parbattanews

রূপকুমার চাকমা: পাহাড়ে এক সাহসের অকাল প্রয়াণ

রূপ কুমার চাকমা

অকালে চলে গেলেন পাহাড়ের অনন্য প্রতিবাদী যুবক রূপ কুমার চাকমা। তিনি কিডনী ও পিত্ত থলীর রোগে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গতকাল ৬মে সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

রূপ কুমার চাকমাকে প্রথম দেখি ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে রাঙামাটি জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি জসিম উদ্দীন কবির ভাইয়ের বাসায়। আমি তখন ব্যক্তিগত চিন্তায় সৃষ্ট নতুন সংগঠন `পার্বত্য সংহতি পরিষদ’ গঠনের কাজে খাগড়াছড়ি ভ্রমণ শেষে রাঙামাটি জেলা সফর করছিলাম। আমার সাথে ছিলেন খাগড়াছড়ি জেলায় নবগঠিত সংগঠনের আহ্বায়ক কমিটির নেতৃবৃন্দ।

পার্বত্য সংহতি পরিষদ আমার একটি তাৎক্ষণিক চিন্তার ফসল হলেও পাহাড়ের কিছু অসাধারণ মানুষ এগিয়ে এসে এটিকে একটি দারুণ সম্ভাবনায় রূপ দেন। এদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মনীন্দ্রলাল ত্রিপুরা, পরবর্তী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রুইথি কার্বারী, মনীন্দ্র কিশোর ত্রিপুরা, বাবুস্যি মারমা, প্রবীণ কুমার চাকমা, এল থাঙ্গা পাঙ্খো, হ্লা প্রু জিমি, বাঞ্ছা খিয়াং, রূপ কুমার চাকমা প্রমুখসহ তিন পার্বত্য জেলার ১৪টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বশীল কিছু মানুষ।

বাঙালিদের মধ্যে ছিলেন রাশিদুজ্জামান মিল্লাত, সাহাজ উদ্দীন, জসিম উদ্দীন,  কবির, হুমায়ুন কবির, মনিরুজ্জামান মনির, জাহাঙ্গীর কামাল, মুশতাক আহমেদ, পেয়ার আহমেদ, ওসমান গনি, আবদুল কুদ্দুস প্রমুখ।

আমার সহকর্মী সাংবাদিক সৈয়দ ইবনে রহমত ও এএইচএম প্রফুল্ল এই উদ্যোগের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল।

জসিম ভাইয়ের ড্রংয়িং রুম তখন রাঙামাটি জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি দিয়ে ঠাসা। এর মধ্যে কথা বললেন রূপ কুমার চাকমা। তখনো টগবগে যুবক। এর একবছর আগেই পিতা কিনা মোহন চাকমা জেএসএস সন্ত্রাসীদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। রূপ কুমার চাকমার চোখে, মুখে পিতা হত্যার শোক, ক্ষোভ, কণ্ঠে প্রতিবাদ স্পষ্ট ছিলো। তার বক্তৃতা উপস্থিত সকলকে বেদনার্ত করেছিলো। আমি সেদিনই তার মধ্যে পিতার মতো সম্ভাবনার স্ফুরণ দেখেছিলাম।

রূপ কুমার চাকমার পিতা কিনা মোহন চাকমা জেএসএস এর সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। কিন্ত শান্তিবাহিনীর হিংসাত্মক কার্যক্রম মেনে নিতে না পেরে দল থেকে পদত্যাগ করেন ১৯৮৫ সালে। শুধু পদত্যাগ করেই থেমে থাকননি তিনি, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী-বাঙালি সম্প্রীতির আন্দোলন শুরু করেন। এরফলও তিনি পেয়েছিলেন। প্রথম ও একমাত্র জেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত কিনা মোহন চাকমার বিভৎস লাশ

নির্বাচিত হওয়ার পর তার প্রচারণার শক্তি আরো বেড়ে যায়। কিন্তু শান্তিবাহিনীর কোকুনে কিনা মোহনের এই কর্মকাণ্ড মেনে নিতে পারেন তারা। সতর্কতা ও হুমকিতে কাজ না হওয়ার পর সাংগঠনিক নির্দেশে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ২০০৬ সালের ১ ডিসেম্বর তারিখে। অভিযোগ রয়েছে, শান্তিবাহিনীর কমাণ্ডার সত্যবীর দেওয়ানের সরাসরি নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়।

এভাবেই পাহাড়ে যারাই সন্ত্রাসের বিরোধিতা করেছে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। পরবর্তীকালে একইভাবে হত্যা করা হয় সাজেকের চেয়ারম্যান এল থাঙ্গা পাঙ্খোকে। কিনা মোহন চাকমার মতো তিনিও পাহাড়ী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডের বিরোধী ছিলেন। ঢাকায় পার্বত্য সংহতি পরিষদের সেমিনারে বাঘাইছড়ি থেকে এসে যোগদান করতেন। সন্ত্রাসে বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন।

বিশেষ করে বাঘাইছড়ির গঙ্গারাম মুখ দাঙ্গার পর তিনি গণমাধ্যমে স্পষ্ট করে বলেন, কিভাবে পাহাড়ী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী নিজেদের ঘরে ঘরে নিজেরা আগুন লাগিয়ে বাঙালিদের উপর দোষ চাপিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তিনি এ বক্তব্য গণমাধ্যমে দিয়েছিলেন। এর ফলশ্রুতিতে তাকেও হত্যা করা হয়। এল থাঙ্গা পাঙ্খোর লাশ পাওয়া যায়নি, তার মৃত্যুর দিনক্ষণও জানা যায় নি। পাহাড়ে হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষের অন্যতম তিনি।

এরকমই আরেকজন হারিয়ে যাওয়া মানুষ সার্জেন্ট মুকুল চাকমা। তার বাড়িও বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে। ২০১৬ সালের ৩০ মে বাঘাইছড়ি উপজেলার লাইল্যাঘোনা বক্কা চাকমার বাড়ি থেকে তাকে অপহরণ করা হয়। ওই ঘটনায় বাঘাইছড়ি উপজেলার চেয়ারম্যান বড় ঋষি চাকমা ছাড়াও জেএসএস সন্তু গ্রুপের প্রভাত চাকমা, ত্রিদিব চাকমা ও অজয় চাকমাকে আসামি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে বড় ঋষী চাকমাকে আটকও করা হয়েছিল। সার্জেন্ট মুকুলের খোঁজ মেলেনি এখনো।

তার মৃত্যুর পর তার মেয়ে নমিসা চাকমার সাথে আমি টেলিফোনে কথা বলেছিলাম। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, পিতার মৃত্যুর পর মামলা না দিতে কিভাবে তাদের হুমকি দেয়া হয়। এবং মামলা দেয়ার ‘অপরাধে’ কিভাবে তাদের বাড়িছাড়া করে পৈত্রিক ভিটে থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল সেই কষ্টের কথা।

শুধু কিনা মোহন চাকমাকে হত্যা করেই থেমে থাকেনি সন্ত্রাসীরা। তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাকেও অপহরণ করেছিল। রূপ কুমার চাকমার উপর চলেছিল নির্যাতন। তবুও তিনি থেমে থাকেননি। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলায় এলাকায় শান্তিপ্রিয় মানুষের মাঝে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। প্রতিদান স্বরূপ জনগণ ভোট দিয়ে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে তাকে।

রূপ কুমার চাকমা দুই পুত্র সন্তানের জনক। দুই সন্তানই এখনো পড়াশোনা করছেন বলে জানা গেছে। সন্ত্রাসীদের হুমকির কারণে শেষের দিকে স্ত্রী, পুত্রসহ রাঙামাটি জেলা সদরে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন।

২০০৮-০৯ সালের দিকে ঢাকায় আমাদের আয়োজিত একাধিক সেমিনারে রূপ কুমার চাকমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি সেই দুর্গম জুড়াছড়ি থেকে এসে আমাদের সেমিনারে অংশ নিয়েছিলেন। সেসময় তার জ্বালাময়ী বক্তব্য উপস্থিত শ্রোতা ও গণমাধ্যম কর্মীদের বিস্মিত করতো। অনেক সময় ভাবতাম, জুড়াছড়ির মতো শান্তিবাহিনীর অভয়াশ্রমে বসবাস করে এতো সাহস তিনি পান কী করে? হয়তো পিতার রক্তই তার শোণিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দীপশিখা জ্বালাতো। তাইতো একাধিকবার তার উপর চালানো হয়েছে নির্যাতনের স্টিম রোলার। তবুও তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর থামানো যায়নি। 

২০১৭ সালের ১৪মে রাঙামাটি জেলার জিমনেসিয়াম মাঠে অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশে রূপকুমার চাকমা এক জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন। তার এ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়।

এ বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘শান্তি চুক্তি হয়েছে, সন্তু লারমার নেতৃত্বে অস্ত্র জমা দেয়া হয়েছে, তাহলে পাহাড়ে এতে অবৈধ অস্ত্র এলো কোথা থেকে? চুক্তির ফলে পাহাড়ী-বাঙালী মিলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা সুখে শান্তি ঘুমাতে পারবো বলে, দুমুঠো ভাত খেতে পারবো বলে অনেক আশা করেছিলাম, কিন্তু তার কোন দেখা নেই। বরং তার বদলে পাহাড়ে সন্ত্রাসীরা তিনভাগে বিভক্ত হলো। ইউপিডিএফ, জেএসএস ও সংস্কার পার্টির নামে। সন্ত্রাস আরো বেড়ে গেলো। জেএসএস অস্ত্র জমা দিয়েছে কিন্তু তারপরেও পাহাড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি কোথায় কোথা থেকে এলো? আর প্রশাসন কি চোখে দেখে না? প্রশাসন কি দেখে না পাহাড়ে দিন দুপুরে চাঁদাবাজি হচ্ছে? অস্ত্র নিয়ে পাহাড়ে ঘুরাঘুরি করছে? তাদের ধরছে না কেন?

তিনি সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, অস্ত্রের ঝনঝনানি শুধু সাধারণ জনগণের ওপর দেখাতে পারেন, সাহস থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সে সাহসের নমুনা দেখান। মানবাধিকার কমিশনকে পক্ষপাত দুষ্টু অভিহিত করে রূপ কুমার চাকমা বলেন, যখন আমার বাবাকে হত্যা করা হল, মা-বোনকে অপহরণ করা হল, আমার ওপর নির্যাতন নেমে আসল তখন আপনাদের মানবাধিকার কোথায় ছিল?

রূপ কুমার চাকমা আরও বলেন, সরকার ৪৬ বছর পরে এসে যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারে, জঙ্গীদের সমূলে ধ্বংস করতে পারে, তাহলে পার্বত্য এলাকায় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারবে না কেন? যারা মানুষকে খুন করে তাদের বিচার করতে পারবে না কেন?

পাহাড়ে কোন হত্যার বিচার হয় না কেন? এই পিঁপড়ার মত পাহাড়ী সন্ত্রাসী গ্রুপকে সরকার কেন দমন করতে পারছে না? তিনি আরও বলেন, আমরা আর পাহাড়ে চাঁদাবাজি, গুম, হত্যা, অপহরণ চাই না। পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের ভূখন্ড। সারা দেশে চাঁদা বাজি, গুম, হত্যা, অপহরণের বিচার হতে পারলে এই পার্বত্য অঞ্চলের বিচার হয় না কেন? পাহাড়ের মানুষ কি বাংলাদেশের নাগরিক নয়? ” (সূত্র- পার্বত্যনিউজ.কম, ১৫মে, ২০১৭।)

পাহাড়ে বর্তমান সময়ে এমন সাহসী লোকের সংখ্যা খুব বেশী নয়। রূপকুমারের অকাল মৃত্যুতে এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হারালো পাহাড়। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।

লেখক: সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ, চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন।


লেখকের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আরো কিছু লেখা

Exit mobile version