রাষ্ট্র, নাগরিক ও ‘সেটলার’

কাকন রেজা :

অনেকের অনেক লেখাতেই দেখি ‘সেটেলার’ শব্দটি। বিশেষ করে দেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী বাংলাভাষীদের বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অনেকে ‘সেটেলার’ এর পরিভাষা হিসাবে বোঝান ‘শরণার্থী’ শব্দটিকে, অর্থাৎ অন্য দেশ বা স্থান হতে আসা ‘আশ্রয়প্রার্থী’। ‘শরণার্থী’ বা ‘আশ্রয়প্রার্থী’ দুটিরই ইংরেজি `Refugee’, যার আরেকটি বাংলা প্রতিশব্দ ‘উদ্বাস্তু’। কিন্তু মজার বিষয় অভিধান খুঁজলে কিন্তু আলোচিত ‘সেটেলার’ শব্দটির দেখা মেলে না। যে শব্দটির দেখা মেলে সেটি হলো ‘সেটলার’। শব্দটি ভাঙলে দেখায় অনেকটা “সেট্ল(র)” এরূপ আর কী। যার অর্থ হলো, ‘ঔপনিবেশিক’। ব্যাখ্যা হলো, ‘নতুন উন্নয়নশীল দেশে বাস করতে আসা বিদেশী বসতকার’। ইংরেজিতে ‘সেটলার’ বিষয়টি বোঝানোর জন্য `The settlers had come to America to look for land’ এই বাক্যটিই সাধারণত ব্যবহার করা হয়। ক্যামব্রিজ অভিধান ‘সেটলার’ শব্দটিকে সুনির্দিষ্টি করতে বলেছে, ‘a person who arrivesespecially from another country’। আমাদের দেশে  ‘সেটলার’ কে ‘সেটেলার’ বানাতে গিয়ে শব্দটির মতো পুরো বিষয়টিতেই বিভ্রান্তি ঘটানো হয়েছে।

বিষদ বলার আগে রাষ্ট্র বিষয়ে বলি। সোজা ভাষায়, ‘একটি সুনির্দিষ্ট ভূখন্ডকে ঘিরে, রাষ্ট্রিক পরিচয়ে পরিচিত মানবগোষ্ঠীর স্বাধীন সত্ত্বাই হলো রাষ্ট্র’। যা আমরা ১৯৭১-এ একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছিলাম। এই মানবগোষ্ঠীর বিপরীতে ‘সেটলার’ শব্দটি কী যায়? যদি যায় তাহলে রাষ্ট্র মানে কী? এ পর্যায়ে নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব সাথে নাগরিক অধিকারের কথায় আসি এবং যথারীতি সহজ ভাষায়। যে অধিকার প্রশ্নে মাঝেমধ্যেই অনেকের ঘুম হারাম হয়ে যায় তারমধ্যে প্রধানতম হলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান। একজন নাগরিকের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের সংস্থান করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। আমাদের স্বাধীন সীমানার যে কোন স্থানে যে কোন নাগরিককে পুনর্বাসন করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের। একজন ভূমিহীন নাগরিকের বাসস্থান এবং খাদ্যের যোগানদানের অধিকার রাষ্ট্র সংরক্ষণ করে, যেহেতু এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এর বিরোধিতা করা নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের কমিটমেন্টের বিরোধিতা করা। মানবাধিকারের প্রশ্নে যা সবচেয়ে বড় মানবাধিকার বিরোধী কাজ।

সবাই মিলে যদি আমরা দেশটা স্বাধীন করে থাকি, তাহলে পুরো দেশটাই আমাদের। এখানে সম্প্রদায়, গোত্র বা ধর্মের প্রশ্নে আলাদা করে কিছু থাকার কথা নয়। থাকার কথা নয় সংখ্যাধিক্যেও। সুতরাং কোন যুক্তিতেই দেশের কোন অঞ্চল বা জায়গা সম্প্রদায়, ধর্ম বা অন্যকোন ভিত্তিতেই আলাদা করে বন্টনের প্রশ্ন উঠতে পারে না। দেশের একটি অঞ্চলকে কারো জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়ার প্রচেষ্টা মানেই দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে দ্বৈততার সৃষ্টি করা, বিরোধ সৃষ্টি করা। এমন হলে আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে, সম্প্রদায়গত কারণে সারাদেশ বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে পড়বে। উদাহরণ হিসাবে সিলেটের কথাই বলি। সিলেটের ভাষাকে অনেকেই বাংলার চেয়ে আলাদা বলেন। সিলেটের আলাদা বর্ণমালার কথাও ওঠে। তাহলে কী সিলেটকে শুধু সিলেটের মানুষের জন্য আলাদা করা দেয়ার কথা তুলতে হবে? বলতে হবে এখানে অন্যরা ‘সেটলার’, ‘ঔপনিবেশিক’? এমন কথা তোলা কী অন্যায়, রাষ্ট্র পরিপন্থী সর্বোপরি ৭১’এর অর্জন বিরোধী নয়?

অনেকেই পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে মেতেছেন। দীর্ঘদিন ধরেই পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী বাংলাভাষীদের ‘সেটেলার’ তথা ‘সেটলার’ বলে আখ্যায়িত করছেন তারা। খুব ‘সহজিয়া’ প্রশ্ন করা যায়, তবে কী বাংলাভাষীরা ‘ঔপনিবেশিক’? তারা কী?

‘a person who arrivesespecially from another country’? তাদের ক্ষেত্রে কী `The Bangladeshi settlers had come to Hill to look for land’ এই উদাহরণ ব্যবহার করা হবে? এর কী জবাব আমি জানি না। তবে একটা বিষয় জানি, আবেগ দিয়ে কোন কিছু ব্যাখ্যার আগে বাস্তবতাটা চিন্তা করে নেয়া দরকার। চিন্তা করা দরকার যে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা এই স্বাধীন ভূখন্ড অর্জন করেছিলাম, তা সম্প্রদায়, গোত্র, ভাষা, ধর্ম বা অন্যকোনে পরিচয়ে বিভক্ত করা জন্য নয়। এই দেশ অর্জিত হয়েছিল পুরো ভূখন্ডটিই নিজের ‘মাটি’ ভাবার জন্য, ‘মা’ ভাবার জন্য; খালা বা মাসি ভাবার জন্য নয়।

অন্যের জমি যদি কেড়ে নেয়া হয় তাহলে অন্যায়, কিন্তু একজন ভূমিহীনকে রাষ্ট্র যদি তার জায়গা বসবাসের জন্য দেয় তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাও কী উচিত? সেক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়গত পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন ‍তোলা তো আরো বেশী অনুচিতের মধ্যে পড়ে। অসাম্প্রদায়িকতার কথা যারা বলেন, তারা বলুন তো এরচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িকতা আর কী আছে? এটা রাষ্ট্রের কোন দয়ার দান নয়, একজন নাগরিকের প্রতি দেয়া রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি। একজন নাগরিক যিনি ভূমিহীন, তিনি সেই রাষ্ট্রেরই অংশ। জানি এর বিপরীতে অনেক কথা আসবে। আসবে রাষ্ট্র ও ‘সেটলার’ কর্তৃক নিপীড়নের কথা। আসবে ‘বাহিনী’ বিষয়ক কথকতা। এর বিপরীতেও যুক্তি আছে যা খন্ডন করা খুব আয়াসসাধ্য নয়। তবে যুক্তি যখন মার খায় তখন কৌশলীরা আবেগের আশ্রয় নেন, মানুষের সহানুভূতির জায়গায় খোঁচা দেন। যুক্তি ও বাস্তবতার বিপরীতে আবেগ একটি অপকৌশল, এটা যারা নেন তারাও বোঝেন।

সম্প্রতি রোমেল বা রমেল চাকমা নামে একজন পাহাড়ের অধিবাসী যুবকের প্রশ্নবোধক মৃত্যু নিয়ে কথা হচ্ছে। বিনা বিচারে একজন মানুষের মৃত্যু বিনা প্রশ্নে মেনে নেয় যারা তাদের মধ্যে ন্যায়বোধ সঠিক ভাবে বিকশিত হয়নি। কিন্তু এখানেও কথা আছে, এক যাত্রায় দুই ফল বিষয়ে। আমি যখন একটি বিচারবিহীন মৃত্যু নিয়ে সোচ্চার হবো, আরেকটির বিষয়ে চোখ বুঝে থাকবো তখন বুঝতে হবে আমার এই চাওয়ার মধ্যে ‘ইনটেনশন’ আছে। যে কোন বিচার বহির্ভূত মৃত্যুই সমর্থনযোগ্য নয়।

সুতরাং ‘ন্যায়বোধে’র বিষয়টি প্রমাণ করতে হলে সব বিচার বহির্ভূত মৃত্যুর ব্যাপারেই বলতে হবে, সেটি যদি শত্রুপক্ষেরও হয়। এটাই ‘ন্যায়বোধ’। আর মানুষের সাধারণ ‘ন্যায়বোধ’ থেকেই কিন্তু সৃষ্টি আইনের। জানি, এরপরেও এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, ব্যাখ্যা আসবে, আসবে ‘কী’ ও ‘কেনো’ সহযোগে প্রশ্নমালা। তবে এসব ‘কী’ ও ‘কেনো’র উত্তর খুঁজতে হলে যেতে হবে ইতিহাসের পথে অনেকদূর। ইতিহাস আর যুক্তির পথে অত দূরভ্রমন সবার জন্য আনন্দময় নাও হতে পারে।

ফুটনোট : আমি সাধারণত খুব সহজভাবে সব কিছু বলতে পছন্দ করি। কারণ অহেতুক তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে যারা যান তাদের সেই পথেও হেটে দেখেছি, মঞ্জিল কিন্তু একটাই। তাই সহজ করে বলাটাই সবচেয়ে ভালো। পান করাই যখন লক্ষ্য কী দরকার পানি ঘোলা করে। তাতে শুধু পানির বিশুদ্ধতাই নষ্ট হবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য, বাঙালী, সেটলার
Facebook Comment

One Reply to “রাষ্ট্র, নাগরিক ও ‘সেটলার’”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন