিজেই লেনদেন করে থাকেন।

উল্লেখ্য, বুধবার (১৯ আগস্ট) বিকালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নিবার্হী ম্যাজিস্ট্রেট সোহাগ চন্দ্র সাহা রামু খাদ্য গুদামে অভিযান চালিয়ে ৪৬০ বস্তা (৪৩ মেট্রিক টন) চালসহ দুটি ট্রাক জব্দ করেন। ওইসময় খাদ্য বিভাগের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং কয়েকজন চিহ্নিত কালোবাজারি নীতিমালা লংঘন করে উত্তরাঞ্চল থেকে নিম্নমানের এসব চাল এনে রামু খাদ্য গুদামে সরবরাহ করছিলো।

রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুদ হোসেন জানিয়েছেন, প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, জব্দকৃত চাল রামু খাদ্য গুদামে সরবরাহের জন্য আনা হয়েছিলো। তবে এ ঘটনায় খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুজিত বিহারী সেনের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ ঘটনায় উপজেলা খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুজিত বিহারী সেন বাদী হয়ে রামু থানায় মামলা করেছেন। এতে ২টি ট্রাকের চালক ও হেল্পারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে তারা এখন পলাতক রয়েছেন। এছাড়া জব্দকৃত চালসহ ট্রাক ২টি উপজেলা প্রশাসনের হেফাজতে রয়েছে।

রামু থানার ওসি (তদন্ত) মোহাম্মদ কায় কিসলু জানিয়েছেন, এ ঘটনায় রামু খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুজিত বিহারী সেন মামলা করেছেন। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জানা গেছে, বোরো মৌসুমে রামু উপজেলায় ৩ হাজার ৭৬ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে খাদ্য বিভাগ। প্রতি কেজি ৩১ টাকা দামে স্থানীয় ৮টি রাইচ মিল থেকে মান অনুযায়ী এসব চাল ক্রয় করে খাদ্য গুদামে সংগ্রহ করার কথা ছিল। কিন্তু জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. তানভীর হোসেনের যোগসাজসে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এম,ই,এম ইকবাল হোসেন ও রামু খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুজিত বিহারী সেন কক্সবাজারের শীর্ষ কালোবাজারি তাজরেজা ফ্লাওয়ার মিলের ম্যানেজার সাগর-রফিক ও শহরের চাউলবাজারের এসবি এন্টারপ্রাইজের বুলবুল সিন্ডিকেট করে খাদ্য বিভাগের চুক্তিবদ্ধ কয়েকজন রাইচ মিল মালিককে জিম্মি করে খাদ্য গুদামের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

সিন্ডিকেটটি খাদ্য শস্য সংগ্রহ নীতিমালা লঙ্গন করে উত্তরাঞ্চলের বগুড়া, ময়মনসিংহ, ব্রাম্মনবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকার চালের মোকাম থেকে প্রতি কেজি ২০/২১ টাকা দামের নিম্নমানের চাল ক্রয় করে তা ৩১ টাকা দামে রামু খাদ্য গুদামে সরবরাহ করছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে বুধবার বিকালে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের নির্দেশে নিবার্হী ম্যাজিস্ট্রেট সোহাগ চন্দ্র সাহা রামু খাদ্য গুদামে অভিযান চালান। সেখান থেকে ঢাকা মেট্রো-ট-১৮-৬৬২৭ ও যশোর-ট-১১-২৬৮৮ নাম্বারের দুটি ট্রাক থেকে ৪৩ মেট্রিক টন চালসহ গাড়ি দুটি জব্দ করা হয়। এসব ট্রাক বগুড়া ও ময়মনসিংহ থেকে আনা হয় বলে চালকরা জানিয়েছেন।

বগুড়া থেকে আনা ঢাকা মেট্রো-ট-১৮-৬৬২৭ গাড়ির চালক ওবায়দুর রহমান জানান, রামু খাদ্য গুদামের জন্য বগুড়া থেকে ২৩ টন চাল নিয়ে আসা হয়। ওইদিন বিকালে ম্যাজিস্ট্রেট তা জব্দ করে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন